একাত্তরের গণহত্যা (২)
স্মৃতিফলক আছে বেষ্টনী নেই

আবু সালেহ রনি, খুলনা থেকে ফিরে
প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ২৬ মার্চ ২০২১ | ১৩:২২
খুলনা জেলার তেরখাদা উপজেলার আঠারবাকি নদী তীরবর্তী গ্রাম সাঁচিয়াদহ। নদীর এ পাড়ে সাঁচিয়াদহ বাজার, অন্য পাড়ে চুনখোলা গ্রাম। খুলনা শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরের এই অজপাড়াগাঁও রক্ষা পায়নি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতা থেকে।
১৯৭১-এর ১৪ মে এই সাঁচিয়াদহ বাজার ও এর আশপাশের এলাকায় অতর্কিত হামলা চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। নৃশংসভাবে হত্যা করে ৬০ জনেরও বেশি মুক্তিকামী বাঙালিকে। অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি ধর্ষণ ও লুটপাটও করে তারা। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে বেশ কয়েকবার এখানে সংঘটিত হয়েছে নৃশংস গণহত্যা।
সাঁচিয়াদহ গণহত্যার সেই দুঃসহ স্মৃতি স্মরণ এবং স্থানীয়দের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ স্মরণীয় করে রাখতে স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর সাঁচিয়াদহ বাজারের পাশে 'শহীদ স্মৃতিফলক' স্থাপন করা হয়। খুলনার গণহত্যা জাদুঘরের উদ্যোগে ৬০ জনের নামসহ শহীদ স্মৃতিফলক নির্মাণ করে সেদিন শহীদদের স্মরণে আয়োজন করা হয়েছিল সুধী সমাবেশও।
আড়াই বছর পর এই মার্চে সরেজমিনে সাঁচিয়াদহ বাজারে গিয়ে দেখা যায়, ১০ ফুট উচ্চতার স্মৃতিফলকটির সামনের অংশের সাত ফুট মাটির নিচে চাপা পড়েছে। অদূরে দোতলা মার্কেট নির্মাণকাজের জন্য আনা বালু ও রড জমা করে রাখা হয়েছে- ফলকটির পেছন দিকের অংশ এর আড়ালে চলে গেছে। স্থানীয়রা জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ড নদী খনন করে তোলা মাটি স্মৃতিফলকের সামনে রাস্তায় স্তূপ করে রেখেছিল, সেই মাটির নিচেই চাপা পড়তে চলেছে স্মৃতিফলকটি। এ বিষয়ে সংশ্নিষ্ট প্রশাসনও নির্বিকার।
জানতে চাইলে ৪নং সাঁচিয়াদহ ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার রিংকু বালা সমকালকে বলেন, পাউবো নদী খনন করা মাটির স্তূপ ফেলে রেখে স্মৃতিফলকটি ঢেকে দিয়েছে। আবার জনদুর্ভোগও সৃষ্টি করেছে। এ নিয়ে অনেক বলার পরও তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
গণহত্যা জাদুঘর শুধু সাঁচিয়াদহ বাজারেই নয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় এমন আরও ৪৭টি স্মৃতিফলক নির্মাণ করেছে দেশের ছয়টি জেলায়। এগুলো খুলনা, বাগেরহাট, ঢাকা, রাজশাহী, দিনাজপুর ও পঞ্চগড়ে। কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে অনেক স্মৃতিফলক এখন বিলীন হওয়ার উপক্রম। নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকায় এমন পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনও এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এসব স্মৃতিফলকে নিরাপত্তা বেষ্টনী (সীমানা প্রাচীর/দেয়াল) নির্মাণ করে সংরক্ষণের দাবি করে আসছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা।
একাত্তরের ১৭ এপ্রিল খুলনার তেরখাদার আজগড়া গ্রামে নারকীয় গণহত্যা চালিয়ে ৪০ জনেরও বেশি বাঙালিকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। তাদের মধ্যে ১৭ জনের নামসহ বিআরবি আজগড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সামনে স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয় ২০১৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। সেখানে কথা হয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রমেন্দ্র নাথ মল্লিকের সঙ্গে।
তিনি সমকালকে বলেন, স্মৃতিফলক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা ও পাকিস্তানিদের নৃশংসতা নিয়ে আলোচনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। এখানে যারা আসেন তাদের মুখে গণহত্যাসহ এসব বিষয় নিয়ে আলোচনাও উঠে আসে। শিক্ষার্থীরাও তাদের পূর্বপুরুষদের সাহসিকতা এবং আত্মত্যাগ সম্পর্কে জানতে পারে। বিদ্যালয়েও বিভিন্ন দিবসে মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের সংগ্রাম নিয়ে আলোচনা হয়।
খুলনার শহরতলির আরেকটি বধ্যভূমি গল্লামারীতে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের এই গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের সময় কতজনকে হত্যা করা হয়েছে, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান মেলেনি। তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, এখানে শহীদের সংখ্যা দশ হাজারের কাছাকাছি।
গল্লামারীতে পাকিস্তানি গণহত্যা প্রসঙ্গে বাহাত্তরের ১২ ফেব্রুয়ারি দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, 'গল্লামারী খুলনা শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে মাত্র দেড় মাইল। সেখানে শুধু ধানের ক্ষেত। মার্চের আগে গল্লামারী নামটা শুনলে চোখের সামনে ভেসে উঠত ধানের শীষে শীষে ভরে ওঠা দিগন্তবিস্তীর্ণ ভূমি। কিন্তু মার্চের পরে? তখন গল্লামারী নাম শুনলে খুলনার যে কোনো লোকের মন আতঙ্কে ভরে উঠত। হাজার হাজার বাঙালির রক্তে রঞ্জিত হয়েছে গল্লামারী। আমার মনে হয়, বাংলাদেশে গল্লামারীর মতো কোনো দ্বিতীয় স্থান নেই- যেখানে জল্লাদেরা এত অধিক সংখ্যক বাঙালিকে হত্যা করেছে।'
গল্লামারী নদীর ওপরে তখন পাকা সেতু ছিল না, ছিল কাঠের পুল। ২০১৬ সালের ৬ জানুয়ারি গল্লামারী বধ্যভূমিতে শহীদ স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়, যা দূর-দূরান্তের পথিককেও কিছু সময়ের জন্য থমকে দিচ্ছে।
২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে দেশের সব বধ্যভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপর গত দেড় যুগে কয়েকশ বধ্যভূমি চিহ্নিত হলেও সংশ্নিষ্ট উপজেলা প্রশাসনের অবহেলায় তা সংরক্ষণ করা হয়নি। এমন প্রেক্ষাপটে ২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর চিহ্নিত ২৭১টি বধ্যভূমি সংরক্ষণের জন্য ৪৪২ কোটি টাকার প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন করে সরকার। প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ এখনও চলছে। এরই মধ্যে দেশের ২৮ জেলায় ৬৫৪টি বধ্যভূমি চিহ্নিত করেছে খুলনায় স্থাপিত গণহত্যা জাদুঘর। ৬৪ জেলা জরিপ শেষ হলে বধ্যভূমির সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন জাদুঘর-সংশ্নিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন সমকালকে বলেন, আমরা এ পর্যন্ত ৬৫৪টি বধ্যভূমি চিহ্নিত করেছি। তার মধ্যে ৪৭টি বধ্যভূমিতে স্মৃতিফলক লাগানো হয়েছে। বধ্যভূমির অনেক স্থান বিভিন্নভাবে হারিয়ে গেছে, কিছু বেদখল হয়ে আছে। তাই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এসব বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণের স্বার্থেই এগুলো সংরক্ষণ করা জরুরি।
পরে বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের নজরে নেওয়া হয়। তিনি সমকালকে বলেন, 'বধ্যভূমি সংরক্ষণের জন্য মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প বর্তমানে বাস্তবায়ন পর্যায়ে রয়েছে। আমরা বিভিন্ন মাধ্যম থেকে এখনও বধ্যভূমির অবস্থান জেনে নাম তালিকাভুক্ত করছি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানাতে সারাদেশে চিহ্নিত সব বধ্যভূমিই সংরক্ষণ করা হবে।'
স্মৃতিফলক লাগানো এলাকাগুলো হলো- খুলনার বটিয়াঘাটা বাদামতলা বধ্যভূমি, মুন্সিবাড়ি বধ্যভূমি, পাইওনিয়ার কলেজ, খুলনা হেলিপোর্টের নির্যাতন কেন্দ্র, খুলনা সদর ভূতের বাড়ি নির্যাতন কেন্দ্র, চরেরহাট গণহত্যা, গল্লামারী বেতার ভবন নির্যাতন কেন্দ্র, হ্যানে রেলওয়ে পাবলিক স্কুল বধ্যভূমি, ফুলতলার পিপরাইল চারাবাটি ঘাট, দৌলতপুর, তেরখাদার সাঁচিয়াদহ, আজগড়া, ডুমুরিয়ার আন্দুলিয়া মসজিদ, খুলনা মহানগরে নশুখানের ইটভাটার গণহত্যা ও বধ্যভূমি, খালিশপুর প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিল, খুলনা নিউজপ্রিন্ট গণহত্যা-গণকবর, দৌলতপুর আড়ংঘাটা, বটিয়াঘাটা গজালিয়া স্লুইসগেট, রাজশাহী সদর মুন্নাফের মোড়, হাদীর মোড়, মোহনপুরের সাঁকোয়া, পবার বাগধানী গণকবর, পঞ্চগড়ের মিঠাপুকুর, সদরের মীরগড়, আটোয়ারির ডাংগীরহাট গণকবর ও বধ্যভূমি, ডাংগীরহাট পুকুরপাড় ক্যাম্প ও নির্যাতন কেন্দ্র, লইপাড়ায় জেলা পরিষদ বধ্যভূমি, সদর থানা চত্বর বধ্যভূমি, শেরেবাংলা পার্ক নির্যাতন কেন্দ্র, ঈদগাহ মাঠ পুরাতন ক্যাম্প বধ্যভূমি, আটোয়ারি মির্জাপুর (পুরাতন দিঘি) ক্যাম্প ও নির্যাতন কেন্দ্র, মির্জাপুর (পুরাতন দিঘি) গণকবর, রাঁধানগর, রাঁধানগর গণকবর, সদরে হাড়িভাসা পশ্চিম খপড়াবন্দী (কামাত), পশ্চিম খপড়াবন্দী (কামাত) গণকবর, দিনাজপুর সদর দোহাপাড়া (নয়াহাট) তোড়েয়া, রাজবাটী, উথরাইলে গোদাগাড়ি, বিরলের কামদেবপুর, বীরগঞ্জের চৌপুকুরিয়া, জলা পুকুরপাড়, বাগেরহাটের মানসা বাজার, ঢাকার মিরপুরে সরকারি বাঙ্লা কলেজ বধ্যভূমি, সরকারি বাঙ্লা কলেজে গণহত্যার সাক্ষ্য বহনকারী আমগাছ এবং জোড়া গাবগাছ।
১৯৭১-এর ১৪ মে এই সাঁচিয়াদহ বাজার ও এর আশপাশের এলাকায় অতর্কিত হামলা চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। নৃশংসভাবে হত্যা করে ৬০ জনেরও বেশি মুক্তিকামী বাঙালিকে। অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি ধর্ষণ ও লুটপাটও করে তারা। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে বেশ কয়েকবার এখানে সংঘটিত হয়েছে নৃশংস গণহত্যা।
সাঁচিয়াদহ গণহত্যার সেই দুঃসহ স্মৃতি স্মরণ এবং স্থানীয়দের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ স্মরণীয় করে রাখতে স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর সাঁচিয়াদহ বাজারের পাশে 'শহীদ স্মৃতিফলক' স্থাপন করা হয়। খুলনার গণহত্যা জাদুঘরের উদ্যোগে ৬০ জনের নামসহ শহীদ স্মৃতিফলক নির্মাণ করে সেদিন শহীদদের স্মরণে আয়োজন করা হয়েছিল সুধী সমাবেশও।
আড়াই বছর পর এই মার্চে সরেজমিনে সাঁচিয়াদহ বাজারে গিয়ে দেখা যায়, ১০ ফুট উচ্চতার স্মৃতিফলকটির সামনের অংশের সাত ফুট মাটির নিচে চাপা পড়েছে। অদূরে দোতলা মার্কেট নির্মাণকাজের জন্য আনা বালু ও রড জমা করে রাখা হয়েছে- ফলকটির পেছন দিকের অংশ এর আড়ালে চলে গেছে। স্থানীয়রা জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ড নদী খনন করে তোলা মাটি স্মৃতিফলকের সামনে রাস্তায় স্তূপ করে রেখেছিল, সেই মাটির নিচেই চাপা পড়তে চলেছে স্মৃতিফলকটি। এ বিষয়ে সংশ্নিষ্ট প্রশাসনও নির্বিকার।
জানতে চাইলে ৪নং সাঁচিয়াদহ ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার রিংকু বালা সমকালকে বলেন, পাউবো নদী খনন করা মাটির স্তূপ ফেলে রেখে স্মৃতিফলকটি ঢেকে দিয়েছে। আবার জনদুর্ভোগও সৃষ্টি করেছে। এ নিয়ে অনেক বলার পরও তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
গণহত্যা জাদুঘর শুধু সাঁচিয়াদহ বাজারেই নয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় এমন আরও ৪৭টি স্মৃতিফলক নির্মাণ করেছে দেশের ছয়টি জেলায়। এগুলো খুলনা, বাগেরহাট, ঢাকা, রাজশাহী, দিনাজপুর ও পঞ্চগড়ে। কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে অনেক স্মৃতিফলক এখন বিলীন হওয়ার উপক্রম। নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকায় এমন পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনও এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এসব স্মৃতিফলকে নিরাপত্তা বেষ্টনী (সীমানা প্রাচীর/দেয়াল) নির্মাণ করে সংরক্ষণের দাবি করে আসছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা।
একাত্তরের ১৭ এপ্রিল খুলনার তেরখাদার আজগড়া গ্রামে নারকীয় গণহত্যা চালিয়ে ৪০ জনেরও বেশি বাঙালিকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। তাদের মধ্যে ১৭ জনের নামসহ বিআরবি আজগড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সামনে স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয় ২০১৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। সেখানে কথা হয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রমেন্দ্র নাথ মল্লিকের সঙ্গে।
তিনি সমকালকে বলেন, স্মৃতিফলক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা ও পাকিস্তানিদের নৃশংসতা নিয়ে আলোচনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। এখানে যারা আসেন তাদের মুখে গণহত্যাসহ এসব বিষয় নিয়ে আলোচনাও উঠে আসে। শিক্ষার্থীরাও তাদের পূর্বপুরুষদের সাহসিকতা এবং আত্মত্যাগ সম্পর্কে জানতে পারে। বিদ্যালয়েও বিভিন্ন দিবসে মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের সংগ্রাম নিয়ে আলোচনা হয়।
খুলনার শহরতলির আরেকটি বধ্যভূমি গল্লামারীতে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের এই গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের সময় কতজনকে হত্যা করা হয়েছে, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান মেলেনি। তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, এখানে শহীদের সংখ্যা দশ হাজারের কাছাকাছি।
গল্লামারীতে পাকিস্তানি গণহত্যা প্রসঙ্গে বাহাত্তরের ১২ ফেব্রুয়ারি দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, 'গল্লামারী খুলনা শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে মাত্র দেড় মাইল। সেখানে শুধু ধানের ক্ষেত। মার্চের আগে গল্লামারী নামটা শুনলে চোখের সামনে ভেসে উঠত ধানের শীষে শীষে ভরে ওঠা দিগন্তবিস্তীর্ণ ভূমি। কিন্তু মার্চের পরে? তখন গল্লামারী নাম শুনলে খুলনার যে কোনো লোকের মন আতঙ্কে ভরে উঠত। হাজার হাজার বাঙালির রক্তে রঞ্জিত হয়েছে গল্লামারী। আমার মনে হয়, বাংলাদেশে গল্লামারীর মতো কোনো দ্বিতীয় স্থান নেই- যেখানে জল্লাদেরা এত অধিক সংখ্যক বাঙালিকে হত্যা করেছে।'
গল্লামারী নদীর ওপরে তখন পাকা সেতু ছিল না, ছিল কাঠের পুল। ২০১৬ সালের ৬ জানুয়ারি গল্লামারী বধ্যভূমিতে শহীদ স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়, যা দূর-দূরান্তের পথিককেও কিছু সময়ের জন্য থমকে দিচ্ছে।
২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে দেশের সব বধ্যভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপর গত দেড় যুগে কয়েকশ বধ্যভূমি চিহ্নিত হলেও সংশ্নিষ্ট উপজেলা প্রশাসনের অবহেলায় তা সংরক্ষণ করা হয়নি। এমন প্রেক্ষাপটে ২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর চিহ্নিত ২৭১টি বধ্যভূমি সংরক্ষণের জন্য ৪৪২ কোটি টাকার প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন করে সরকার। প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ এখনও চলছে। এরই মধ্যে দেশের ২৮ জেলায় ৬৫৪টি বধ্যভূমি চিহ্নিত করেছে খুলনায় স্থাপিত গণহত্যা জাদুঘর। ৬৪ জেলা জরিপ শেষ হলে বধ্যভূমির সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন জাদুঘর-সংশ্নিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন সমকালকে বলেন, আমরা এ পর্যন্ত ৬৫৪টি বধ্যভূমি চিহ্নিত করেছি। তার মধ্যে ৪৭টি বধ্যভূমিতে স্মৃতিফলক লাগানো হয়েছে। বধ্যভূমির অনেক স্থান বিভিন্নভাবে হারিয়ে গেছে, কিছু বেদখল হয়ে আছে। তাই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এসব বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণের স্বার্থেই এগুলো সংরক্ষণ করা জরুরি।
পরে বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের নজরে নেওয়া হয়। তিনি সমকালকে বলেন, 'বধ্যভূমি সংরক্ষণের জন্য মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প বর্তমানে বাস্তবায়ন পর্যায়ে রয়েছে। আমরা বিভিন্ন মাধ্যম থেকে এখনও বধ্যভূমির অবস্থান জেনে নাম তালিকাভুক্ত করছি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানাতে সারাদেশে চিহ্নিত সব বধ্যভূমিই সংরক্ষণ করা হবে।'
স্মৃতিফলক লাগানো এলাকাগুলো হলো- খুলনার বটিয়াঘাটা বাদামতলা বধ্যভূমি, মুন্সিবাড়ি বধ্যভূমি, পাইওনিয়ার কলেজ, খুলনা হেলিপোর্টের নির্যাতন কেন্দ্র, খুলনা সদর ভূতের বাড়ি নির্যাতন কেন্দ্র, চরেরহাট গণহত্যা, গল্লামারী বেতার ভবন নির্যাতন কেন্দ্র, হ্যানে রেলওয়ে পাবলিক স্কুল বধ্যভূমি, ফুলতলার পিপরাইল চারাবাটি ঘাট, দৌলতপুর, তেরখাদার সাঁচিয়াদহ, আজগড়া, ডুমুরিয়ার আন্দুলিয়া মসজিদ, খুলনা মহানগরে নশুখানের ইটভাটার গণহত্যা ও বধ্যভূমি, খালিশপুর প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিল, খুলনা নিউজপ্রিন্ট গণহত্যা-গণকবর, দৌলতপুর আড়ংঘাটা, বটিয়াঘাটা গজালিয়া স্লুইসগেট, রাজশাহী সদর মুন্নাফের মোড়, হাদীর মোড়, মোহনপুরের সাঁকোয়া, পবার বাগধানী গণকবর, পঞ্চগড়ের মিঠাপুকুর, সদরের মীরগড়, আটোয়ারির ডাংগীরহাট গণকবর ও বধ্যভূমি, ডাংগীরহাট পুকুরপাড় ক্যাম্প ও নির্যাতন কেন্দ্র, লইপাড়ায় জেলা পরিষদ বধ্যভূমি, সদর থানা চত্বর বধ্যভূমি, শেরেবাংলা পার্ক নির্যাতন কেন্দ্র, ঈদগাহ মাঠ পুরাতন ক্যাম্প বধ্যভূমি, আটোয়ারি মির্জাপুর (পুরাতন দিঘি) ক্যাম্প ও নির্যাতন কেন্দ্র, মির্জাপুর (পুরাতন দিঘি) গণকবর, রাঁধানগর, রাঁধানগর গণকবর, সদরে হাড়িভাসা পশ্চিম খপড়াবন্দী (কামাত), পশ্চিম খপড়াবন্দী (কামাত) গণকবর, দিনাজপুর সদর দোহাপাড়া (নয়াহাট) তোড়েয়া, রাজবাটী, উথরাইলে গোদাগাড়ি, বিরলের কামদেবপুর, বীরগঞ্জের চৌপুকুরিয়া, জলা পুকুরপাড়, বাগেরহাটের মানসা বাজার, ঢাকার মিরপুরে সরকারি বাঙ্লা কলেজ বধ্যভূমি, সরকারি বাঙ্লা কলেজে গণহত্যার সাক্ষ্য বহনকারী আমগাছ এবং জোড়া গাবগাছ।