করোনাকালে আরেকটি ঈদুল আজহা কাল
আনন্দ যেন না হয় বিষাদ

সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৯ জুলাই ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ১৯ জুলাই ২০২১ | ১৫:১৯
করোনাভাইরাস মহামারির অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সব আনন্দ-উৎসব এখন ফিকে। বিশেষ দিনগুলোও বিশেষ হয়ে উঠছে না। তবু সময়ের ঘড়ি তো আর থেমে থাকে না। ঠিকই বয়ে চলে। বর্ষপঞ্জির পাতাও উল্টাতে হয়। সেভাবেই সময়ের আবর্তনে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সামনে আবারও এসেছে ঈদ। মহামারির দুঃখ-কষ্ট-ক্লেশ, স্বজন হারানোর বেদনাকে এক পাশে সরিয়ে রেখে মানুষ কিছুটা হলেও উদ্দীপনা নিয়ে ঝুঁকছে উৎসবের দিকে। তবে গত তিনটি ঈদের মতো এবারের ঈদেও নেই নিরঙ্কুশ আনন্দঘন পরিবেশ। স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখতে গিয়ে ধর্মীয় আচার পালনেও ঘটছে বিঘ্ন। তবু সব প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করেই আগামীকাল সারাদেশের মুসলমানরা উদযাপন করতে যাচ্ছেন পবিত্র ঈদুল আজহা।
প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের মধ্যেও ঝুঁকি নিয়ে লাখ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়ছেন। গত ১৫ ও ১৬ জুলাই দুই দিনে ৭০ লাখ মোবাইল সিম ব্যবহারকারী ঢাকা ছেড়েছেন। একজনের দুটি করে সিম হলেও দুই দিনে ৩৫ লাখ মানুষ ঢাকা ছেড়েছেন। পরবর্তী দুই দিনে আরও বেশি মানুষ ঢাকা ছাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে ঈদ উপলক্ষে এক কোটির মতো মানুষ ঢাকা ছাড়বেন।
মানুষের উৎসবমুখর গৃহযাত্রার মধ্যেই গতকাল করোনায় ২৩১ জনের মৃত্যুর খবর এসেছে। শনাক্ত হয়েছেন ১৩ হাজারের বেশি মানুষ। এরপরও দলবেঁধে হাজার হাজার মানুষ ঢাকা ছাড়ছেন। বাস-ট্রেনে এক সিট খালি রেখে চলাচলের নির্দেশনাও অধিকাংশ পরিবহনে কার্যকর হচ্ছে না। স্বাভাবিক সময়ের মতোই গাদাগাদি করে গ্রামে ফিরছে মানুষ। এ যাত্রার মধ্যে বিষাদের ছায়া দেখছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের অভিমত, নূ্যনতম স্বাস্থ্যবিধি না মেনে দলবেঁধে লাখ লাখ মানুষ গ্রামে যাচ্ছেন। এতে ঈদ উৎসব বিষাদে পরিণত হতে পারে। উচ্চ সংক্রমণের মধ্যে এ ধরনের চলাচলে সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়বে। তখন হাসপাতালেও শয্যা পাওয়া হয়তো কঠিন হয়ে পড়বে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম সমকালকে বলেন, ঈদকে কেন্দ্র করে জনসমাগম ও মানুষের চলাচল যেভাবে বেড়েছে তাতে আমরা শঙ্কিত। ঢাকা ছেড়ে যাওয়া লাখ লাখ মানুষ আবার দলবেঁধে ফিরে আসবেন। তখন করোনার সংক্রমণ বাড়ে কি-না তা নিয়ে আমরা চিন্তিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। ভারতের সংক্রমণের ভয়াবহতা আমরা লক্ষ্য করেছি। সুতরাং সবার প্রতি আহ্বান থাকবে, আপনারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন, মাস্ক ব্যবহার করুন।
কাল ঈদ :বাংলাদেশে গত ১১ জুলাই জিলহজ মাসের চাঁদ দেখা যায়। ওই দিনই নির্ধারিত হয়ে যায় ২১ জুলাই, ১০ জিলহজ ঈদুল আজহা। ইসলাম ধর্মমতে, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য হজরত ইবরাহিম (আ.) তার ছেলে হজরত ইসমাইলকে (আ.) কোরবানি করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু আল্লাহর কৃপায় হজরত ইসমাইল (আ.)-এর পরিবর্তে একটি দুম্বা কোরবানি হয়ে যায়। সেই ত্যাগের মহিমার কথা স্মরণ করে মুসলিম সম্প্রদায় জিলহজ মাসের ১০ তারিখে পশু কোরবানি করে থাকে। উদ্দেশ্য আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ করা। এই ঈদের পর দুই দিন পর্যন্ত (১১ ও ১২ জিলহজ) পশু কোরবানি করার বিধান রয়েছে।
পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা বাণী দিয়েছেন। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতারসহ বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো ঈদ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করবে। ঈদের দিন সরকারিভাবে হাসপাতাল, কারাগার, এতিমখানা ও শিশু সদনে উন্নত ও বিশেষ খাবার পরিবেশন করা হবে।
ঈদযাত্রা সংক্রমণ বাড়ায় :গত বছরের ৮ মার্চ দেশে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এরপর ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। সরকারি-বেসরকারি অফিস, আদালতসহ গণপরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ রাখা হয়েছিল। ক্রমেই সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়তে থাকে। প্রথমে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী ও মাদারীপুর থেকে ধাপে ধাপে বিস্তার ঘটিয়ে সারাদেশে রোগটি ছড়িয়ে পড়ে। গত বছরের মে মাসের শেষ সপ্তাহে ঈদ কেন্দ্র করে হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করে। এরপর জুন-জুলাই মাসে সর্বোচ্চ আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এজন্য ঈদযাত্রাকে দায়ী করা হয়। কারণ, দূরপাল্লার পরিবহন, লঞ্চ ও ট্রেন বন্ধ থাকার পরও মানুষের ঈদযাত্রা ঠেকানো যায়নি। অ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেটকার, পিকআপ ভ্যানে বিকল্প পথে গাদাগাদি করে গ্রামে ছুটেছিলেন হাজার হাজার মানুষ। এরপর সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে গ্রামেও। চলতি বছর মে মাসের ঈদযাত্রাকে কেন্দ্র করে সংক্রমণ ও মৃত্যু বৃদ্ধির আশঙ্কা করে বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, জুন মাসে সংক্রমণ ও মৃত্যু আবারও বাড়বে। ওই ঈদযাত্রা ঠেকাতে দূরপাল্লার পরিবহন বন্ধ রাখা হয়েছিল। তবে চালু রাখা হয়েছিল আন্তঃজেলা পরিবহন ব্যবস্থা। এ সময় হাজার হাজার মানুষ গ্রামে আসা-যাওয়া করেন। এর মধ্যেই মে মাসের মধ্যভাগ থেকে সংক্রমণপ্রবণ ভারতীয় ধরন ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা সত্য প্রমাণ করে মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকেই সংক্রমণ ও মৃত্যু আবারও বাড়তে থাকে। জুন মাসে দেড় লাখের ওপরে শনাক্ত হয়। মৃত্যুবরণ করেন প্রায় দুই হাজারের মতো মানুষ। জুলাই মাসের ১৯ দিনে দুই লাখ ৪ হাজার ৫২ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। গড়ে প্রতিদিন শনাক্ত হয়েছে ১০ হাজার ৭৪০ জন করে রোগী। একই সময়ে মৃত্যুবরণ করেন ৩ হাজার ৬২২ জন। গড়ে প্রতিদিন ১৯১ জনের মৃত্যু হয়েছে। ঊর্ধ্বমুখী এ সংক্রমণের মধ্যে এলো পবিত্র ঈদুল আজহা। এ উপলক্ষে গত ১৫ জুলাই থেকে আরোপিত কঠোর বিধিনিষেধ শিথিলের ঘোষণা দেয় সরকার। এরপরই অবাধে চলাচল শুরু হয়। রাজধানী থেকে শুরু করে সারাদেশে বসেছে পশুর হাট। এ অবস্থায় আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্যবিধির ওপর গুরুত্ব চান বিশেষজ্ঞরা :বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, দেশে করোনা সংক্রমণের পর এ পর্যন্ত তিনটি ঈদ উৎসব উদযাপিত হয়েছে। আরেকটি সমাগত। কিন্তু একটি ঈদেও মানুষকে যার যার স্থানে রাখা যায়নি। গত তিনটি ঈদে চেষ্টা করা হলেও সফলতা আসেনি। মানুষকে আটকে রাখতে গণপরিবহন, লঞ্চ ও ট্রেন সার্ভিস বন্ধ রাখা হয়। কিন্তু মানুষ মাইক্রোবাস, পিকআপ, প্রাইভেটকার, ট্রাকে করে দলবেঁধে বাড়ি ফিরেছেন। এর পরই সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়েছিল। এবার সবকিছু খুলে স্বাভাবিক রাখা হয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি না মেনে মানুষ যেভাবে বাড়ি যাচ্ছেন, তা আতঙ্কের। এতে করে সংক্রমণ ও মৃত্যু আরও বাড়তে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ সমকালকে বলেন, বিধিনিষেধ শিথিলের পর মানুষ যেভাবে গাদাগাদি করে বাড়ি যাচ্ছে, তাতে সংক্রমণ ও মৃত্যু আরও বাড়বে- এটি নিশ্চিত করে বলা যায়। করোনার সংক্রমণ এখন ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। এ অবস্থায় প্রয়োজন ছিল কঠোর লকডাউনের। কিন্তু সেটি না করে উল্টো শিথিল করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে হাসপাতালের প্রায় ৮০ শতাংশ শয্যা পূর্ণ হয়ে গেছে। রোগী আরও বাড়লে হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ থাকবে না। সব মিলিয়ে এক বিপর্যস্ত অবস্থা তৈরি হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ সমকালকে বলেন, কঠোর বিধিনিষেধে সংক্রমণ ও মৃত্যু কমে- এটি প্রমাণিত। কিন্তু ঈদকে কেন্দ্র করে বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়েছে। এটি না করে উপায়ও ছিল না। কারণ শুধু জনস্বাস্থ্যের বিষয় বিবেচনায় নিলে চলবে না। তবে এখন লক্ষ্য হওয়া উচিত ঈদযাত্রা নিরুৎসাহিত করা। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া সবার প্রতি আহ্বান থাকবে, যে যেখানে আছেন সেখানেই ঈদ করুন। নিজেকে ও পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ রাখতে এটি মেনে চলতে হবে। আর অধিক প্রয়োজন হলে গ্রামে গেলেও পুরোপুরি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। মাস্ক ব্যবহার করুন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সমকালকে বলেন, সরকারকে জীবন-জীবিকার সমন্বয় করে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। কঠোর বিধিনিষেধ অব্যাহত থাকলে হয়তো সংক্রমণ ও মৃত্যু কমে আসত। কিন্তু ঈদকে সামনে রেখে সেটি অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়নি। কিন্তু লক্ষ্য করছি, মানুষ চলচলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে না। অধিকাংশ গাদাগাদি করে লঞ্চ, বাস ও ট্রেনে বাড়ি যাচ্ছেন। অনেকের মুখে মাস্কও নেই। পশুর হাটেও একই চিত্র। এটি উদ্বেগের।
তিনি বলেন, সবার প্রতি আহ্বান থাকবে, অত্যন্ত প্রয়োজন না হলে ঘরেই থাকুন। গ্রামে পরিবারের সঙ্গে ঈদের আনন্দ করতে গিয়ে নিজেকে ও স্বজনদের ঝুঁকিতে ফেলবেন না। উৎসব যেন বিষাদের কারণ না হয়।
মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধি :বতর্মান করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, স্থানীয় পরিস্থিতি ও মুসল্লিদের জীবন-ঝুঁকি বিবেচনা করে স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনা ও সমন্বয় করে যথোপযুক্ত বিবেচিত হলে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ কর্তৃক জারিকৃত স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে ঈদুল আজহার জামাত মসজিদ, ঈদগাহ বা খোলা জায়গায় আয়োজনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।
মসজিদে ঈদের নামাজ আয়োজনের ক্ষেত্রে কার্পেট বিছানো যাবে না। নামাজের আগে সম্পূর্ণ মসজিদ জীবাণুনাশক দিয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। মুসল্লিরা প্রত্যেকে নিজ নিজ দায়িত্বে জায়নামাজ নিয়ে আসবেন। প্রত্যেককে নিজ নিজ বাসা থেকে ওজু করে মসজিদ/ঈদগাহে আসতে হবে এবং ওজু করার সময় কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড সাবান-পানি দিয়ে হাত ধুতে হবে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধ নিশ্চিতকল্পে মসজিদ/ঈদগাহে ওজুর স্থানে সাবান, পানি ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখতে হবে। মসজিদ/ঈদগাহ মাঠের প্রবেশদ্বারে হ্যান্ড স্যানিটাইজার/হাত ধোয়ার ব্যবস্থাসহ সাবান ও পানি রাখতে হবে।
ঈদের নামাজের জামাতে আগত মুসল্লিকে অবশ্যই মাস্ক পরে আসতে হবে। মসজিদে সংরক্ষিত জায়নামাজ ও টুপি ব্যবহার করা যাবে না। ঈদের নামাজ আদায়ের সময় কাতারে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি অবশ্যই অনুসরণ করে দাঁড়াতে হবে এবং এক কাতার অন্তর অন্তর কাতার করতে হবে। এতে শিশু, বয়োবৃদ্ধ, অসুস্থ ব্যক্তি এবং অসুস্থদের সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের ঈদের নামাজের জামাতে অংশগ্রহণ নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এ ছাড়া, ঈদের জামাত শেষে কোলাকুলি এবং পরস্পর হাত মেলানো পরিহার করতে হবে।
প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের মধ্যেও ঝুঁকি নিয়ে লাখ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়ছেন। গত ১৫ ও ১৬ জুলাই দুই দিনে ৭০ লাখ মোবাইল সিম ব্যবহারকারী ঢাকা ছেড়েছেন। একজনের দুটি করে সিম হলেও দুই দিনে ৩৫ লাখ মানুষ ঢাকা ছেড়েছেন। পরবর্তী দুই দিনে আরও বেশি মানুষ ঢাকা ছাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে ঈদ উপলক্ষে এক কোটির মতো মানুষ ঢাকা ছাড়বেন।
মানুষের উৎসবমুখর গৃহযাত্রার মধ্যেই গতকাল করোনায় ২৩১ জনের মৃত্যুর খবর এসেছে। শনাক্ত হয়েছেন ১৩ হাজারের বেশি মানুষ। এরপরও দলবেঁধে হাজার হাজার মানুষ ঢাকা ছাড়ছেন। বাস-ট্রেনে এক সিট খালি রেখে চলাচলের নির্দেশনাও অধিকাংশ পরিবহনে কার্যকর হচ্ছে না। স্বাভাবিক সময়ের মতোই গাদাগাদি করে গ্রামে ফিরছে মানুষ। এ যাত্রার মধ্যে বিষাদের ছায়া দেখছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের অভিমত, নূ্যনতম স্বাস্থ্যবিধি না মেনে দলবেঁধে লাখ লাখ মানুষ গ্রামে যাচ্ছেন। এতে ঈদ উৎসব বিষাদে পরিণত হতে পারে। উচ্চ সংক্রমণের মধ্যে এ ধরনের চলাচলে সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়বে। তখন হাসপাতালেও শয্যা পাওয়া হয়তো কঠিন হয়ে পড়বে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম সমকালকে বলেন, ঈদকে কেন্দ্র করে জনসমাগম ও মানুষের চলাচল যেভাবে বেড়েছে তাতে আমরা শঙ্কিত। ঢাকা ছেড়ে যাওয়া লাখ লাখ মানুষ আবার দলবেঁধে ফিরে আসবেন। তখন করোনার সংক্রমণ বাড়ে কি-না তা নিয়ে আমরা চিন্তিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। ভারতের সংক্রমণের ভয়াবহতা আমরা লক্ষ্য করেছি। সুতরাং সবার প্রতি আহ্বান থাকবে, আপনারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন, মাস্ক ব্যবহার করুন।
কাল ঈদ :বাংলাদেশে গত ১১ জুলাই জিলহজ মাসের চাঁদ দেখা যায়। ওই দিনই নির্ধারিত হয়ে যায় ২১ জুলাই, ১০ জিলহজ ঈদুল আজহা। ইসলাম ধর্মমতে, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য হজরত ইবরাহিম (আ.) তার ছেলে হজরত ইসমাইলকে (আ.) কোরবানি করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু আল্লাহর কৃপায় হজরত ইসমাইল (আ.)-এর পরিবর্তে একটি দুম্বা কোরবানি হয়ে যায়। সেই ত্যাগের মহিমার কথা স্মরণ করে মুসলিম সম্প্রদায় জিলহজ মাসের ১০ তারিখে পশু কোরবানি করে থাকে। উদ্দেশ্য আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ করা। এই ঈদের পর দুই দিন পর্যন্ত (১১ ও ১২ জিলহজ) পশু কোরবানি করার বিধান রয়েছে।
পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা বাণী দিয়েছেন। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতারসহ বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো ঈদ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করবে। ঈদের দিন সরকারিভাবে হাসপাতাল, কারাগার, এতিমখানা ও শিশু সদনে উন্নত ও বিশেষ খাবার পরিবেশন করা হবে।
ঈদযাত্রা সংক্রমণ বাড়ায় :গত বছরের ৮ মার্চ দেশে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এরপর ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। সরকারি-বেসরকারি অফিস, আদালতসহ গণপরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ রাখা হয়েছিল। ক্রমেই সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়তে থাকে। প্রথমে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী ও মাদারীপুর থেকে ধাপে ধাপে বিস্তার ঘটিয়ে সারাদেশে রোগটি ছড়িয়ে পড়ে। গত বছরের মে মাসের শেষ সপ্তাহে ঈদ কেন্দ্র করে হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করে। এরপর জুন-জুলাই মাসে সর্বোচ্চ আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এজন্য ঈদযাত্রাকে দায়ী করা হয়। কারণ, দূরপাল্লার পরিবহন, লঞ্চ ও ট্রেন বন্ধ থাকার পরও মানুষের ঈদযাত্রা ঠেকানো যায়নি। অ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেটকার, পিকআপ ভ্যানে বিকল্প পথে গাদাগাদি করে গ্রামে ছুটেছিলেন হাজার হাজার মানুষ। এরপর সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে গ্রামেও। চলতি বছর মে মাসের ঈদযাত্রাকে কেন্দ্র করে সংক্রমণ ও মৃত্যু বৃদ্ধির আশঙ্কা করে বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, জুন মাসে সংক্রমণ ও মৃত্যু আবারও বাড়বে। ওই ঈদযাত্রা ঠেকাতে দূরপাল্লার পরিবহন বন্ধ রাখা হয়েছিল। তবে চালু রাখা হয়েছিল আন্তঃজেলা পরিবহন ব্যবস্থা। এ সময় হাজার হাজার মানুষ গ্রামে আসা-যাওয়া করেন। এর মধ্যেই মে মাসের মধ্যভাগ থেকে সংক্রমণপ্রবণ ভারতীয় ধরন ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা সত্য প্রমাণ করে মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকেই সংক্রমণ ও মৃত্যু আবারও বাড়তে থাকে। জুন মাসে দেড় লাখের ওপরে শনাক্ত হয়। মৃত্যুবরণ করেন প্রায় দুই হাজারের মতো মানুষ। জুলাই মাসের ১৯ দিনে দুই লাখ ৪ হাজার ৫২ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। গড়ে প্রতিদিন শনাক্ত হয়েছে ১০ হাজার ৭৪০ জন করে রোগী। একই সময়ে মৃত্যুবরণ করেন ৩ হাজার ৬২২ জন। গড়ে প্রতিদিন ১৯১ জনের মৃত্যু হয়েছে। ঊর্ধ্বমুখী এ সংক্রমণের মধ্যে এলো পবিত্র ঈদুল আজহা। এ উপলক্ষে গত ১৫ জুলাই থেকে আরোপিত কঠোর বিধিনিষেধ শিথিলের ঘোষণা দেয় সরকার। এরপরই অবাধে চলাচল শুরু হয়। রাজধানী থেকে শুরু করে সারাদেশে বসেছে পশুর হাট। এ অবস্থায় আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্যবিধির ওপর গুরুত্ব চান বিশেষজ্ঞরা :বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, দেশে করোনা সংক্রমণের পর এ পর্যন্ত তিনটি ঈদ উৎসব উদযাপিত হয়েছে। আরেকটি সমাগত। কিন্তু একটি ঈদেও মানুষকে যার যার স্থানে রাখা যায়নি। গত তিনটি ঈদে চেষ্টা করা হলেও সফলতা আসেনি। মানুষকে আটকে রাখতে গণপরিবহন, লঞ্চ ও ট্রেন সার্ভিস বন্ধ রাখা হয়। কিন্তু মানুষ মাইক্রোবাস, পিকআপ, প্রাইভেটকার, ট্রাকে করে দলবেঁধে বাড়ি ফিরেছেন। এর পরই সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়েছিল। এবার সবকিছু খুলে স্বাভাবিক রাখা হয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি না মেনে মানুষ যেভাবে বাড়ি যাচ্ছেন, তা আতঙ্কের। এতে করে সংক্রমণ ও মৃত্যু আরও বাড়তে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ সমকালকে বলেন, বিধিনিষেধ শিথিলের পর মানুষ যেভাবে গাদাগাদি করে বাড়ি যাচ্ছে, তাতে সংক্রমণ ও মৃত্যু আরও বাড়বে- এটি নিশ্চিত করে বলা যায়। করোনার সংক্রমণ এখন ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। এ অবস্থায় প্রয়োজন ছিল কঠোর লকডাউনের। কিন্তু সেটি না করে উল্টো শিথিল করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে হাসপাতালের প্রায় ৮০ শতাংশ শয্যা পূর্ণ হয়ে গেছে। রোগী আরও বাড়লে হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ থাকবে না। সব মিলিয়ে এক বিপর্যস্ত অবস্থা তৈরি হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ সমকালকে বলেন, কঠোর বিধিনিষেধে সংক্রমণ ও মৃত্যু কমে- এটি প্রমাণিত। কিন্তু ঈদকে কেন্দ্র করে বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়েছে। এটি না করে উপায়ও ছিল না। কারণ শুধু জনস্বাস্থ্যের বিষয় বিবেচনায় নিলে চলবে না। তবে এখন লক্ষ্য হওয়া উচিত ঈদযাত্রা নিরুৎসাহিত করা। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া সবার প্রতি আহ্বান থাকবে, যে যেখানে আছেন সেখানেই ঈদ করুন। নিজেকে ও পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ রাখতে এটি মেনে চলতে হবে। আর অধিক প্রয়োজন হলে গ্রামে গেলেও পুরোপুরি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। মাস্ক ব্যবহার করুন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সমকালকে বলেন, সরকারকে জীবন-জীবিকার সমন্বয় করে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। কঠোর বিধিনিষেধ অব্যাহত থাকলে হয়তো সংক্রমণ ও মৃত্যু কমে আসত। কিন্তু ঈদকে সামনে রেখে সেটি অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়নি। কিন্তু লক্ষ্য করছি, মানুষ চলচলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে না। অধিকাংশ গাদাগাদি করে লঞ্চ, বাস ও ট্রেনে বাড়ি যাচ্ছেন। অনেকের মুখে মাস্কও নেই। পশুর হাটেও একই চিত্র। এটি উদ্বেগের।
তিনি বলেন, সবার প্রতি আহ্বান থাকবে, অত্যন্ত প্রয়োজন না হলে ঘরেই থাকুন। গ্রামে পরিবারের সঙ্গে ঈদের আনন্দ করতে গিয়ে নিজেকে ও স্বজনদের ঝুঁকিতে ফেলবেন না। উৎসব যেন বিষাদের কারণ না হয়।
মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধি :বতর্মান করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, স্থানীয় পরিস্থিতি ও মুসল্লিদের জীবন-ঝুঁকি বিবেচনা করে স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনা ও সমন্বয় করে যথোপযুক্ত বিবেচিত হলে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ কর্তৃক জারিকৃত স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে ঈদুল আজহার জামাত মসজিদ, ঈদগাহ বা খোলা জায়গায় আয়োজনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।
মসজিদে ঈদের নামাজ আয়োজনের ক্ষেত্রে কার্পেট বিছানো যাবে না। নামাজের আগে সম্পূর্ণ মসজিদ জীবাণুনাশক দিয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে। মুসল্লিরা প্রত্যেকে নিজ নিজ দায়িত্বে জায়নামাজ নিয়ে আসবেন। প্রত্যেককে নিজ নিজ বাসা থেকে ওজু করে মসজিদ/ঈদগাহে আসতে হবে এবং ওজু করার সময় কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড সাবান-পানি দিয়ে হাত ধুতে হবে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধ নিশ্চিতকল্পে মসজিদ/ঈদগাহে ওজুর স্থানে সাবান, পানি ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখতে হবে। মসজিদ/ঈদগাহ মাঠের প্রবেশদ্বারে হ্যান্ড স্যানিটাইজার/হাত ধোয়ার ব্যবস্থাসহ সাবান ও পানি রাখতে হবে।
ঈদের নামাজের জামাতে আগত মুসল্লিকে অবশ্যই মাস্ক পরে আসতে হবে। মসজিদে সংরক্ষিত জায়নামাজ ও টুপি ব্যবহার করা যাবে না। ঈদের নামাজ আদায়ের সময় কাতারে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি অবশ্যই অনুসরণ করে দাঁড়াতে হবে এবং এক কাতার অন্তর অন্তর কাতার করতে হবে। এতে শিশু, বয়োবৃদ্ধ, অসুস্থ ব্যক্তি এবং অসুস্থদের সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের ঈদের নামাজের জামাতে অংশগ্রহণ নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এ ছাড়া, ঈদের জামাত শেষে কোলাকুলি এবং পরস্পর হাত মেলানো পরিহার করতে হবে।