ঢাকা বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

দুই দিনের মধ্যে আসছে ৪৫ লাখ ডোজ টিকা

দুই দিনের মধ্যে আসছে ৪৫ লাখ ডোজ টিকা

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ০১ জুলাই ২০২১ | ১৪:০৩

করোনার প্রতিষেধক টিকাদান কর্মসূচি নিয়ে বাংলাদেশ যে অনিশ্চয়তায় পড়েছিল তা কাটতে শুরু করেছে। আগামী দুই দিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন থেকে ৪৫ লাখ ডোজ টিকা আসছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে টিকার বৈশ্বিক জোট কোভ্যাক্সের আওতায় মডার্নার ২৫ লাখ এবং চীন থেকে কেনা সিনোফার্মের টিকার ২০ লাখ ডোজ আসবে। এরপর ধাপে ধাপে আরও কয়েকটি উৎস থেকে টিকা আসার কথা রয়েছে। সব মিলিয়ে চলতি বছর প্রায় ১০ কোটি ডোজ টিকা পাবে বাংলাদেশ। এসব টিকাকে কেন্দ্র করেই চলবে দেশে টিকাদান কর্মসূচি। এটাকে সরকারের কূটনৈতিক সফলতা বলে মনে করছেন অনেকে। আবার কেউ কেউ বলেছেন, একটি উৎসের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল। শেষ পর্যন্ত সরকারও সেটি বুঝতে পেরে টিকার সব উৎসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে এবং এতে সফলতাও এসেছে।
স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, দেশে এ পর্যন্ত আসা টিকার মধ্যে মডার্নার টিকা হবে চতুর্থ টিকা। এর আগে প্রথমে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট উৎপাদিত অক্সফোর্ডের টিকা কোভিশিল্ড, চীনের সিনোফার্ম এবং ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা দেশে পৌঁছায়। তবে দেশে এ পর্যন্ত মোট আটটি টিকা জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন পেয়েছে। এর মধ্যে তিনটির প্রয়োগ শুরু হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীন থেকে আসা টিকার বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সমকালকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে মডার্নার টিকার ২৫ লাখ ডোজ নিয়ে দুটি বিমান বাংলাদেশের পথে রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম চালানে ১২ লাখ ডোজ টিকা নিয়ে একটি বিমান আগামীকাল (আজ শুক্রবার) রাত ১১টা ২০ মিনিটে রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করবে। দ্বিতীয় চালানে শনিবার রাত সাড়ে ৮টায় ১৩ লাখ টিকা নিয়ে আরেকটি বিমান একই বিমানবন্দনে অবতরণ করবে। শুক্রবার মডার্নার টিকার প্রথম চালান আসার পরপরই ওই দিন রাত সাড়ে ১২টার দিকে প্রথম চালানে সিনোফার্মের টিকার ১২ লাখ ডোজ আসবে। শনিবার আরও ১৩ লাখ ডোজ টিকা আসবে। সব মিলিয়ে দুই দিনের মধ্যে ৪৫ লাখ টিকা পাওয়া যাবে বলে জানান তিনি।
আজ শুক্রবার রাতে মডার্না ও সিনোফার্মের টিকা গ্রহণের জন্য তিনি নিজেও বিমানবন্দরে উপস্থিত থাকবেন বলে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, টিকা নিয়ে কয়েক মাস ধরে যে সংকট চলছিল তা দূর হতে যাচ্ছে- এটি আনন্দের খবর। সিনোফার্মের দেড় কোটি ডোজ টিকা কেনার চুক্তি হয়েছে। আগামী তিন মাসের মধ্যে ধাপে ধাপে সেই টিকা চলে আসবে। একইসঙ্গে রাশিয়ার টিকা স্পুটনিক-ভি কেনার জন্য চুক্তির বিষয়টিও চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। দ্রুতই রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন মন্ত্রী।
চলতি বছর কোভ্যাক্স থেকেও টিকার বড় চালান আসবে উল্লেখ করে জাহিদ মালেক বলেন, কোভ্যাক্স থেকে মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ হারে মোট ৬ কোটি ৮০ লাখ ডোজ টিকা বিনামূল্যে পাওয়া যাবে। এর মধ্যে ফাইজারের এক লাখ ডোজ এসেছে। মডার্নার ২৫ লাখ ডোজ আসছে। কোভ্যাক্সের বাকি টিকাও চলতি বছরের মধ্যেই চলে আসবে। একইসঙ্গে জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা কেনার বিষয়টিও প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। মোট কথা টিকার জন্য একটি কিংবা দুটি উৎসের ওপর আমরা নির্ভরশীল হয়ে থাকতে চাই না। টিকার সব উৎস উন্মুক্ত রাখা হবে। যখন যার কাছ থেকে পাওয়া যাবে সঙ্গে সঙ্গে সেই টিকা গ্রহণ করব। তবে ওই সব টিকা অবশ্যই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত হতে হবে।
জরুরি ব্যবহারে অনুমোদন আট টিকা, ব্যবহার হচ্ছে তিনটি :স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, দেশে জরুরি ব্যবহারের জন্য এখন পর্যন্ত আটটি টিকা অনুমোদন পেয়েছে। এর মধ্যে তিনটির প্রয়োগ শুরু হয়েছে। জরুরি ব্যবহারের জন্য চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট উৎপাদিত টিকা কোভিশিল্ড অনুমোদন পায়। করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে এটি দেশে প্রথম অনুমোদিত টিকা। দ্বিতীয় টিকা হিসেবে ২৭ এপ্রিল রাশিয়ার জেনেরিয়াম জয়েন্ট স্টক কোম্পানি উদ্ভাবিত স্পুটনিক-ভি অনুমোদন পায়। তিন দিনের মাথায় ২৯ এপ্রিল তৃতীয় টিকা হিসেবে অনুমোদন পায় চীনের বেইজিং ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল প্রোডাক্টস উদ্ভাবিত টিকা সিনোফার্ম। ২৭ মে ফাইজার-বায়োএনটেক উদ্ভাবিত টিকা জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দেয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। এর ১১ দিনের মাথায় ৩ জুন চীনের আরেকটি টিকা সিনোভ্যাক অনুমোদন পায়। ১৫ জুন অনুমোদন পায় বেলজিয়ামের ওষুধ কোম্পানি জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা। ২৩ জুন অনুমোদন পায় অ্যাস্ট্রাজেনেকার, সুইডেন উৎপাদিত টিকা। সর্বশেষ ২৯ জুন অনুমোদন পেয়েছে মডার্নার টিকা।
তবে দেশে এখন পর্যন্ত তিনটি টিকার প্রয়োগ শুরু হয়েছে। প্রথমে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট উৎপাদিত অক্সফোর্ডের টিকা কোভিশিল্ডের প্রয়োগ শুরু হয়। এরপর মে মাসে সিনোফার্ম এবং জুনে ফাইজারের টিকার প্রয়োগ শুরু হয়েছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে মডার্নার টিকার প্রয়োগও শুরু হবে বলে স্বাস্থ্য বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন। ওই কর্মকর্তা বলেন, ঢাকার বাইরে ফাইজার ও মডার্নার টিকার সংরক্ষণ সুবিধা নেই। এ কারণে ঢাকার বাসিন্দাদের মধ্যে এ টিকা বিতরণ করা হবে। কোন ক্যাটাগরির মানুষ এ টিকা পাবেন পর্যালোচনা করে তা নির্ধারণ করা হবে বলে জানান তিনি।
সংকট যেভাবে শুরু :ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে অক্সফোর্ডের টিকার তিন কোটি ডোজ কেনার চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ করে মোট তিন কোটি টিকা দেওয়া কথা ছিল। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী টিকা সরবরাহ করেনি প্রতিষ্ঠানটি। জানুয়ারিতে প্রথম চালানে ৫০ লাখ এবং ফেব্রুয়ারিতে দ্বিতীয় চালানে ২০ লাখ ডোজ টিকা সরবরাহ করা হয়। আর ভারত সরকারের কাছ থেকে উপহার হিসেবে ৩৩ লাখ ডোজ টিকা পায় বাংলাদেশ। এরপর চলতি বছরের মার্চে টিকা রপ্তানি স্থগিতের ঘোষণা দেয় ভারত সরকার। কারণ হিসেবে সেদেশে করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাপক টিকাকরণ ও কাঁচামাল সংকটের কথা বলা হয়। চুক্তি অনুযায়ী টিকা না পাওয়ায় চলতি বছরের ২৬ এপ্রিল প্রথম ডোজের টিকাদান কার্যক্রম বন্ধ করে সরকার। কিন্তু প্রথম ডোজ গ্রহণকারী সাড়ে ১৩ লাখ মানুষের দ্বিতীয় ডোজ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। অক্সফোর্ডের টিকা মজুদ আছে, অথচ ব্যবহার করছে না- এমন সব দেশের কাছ থেকে টিকা পাওয়ার চেষ্টা চালায় সরকার। তাতেও সফলতা আসেনি। ভারত থেকে টিকা না পেয়ে বিকল্প উৎস হিসেবে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে যোগাযোগ করে সরকার। এরই ধারাবাহিকতা চীনের সিনোফার্মের টিকার দেড় কোটি ডোজ ক্রয়ের চুক্তি হয়। তবে চীন দু'দফায় সিনোফার্মের টিকার ১১ লাখ ডোজ বাংলাদেশকে উপহার দেয়। ওই টিকা দিয়ে সীমিত পরিসরে আবারও টিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়। এর মধ্যে কোভ্যাক্সের আওতায় ফাইজারের এক লাখ ৬২০ ডোজ টিকা পেয়েছে বাংলাদেশ। একইসঙ্গে রাশিয়ার সঙ্গেও টিকা কেনা ও যৌথ উৎপাদনের চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। চলতি বছর কোভ্যাক্সের আওতায় আরও সাড়ে ছয় কোটি ডোজ টিকা আসার কথা রয়েছে। একইসঙ্গে কোভ্যাক্সের মাধ্যমে জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকার সাত কোটি ডোজ কেনার প্রক্রিয়া চলছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বছরের জুনের পর থেকে জনসনের টিকা পাবে বাংলাদেশ। সব মিলে টিকা নিয়ে বাংলাদেশের সামনে যে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছিল তা অনেকটাই কাটতে শুরু করেছে বলে মনে করে সংশ্নিষ্টরা।



আরও পড়ুন

×