ঢাকা শুক্রবার, ১৮ জুলাই ২০২৫

যে যেভাবে পারছে ঢাকা ছাড়ছে

যে যেভাবে পারছে ঢাকা ছাড়ছে

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ জুন ২০২১ | ১১:৩৪

কঠোর লকডাউনে সারাদেশের সবকিছু বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ফের গ্রামমুখী মানুষের ঢল নেমেছে। গত এপ্রিলে 'সর্বাত্মক লকডাউনের' আগে যে অবস্থা তৈরি হয়েছিল এবারও তাই দেখা যাচ্ছে। করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়েই যে যেভাবে পারছে ঢাকা শহর ছেড়ে যাচ্ছে।

রাজধানী ঢাকা থেকে দূরপাল্লার বাস, ট্রেন ও লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকলেও প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, পিকআপ, অটোরিকশায় গাদাগাদি করে লাখো মানুষ রাজধানী ছাড়ছে। শনিবার রাজধানীর গাবতলী ও আবদুল্লাহপুর এলাকায় এ চিত্র দেখা গেছে। হাজার টাকায়ও মোটরসাইকেলে গাবতলী থেকে পাটুরিয়া ঘাটে যাচ্ছে যাত্রী। মাইক্রোবাসে জনপ্রতি আড়াই হাজার টাকায় রংপুর যাচ্ছে। লঞ্চ বন্ধ থাকলেও ঘাটে ফেরিতে উপচেপড়া ভিড় হচ্ছে।

গাবতলী এলাকায় পরিবহনের সঙ্গে জড়িতরা জানালেন, সোমবার থেকে অফিস-আদালতের পাশাপাশি গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে লাখো মানুষের ঢল নামবে। গত বছরের মার্চে প্রথম দফায় লকডাউনে কলকারখানা বন্ধ ঘোষণার পর যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, এবারও তাই হবে। কোনোভাবেই এ ঢল ঠেকানো যাবে না।

সমকাল প্রতিনিধিরা জানান, শনিবার দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া, মাওয়া ঘাট ও শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুটে যাত্রীর ঢল নামে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা দূরের কথা, স্বাস্থ্যবিধির কোনো তোয়াক্কাই করেনি যাত্রীরা।

শুক্রবার রাতে তথ্য অধিদপ্তরের বরাতে জানা যায়, সোমবার থেকে আরেকটি কঠোর লকডাউন আসছে। সাত দিনের এ লকডাউনে সরকারি-বেসরকারি সব অফিস বন্ধ থাকবে। চলবে না গাড়ি। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হওয়া যাবে না। এ খবর ছড়িয়ে পড়ার পর শনিবার সকাল থেকে গ্রামমুখী জনস্রোত সৃষ্টি হয়। নিম্ন আয়ের মানুষ এবং গ্রামে পরিবার রেখে ঢাকায় থাকা কর্মজীবীরা শহর ছাড়ছেন। তারা বলছেন, সব বন্ধ হয়ে গেলে শহরে থেকে কী করবেন? কাজ না থাকলে তাদের কে খাওয়াবে? আর অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, সাত দিনের জন্য কঠোর লকডাউনের কথা বলা হলেও পরে তা ধাপে ধাপে বাড়বে। লকডাউন শুরু হলে গাড়ি চলবে না। তাই এখনই চলে যাচ্ছেন।

করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি রোধ এবং ডেল্টা বা ভারতীয় ধরনের বিস্তার ঠেকাতে রাজধানী ঢাকাকে সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে গত মঙ্গলবার থেকে দূরপাল্লার বাস, ট্রেন ও লঞ্চ বন্ধ রয়েছে। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে রাজধানীর চারপাশের সাত জেলায় গণপরিবহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। প্রথম দিনে কড়াকড়ি থাকলেও পরবর্তী দিন থেকেই ঢিলেঢালা হয়ে যায় লকডাউন। প্রায় বিনা বাধায় ঢাকায় প্রবেশ ও বের হতে পারছে বাস ছাড়া সব ধরনের যানবাহন।

শনিবার দুপুরে দীর্ঘ যানজট ঠেলে সেতু পেরিয়ে গাবতলীর আমিনবাজার গিয়ে দেখা যায়, শখানেক প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাস যাত্রীর অপেক্ষায় রয়েছে। প্রাইভেটকারে তিন থেকে চারজন এবং মাইক্রোবাসে ১০ থেকে ১৫ জন করে যাত্রী যাচ্ছেন উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে।

প্রাইভেটকার চালক সাদ্দাম হোসেন জানান, যাত্রীপ্রতি ৫০০ টাকায় চন্দ্রা যাচ্ছেন। যাত্রীর খুব একটা অভাব হচ্ছে না। সকাল থেকে দুই 'ট্রিপ' দিয়েছেন। আগের দিনগুলোতে চন্দ্রা থেকে ঢাকামুখী যাত্রী ছিল। তবে শনিবার শুধু ঢাকায় যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে, আসার লোক নেই।

প্রাইভেটকারের যাত্রী দ্বীন ইসলাম সমকালকে বলেছেন, তার বাড়ি লালমনিরহাটের পাটগ্রামে। পরিবার গ্রামে থাকে। ঢাকায় মেসে থেকে ট্রেডিং কোম্পানিতে ছোট একটা চাকরি করেন। সোমবার থেকে অফিস বন্ধ হয়ে যাবে। ঘরের বাইরেও নাকি বের হওয়া যাবে না। কাজ না থাকলে ঢাকায় থেকে কী করবেন? তাই চলে যাচ্ছেন। তিনি জানান, তার এলাকার আরও কয়েকজনকে পেয়েছেন। সবাই মিলে চন্দ্রা থেকে এলেঙ্গা যাবেন। সেখান থেকে বাস চলে। বাসে লালমনিরহাট যাবেন।

সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, দূরপাল্লার বাস ছাড়া আর কিছুই বন্ধ নেই। গত ১৫ মাসের মধ্যে চার মাসের বেশি বাস বন্ধ রয়েছে। বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা। বাস বন্ধ থাকায় যাত্রীরা গাদাগাদি করে যাচ্ছেন। এতে করোনার ঝুঁকি বাড়ছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাস চালু থাকলে ঝুঁকি বরং কমত।

শিমুলিয়া ঘাটে যাত্রীর ঢল: মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, শনিবার শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুটে যাত্রী পারাপারে ছিল অত্যধিক চাপ। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা দূরের কথা, স্বাস্থ্যবিধির কোনো তোয়াক্কাই করেননি যাত্রীরা।

গণপরিবহন বন্ধ থাকায় ভেঙে ভেঙে যানবাহনে চড়ে হাজার হাজার যাত্রী শিমুলিয়া ঘাট হয়ে ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়ি ছুটছেন। পথে অতিরিক্ত ভাড়া গুনলেও থেমে নেই যাত্রীর ঢল। শিমুলিয়া ঘাটের ফেরিতে যাত্রীর উভয়মুখী উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে। এখানে ফেরি ছাড়া অন্যান্য নৌযান বন্ধ থাকায় এ নৌযানেই পদ্মা পাড়ি দিতে শুক্রবার থেকেই যাত্রী বেড়েছে বলে ঘাট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।

কেরানীগঞ্জ থেকে আসা আব্দুস সালাম জানান, ১০০০ টাকা ভাড়ায় তিনিসহ চার যাত্রী সিএনজি অটোরিকশায় ঘাট এলাকায় এসেছেন। প্রতিটি চেকপোস্টে তাদের থামতে হয়েছে। শিমুলিয়া ঘাট হয়ে এখন ফেরিতে তারা পদ্মা পারাপার হবেন। ঢাকাগামী যাত্রী মাদারীপুরের সালমা বেগম জানান, বিয়ে খেতে মিরপুর যাচ্ছেন তারা। তবে বিয়ের আনন্দ ভোগান্তিতে পরিণত হয়েছে।

দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া রুটে ফেরিতে গাদাগাদি: গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) প্রতিনিধি জানান, শনিবার সকাল থেকে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে যাত্রীদের ঢল নামে। কোনো প্রকার স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে মানুষ ছুটেছে নিজেদের গন্তব্যে।

সরেজমিন দৌলতদিয়া ঘাট ঘুরে দেখা যায়, ঢাকা ও আশপাশের জেলার কর্মজীবী হাজার হাজার মানুষ পাটুরিয়া থেকে ফেরিতে গাদাগাদি করে দৌলতদিয়া আসছেন। তবে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় গন্তব্যে যেতে চরম বিড়ম্বনার শিকার হন। কয়েকগুণ বেশি ভাড়া দিয়ে মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল, মাহিন্দ্রা, অটোরিকশাসহ বিভিন্ন যানবাহনে যাত্রীরা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছোটেন। অন্যদিকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কিছু মানুষ আবার ঢাকায় ফিরছে।

পাটুরিয়া ঘাটে ঢাকাগামী যাত্রীর ভিড় :শিবালয় (মানিকগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, শনিবার সকাল থেকেই পাটুরিয়া ঘাটে ঢাকাগামী যাত্রীর উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে। স্থানীয়রা জানান, লকডাউন দেওয়ায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার শত শত যাত্রী ঢাকা যাওয়া শুরু করেছেন। সরকারের নির্দেশনা অমান্য করে যাত্রীরা ফেরিতে পদ্মা-যমুনা নদী পাড়ি দিয়ে পাটুরিয়া ঘাটে আসছেন। যাত্রীরা কোনো বাধা মানছেন না। ফেরিতে নদী পাড়ি দিয়ে পাটুরিয়া ঘাটে এসে প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল, সিএনজি অটোরিকশা ও ট্রাকে চড়ে যাত্রীরা জনপ্রতি ৫০০-৬০০ টাকা ভাড়া দিয়ে গন্তব্যে যাচ্ছেন। যানবাহনের জন্য ঘাট এলাকায় যাত্রীদের যানবাহনের অপেক্ষায় থেকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে।

বাংলাবাজার নৌরুটে ভিড় কম ঢাকাগামী যাত্রীর: শিবচর (মাদারীপুর) প্রতিনিধি জানান, ঘরমুখো মানুষের চাপ বেড়েছে শিবচরের বাংলাবাজার ঘাটে। ফেরিতে রয়েছে ঘরমুখো যাত্রীর উপচে পড়া ভিড়। তবে বাংলাবাজার ঘাটে ঢাকাগামী যাত্রীর ভিড় খুব বেশি দেখা যায়নি। গত তিন দিনের তুলনায় ঢাকাগামী যাত্রীর ভিড় কমেছে। এখানে লঞ্চ ও সিবোট চলাচল বন্ধ রয়েছে। সকাল থেকে কয়েক ঘণ্টা বৃষ্টি ও বৈরী আবহাওয়ার ফলে যাত্রীদের অনেকটাই দুর্ভোগে পড়তে হয়। দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের প্রায় ১৭টি সড়কে দূরপাল্লার পরিবহন বন্ধ থাকায় ছোট ছোট যানবাহনে করে দু-তিন গুণ ভাড়া বেশি দিয়ে বাড়ি পৌঁছাতে হচ্ছে এ অঞ্চলের মানুষের।

আরও পড়ুন

×