ইউপি নির্বাচন
নৌকার জন্য ছোটাছুটি

সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২১ | ২০:২৮
ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের তফসিলে তৃণমূলে ভোটের হাওয়া বইছে। তবে অনেকটাই একপক্ষীয়। আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছাড়া অন্যদের ভোটে তেমন আগ্রহ নেই। নৌকা পেতে প্রতি ইউনিয়নে তিন থেকে ডজনখানেক নেতার তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। সম্প্রতি বিএনপি এই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেওয়ায় শাসক দলের মনোনয়নকেই ভোটে জেতার নিশ্চয়তা মনে করা হচ্ছে। তাই নির্বাচনের মাঠে ভোটের চেয়ে বেশি লড়াই নৌকা পেতে। এতে তৃণমূলে সহিংসতার শঙ্কাও তীব্র হচ্ছে। দল নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও ভোটে অংশ নিতে ইচ্ছুক অধিকাংশ বিএনপি নেতাকর্মী। কেউ কেউ রয়েছেন দ্বিধাদ্বন্দ্বে। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা জানিয়েছেন, কেউ চাইলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ভোট করতে পারবেন। দলের বাইরে গিয়ে ভোট করে কতটা লাভ হবে, তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে বিএনপির তৃণমূলের নেতাদের মধ্যে। পৌর নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তোলা সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এখনও নিশ্চিত করেনি তারা ইউপি নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার সমকালকে বলেছেন, ''গত কয়েক বছরে নির্বাচনের অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, তাতে নৌকা পেলেই জয় নিশ্চিত। এ কারণেই ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন পেতে এত তীব্র প্রতিযোগিতা। যে আওয়ামী লীগের টিকিট পাবে সে ভোট না পেলেও প্রশাসন তাকে জিতিয়ে দেবে- এমন একটি বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয়েছে একতরফা নির্বাচনগুলোর কারণে। আবার দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকার কারণে শাসক দলে পেশিশক্তির বহু নেতা তৈরি হয়েছে। কিন্তু সবার কপালে তো মনোনয়ন জুটবে না। এমন পেশিশক্তিধারী যদি বিদ্রোহী প্রার্থী হয়, তাহলে দলের প্রার্থীর সঙ্গে সংঘাত অনিবার্য। নির্বাচন কমিশনের অবস্থা 'কানে দিয়েছি তুলো, পিঠে বেঁধেছি কুলো'। তারা নীতি কথা বলা ছাড়া সহিংসতা বন্ধে আর কিছু করবে বলে বিশ্বাস হয় না।''
দেশের সাড়ে চার হাজার ইউনিয়ন পরিষদের অধিকাংশের ভোট হবে এ বছরে। প্রথম ধাপে ৩৭১টি ইউপিতে ভোট ১১ এপ্রিল। পরবর্তী পাঁচ ধাপে বাকিগুলোতে ভোট হবে। প্রথম ধাপে মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ তারিখ ১৮ মার্চ। দ্বিতীয়বারের মতো চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে ভোট হতে যাচ্ছে। তবে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো দল এখন পর্যন্ত দলীয় মনোনয়ন ফরম বিতরণ শুরু করেনি।
সমকালের প্রতিনিধিদের খবর অনুযায়ী, নির্দলীয় পদ্ধতিতে ইউপি নির্বাচন ভোটের চেয়েও বেশি ছিল গ্রামীণ উৎসব। রাজনীতির চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেত গ্রাম, গোষ্ঠী ও আত্মীয়তার সমীকরণ। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন শুরুর পর তা পাল্টে গেছে। জাতীয় রাজনীতি ইস্যু হয়ে উঠেছে ভোটের নিয়ামক। বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো কোণঠাসা থাকায় নির্বাচন একপেশে হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষের আগ্রহও কম। একমাত্র জিজ্ঞাসা, কে পাচ্ছেন নৌকা প্রতীক? দলের মনোনয়ন না পেলে কে হবেন বিদ্রোহী?
নৌকা পেলে জয় নিশ্চিত- এমন ধারণায় ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন পেতে জোর লবিং চলছে। এলাকা ছেড়ে মনোনয়নপ্রত্যাশী রাজধানী ও জেলা শহরে ছুটছেন দলের টিকিট পেতে। তবে সদস্য (মেম্বার) পদে নির্বাচন নির্দলীয় হওয়ায় তা নিয়ে পাড়ায়-মহল্লায় যথেষ্ট আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।
প্রতি ইউপি থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশীর প্যানেল পাঠাতে তৃণমূলে চিঠি দিয়েছে আওয়ামী লীগ। সেখান থেকে একজনকে বেছে নেবে দলটির মনোনয়ন বোর্ড। শোনা যাচ্ছিল, বিএনপি ভোট বর্জন করায় নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রতি কঠোর নাও হতে পারে আওয়ামী লীগ।
এ গুঞ্জন নাকচ করেছেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান। তিনি সমকালকে বলেছেন, আওয়ামী লীগ দলীয় শৃঙ্খলা বিষয়ে কঠোরই থাকবে। কেউ দলের মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী হলে তাকে বহিস্কার করা হবে। তিনি ভবিষ্যতে আর মনোনয়নের জন্য বিবেচিত হবেন না।
২০১৬ সালের ইউপি এবং সদ্য সমাপ্ত পৌর নির্বাচনে দেখা গেছে ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যেই সহিংসতার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে। সেবার ছয় ধাপে চার হাজার ১০৪টি ইউনিয়ন পরিষদে ভোট হয়েছিল। সেই নির্বাচন ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে রক্তাক্ত। সমকালের হিসাবে ১২১ জনের মৃত্যু হয়েছিল গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনী সহিংসতায়। দুই হাজার ৬৪৫টিতে চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছিলেন নৌকার প্রার্থী। এর মধ্যে ২২০টিতে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায়। বিএনপি ওই নির্বাচনে ৫৫৬টি ইউপিতে প্রার্থী দিতে পারেনি। জয়ী হয়েছিলেন ৩৭২ চেয়ারম্যান পদে। ৮৮০টি ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী। আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৫০ শতাংশের কিছু বেশি। বিএনপি পেয়েছিল ১৯ শতাংশ ভোট। দুই শতাংশের কম ভোট পাওয়া জাতীয় পার্টি ৪০ ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছিল।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর সদ্য সমাপ্ত পাঁচ ধাপের পৌরসভা নির্বাচনেও একই ধারা ছিল। ২৩০ পৌরসভার ১৮৫টিতে মেয়র পদে জিতেছে আওয়ামী লীগ। ভোট পেয়েছে প্রায় ৫৯ ভাগ। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জেতা ৩০ মেয়রের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী। বিএনপি ১৯ শতাংশ ভোট পেয়ে ১১টিতে মেয়র পদে জিতেছে। জাতীয় পার্টি জিতেছে একটিতে।
পৌর নির্বাচনে ব্যাপক জালজালিয়াতির অভিযোগ তুলে ইউপি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। প্রায় সব ইস্যুতে সরকারের কথা বলে 'গৃহপালিত বিরোধী' দলের তকমা পাওয়া জাতীয় পার্টিও পৌর নির্বাচনে ভোট ডাকাতির অভিযোগ তুলেছে। দলটির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু সমকালকে বলেছেন, যে প্রক্রিয়ায় নির্বাচন হচ্ছে, তাতে অংশ নেওয়া অর্থহীন। সরকারি দল প্রশাসন ও পুলিশ দিয়ে ভোট কেটে নিচ্ছে। মেরুদণ্ডহীন নির্বাচন কমিশন বিন্দুমাত্র ব্যবস্থা নিচ্ছে না। জাতীয় পার্টি ইউপির ভোটে অংশ নেবে কিনা তা দলের প্রেসিডিয়াম সভায় আলোচনায় ঠিক হবে।
বিএনপি ভোট বর্জনের ঘোষণা দিলেও দলের তৃণমূলের অনেক নেতাই নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী। ২০১৯ সালে বিএনপি দলীয়ভাবে বর্জন করার পরও দলের অনেক নেতা উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। তাদের দল থেকে বহিস্কার করা হয়েছিল। তবে এবার বহিস্কারের মতো কঠোর সিদ্ধান্ত নেই।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, দলীয় সিদ্ধান্ত হলো বিএনপি ইউপি নির্বাচনে অংশ নেবে না। প্রার্থী মনোনয়ন দেবে না। কেউ যদি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করেন, তা তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, এই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনেই যাওয়া উচিত নয় বলে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে স্থানীয় জনগণের চাপে দলীয় কোনো নেতা যদি নির্বাচন করেন, তাতে বাধা নেই।
গতবারের ইউপি নির্বাচনে বিপুল সংখ্যক প্রাণহানি হলেও কাজী রকিব উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি) উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। আগের রাতে ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভরা, কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই, জাল-জালিয়াতি, কর্মকর্তাদের সহায়তায় ফল পাল্টে দেওয়ার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটলেও চিঠি চালাচালি ছাড়া কিছুই করেনি ইসি।
আসন্ন ইউপি নির্বাচনে বর্তমান ইসির ভূমিকা প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম সমকালকে বলেছেন, ২০১৬ সালে সহিংসতার মাত্রা কেমন ছিল তা তার জানা নেই। তবে সহিংসতা শুধু ইসির পক্ষে রোধ করা সম্ভব নয়। প্রার্থী ও ভোটারদেরও সচেতন হতে হবে। যেকোনো মূল্যে জয়ী হওয়ার মনোভাবের কারণেই সহিংসতা হয়। তা রোধে মনোভাবে পরিবর্তন আনতে হবে। ইসি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে সহিংসতা রোধে সম্ভাব্য সকল ব্যবস্থাই নেবে।
১১ এপ্রিল খুলনার পাঁচ উপজেলার ৩৫টি ইউনিয়নে ভোট হবে। এখানেও আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ। প্রতি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী তিন থেকে চারজন। গতবার যারা দলের মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী হয়েছিলেন তারা এবারও নৌকা চান। কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নে গতবার নৌকা না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন মিজানুর রহমান খোকা। জানালেন, এবার মনোনয়ন পাবেন বলে আশাবাদী। না পেলে আবারও স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন।
১৩ ইউপিতে সম্ভাব্য প্রার্থীদের ব্যানার-ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে সন্দ্বীপ। তাদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী। বিএনপির কেউ কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হবে বলে শোনা গেলেও মাঠে নেই। প্রথম ধাপে সাতক্ষীরার কলোরোয়ার ১০ ইউপির নির্বাচন হবে। সেখানেও একই চিত্র। প্রতি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা পাঁচ থেকে ১০ জন হলেও বিএনপি নেতারা একেবারেই নীরব। ১২নং যুগিখালী ইউনিয়নের ভোটার আবদুল খালেক, আবদুল মাজেদসহ কয়েকজন জানালেন, আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কেউ মাঠে নেই। ভোটের আমেজ নেই। বিএনপি নেতারা বলেছেন, ভোটে অংশ নিয়ে লাভ নেই। নির্বাচনের ইচ্ছাও নেই।
বরিশালের বানারীপাড়ার চিত্রও অভিন্ন। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে প্রতি ইউনিয়ন থেকে একাধিক নেতা লবিং, তদবির চালাচ্ছেন। ইলুহার ইউনিয়নে দু'জন বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। দল ভোট বর্জনের ঘোষণা দেওয়ার পর তারাও আর আগ্রহী নন।
বরিশাল সদরের চার ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ২৯ জন। বিএনপির কেউ নেই। চরবাড়িয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপি সভাপতি জিয়াউল ইসলাম বাবু বলেছেন, ফল তো আগেই নির্ধারণ হয়ে থাকে, ভোট করে লাভ কি?
বাগেরহাটে মোরেলগঞ্জে ১৬ ইউপিতে নৌকা চেয়েছেন ১৩৯ জন। তবে কিছুটা ভিন্ন চিত্র সিলেটে। সেখানে বিএনপির কয়েকজন নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। লালবাজার বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক নানু মিয়া বলেছেন, দল ও স্থানীয় জনগণ তার সঙ্গে রয়েছে। ভোট করবেন। দল যদি ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত বদল করে তবে 'ধানের শীষ' চান।
পটুয়াখালীর দশমিনায় তিনটি ইউপিতে সম্ভাব্য মেম্বার প্রার্থীদের প্রচারণায় ভোটের উৎসব তৈরি হয়েছে। তবে চেয়ারম্যান পদে ভোটের মাঠ অন্য এলাকার মতোই, নীরব নিষ্প্রভ। পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার ইউনিয়নগুলোতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর ছড়াছড়ি হলেও অন্য দলের কারও প্রচার নেই।
- বিষয় :
- ইউপি নির্বাচন
- নির্বাচন
- নৌকা
- ইউনিয়ন পরিষদ
- আওয়ামী লীগ