ঢাকা মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫

বন-পাহাড়ের দেশে

সোনিয়ার জটায় শিব

সোনিয়ার জটায় শিব

নিজ জাতির শিল্প ও সংগীতকেও পরের প্রজন্মের জন্য রেখে যাওয়ার চেষ্টা করছেন সোনিয়া- লেখক

ফারহা তানজীম তিতিল

প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০২৩ | ১৫:২৯

সোনিয়া কড়ার জটায় শিল্পিত সৌন্দর্য আছে কিনা জানি না, তবে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। দৃষ্টি এবং মনোযোগ আটকে রাখে সেই জটা। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, 'যাকে দেখে আবার ফিরিয়া চাহিতে মন চায়, সেই সুন্দর।' সুন্দরের এমন ব্যাখ্যা মেনে নিলে সোনিয়াও সুন্দর। তার জটা, তার ব্যক্তিত্ব, তার গান- সব সুন্দর।
সোনিয়া কড়া নিজেকে সোনিয়া গান্ধী বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। অবশ্য গান্ধী বলে পরিচয় দিতে চাওয়ার মধ্যে একটু রসিকতাও আছে।
বিরল জটাধারী এই নারীকে দেখতে হলে যেতে হবে দিনাজপুরের বিরল উপজেলার হালজায় মৌজার ঝিনাইকুড়ি গ্রামে। এ গ্রামেই বাস করে বাংলাদেশের কড়া আদিবাসীদের শেষ ২৪ পরিবার। ঝিনাইকুড়ির ছেলে লাপোল কড়ার সঙ্গে একটা যোগাযোগ আগে থেকেই ছিল। সোনিয়া লাপোলের নানি হন সম্পর্কে। তিনি জ্ঞানী, তিনি বিদুষী এবং নিজের জাতির ক্ষয়ক্ষতি তার হৃদয়ে ক্ষরণ আনে।
সোনিয়ার দাবি, এক রাতে শিব ভর করেছিল তার ওপর। ফলে শিবের মতো জটাধারী হয়ে গেছেন তিনি। মাত্র এক রাতে কারও চুলে এমন জটা হতে পারে কি? যুক্তি, না বিশ্বাস- সেই দ্বন্দ্ব্বের উত্তর প্রত্যেকের কাছে ভিন্ন ভঙ্গিতে দেখা দেয়। শিবের ভর করা নিয়ে আমার কৌতূহল আছে। তার চেয়েও বেশি কৌতূহল হলো সোনিয়া কড়ার জীবন নিয়ে। আরও বেশি উদ্বেগ আছে ২৪ পরিবার কড়া আদিবাসী নিয়ে। সংখ্যাও তো টিকে থাকার একটা উপাদান।
শিব সনাতন হিন্দুদের ত্রিমূর্তির একজন। কড়া আদিবাসী এক নারী সোনিয়া কেমন করে নিজের মধ্যে শিবকে পেলেন- প্রথমে এমন ভাবনা এলেও মনে পড়ল, শিব আসলে অনার্যের দেবতা। অনার্যকে জয় করার জন্য যেমন মনসাকে পূজা দিয়েছে আর্যরা, প্রয়োজন হয়েছে বেহুলা-লখিন্দরের উপাখ্যান রচনার, তেমনি শিবকে বসিয়েছে অন্যতম প্রধান দেবতার আসনে, নির্মাণ করেছে ত্রিমূর্তি ব্রহ্মা-বিষুষ্ণ-মহেশ্বর। যে শিব, সে-ই মহেশ্বর। শিব ছিল অনার্যদের প্রধান দেবতা। আর্যশাস্ত্র বেদে শিবের কথা নেই বোধ হয়। বেদের উল্লেখযোগ্য দেবতারা হলো- অগ্নি, বরুণ, মিত্র, মরুৎগণ, বৃহস্পতি, পুষণ, রুদ্র ও বিষুষ্ণ। হাল আমলে উপমহাদেশে বেদবর্ণিত এই দেবতাদের মধ্যে বিষুষ্ণ ছাড়া আর কেউ পূজা পায় না বললেই চলে। বিষুষ্ণ টিকে রয়েছে অবতার-তত্ত্বের মাধ্যমে, পরশুরাম, রাম, কৃষ্ণ এবং গৌতম বুদ্ধও তার অবতার। বুদ্ধ যে বিষুষ্ণর অবতার, তা-ও হিন্দু আধিপত্যের ধর্মীয় প্রকাশ। গৌতম বুদ্ধ নিজে অবতারত্বকে অস্বীকার করেছিলেন বলে মনে করা হয়। বৈদিক জ্ঞানের প্রতি ছিল বুদ্ধের অবজ্ঞা। যে হিন্দুশাস্ত্রে বৌদ্ধ ধর্মকে আসুরিক ধর্ম হিসেবে দেখানো হয়েছে, সে শাস্ত্রই বুদ্ধকে অবতারে রূপান্তরিত করেছে। বাংলায় পাল ও সেন আমলের ইতিহাস ঘাঁটলেও তা বোঝা যায়। পাল রাজারা মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও তারা যে পৌরাণিক হিন্দু ধর্মের দেবদেবীদের বিগ্রহ ও মূর্তি তৈরি করেন, এমন শিল্পীদেরও পৃষ্ঠপোষকতা করতেন, তার অজস্র প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ মেলে। দাক্ষিণাত্য থেকে আসা সেন রাজারা ছিলেন বৈদিক-ব্রাহ্মণ, বর্ণাশ্রয়ী হিন্দু ধর্মের পরিপোষক। তাদের আমলে বাংলার বৌদ্ধরা নিগৃহীত হয়ে নেপাল ও তিব্বতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। হয়তো নিপীড়িত-বাস্তুচ্যুত সেই বৌদ্ধদের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদও চলে যায় নেপালে। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী শিল্পীদের সঙ্গে পূর্ব ভারতীয় চিত্রকৌশলও নেপালে ছড়িয়ে পড়ে, তা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত।
বুদ্ধের আবির্ভাবের বহুকাল আগে শিব পূজিত হয়ে আসছে। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তার 'ধর্ম ও সংস্কৃতি :প্রাচীন ভারতীয় প্রেক্ষাপট' বইয়ে লিখেছেন, 'মোহেঞ্জোদারোতে প্রাপ্ত একটি সীলে ত্রিমুখ, দ্বিশৃঙ্গ, যোগাসনে উপবিষ্ট ও পশুবেষ্টিত যে মূর্তিটি অঙ্কিত দেখা যায়, সেটিকে পৌরাণিক শিব পশুপতির আদিরূপ হিসাবে অনুমান করা হয়।' ২৬০০ খ্রিষ্টপূর্বের সিন্ধু সভ্যতার সমৃদ্ধ নগরগুলো দ্রাবিড় জাতিরই বিস্ময়কর কীর্তি। পরবর্তীকালে যে নগরগুলো যাযাবর আর্যরা ধ্বংস করে দিয়েছিল। প্রাচীন ভারতে আর্যদের আগমনের সময়কাল খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে।
কেবল উন্নত নগর নির্মাণই নয়, দ্রাবিড় জাতির ধর্মীয় চেতনাও ছিল রহস্যময় আধ্যাত্মিকতায় আচ্ছন্ন। তাদের সাধন মার্গ ছিল যোগ। দেবদেবীর কল্পনাতেও তারা সূক্ষ্ণ ধর্মবোধের পরিচয় দিয়েছে। তাদের প্রধান দেবতা শিব।
বেদে অনার্য শিবের কথা নেই, থাকবার কথাও নয়। অনেকে অবশ্য বৈদিক দেবতা রুদ্রকে শিবের সঙ্গে তুলনা করে। সে যাই হোক, পরবর্তী সময়ে শিব আর্য দেবম পে গুরুত্বপূর্ণ স্থান পায়। যদিও সেটা সহজে হয়নি। দীর্ঘকালীন আর্য-অনার্য ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রবল ঘাত-প্রতিঘাতে শিবের স্থান হয়েছে। বর্তমানে হিন্দুদের প্রধান চারটি ভাগের একটি শৈব। শৈবরা শিবকে একমাত্র সর্বোচ্চ ঈশ্বর বলে মনে করে; এই শৈব ধর্মের অনুসারীরা ভগবান শিবকেই স্রষ্টা, পালনকর্তা, ধ্বংসকর্তা, সব বস্তুর প্রকাশ ও ব্রহ্মস্বরূপ হিসেবে পূজা করে থাকে।
আদিবাসীদের মধ্যে শৈব ধর্মের অনুসারী আছে কিনা জানতে হবে আমার। লাপোল জানাল, বছর বিশেক আগে ওদের ঝিনাইকুড়ি গ্রামের এক ব্যক্তি স্বপ্নে দেখলেন, তাদের শিব পূজা করতে হবে। এই স্বপ্নাদেশ কি জিনবাহিত, নাকি সচেতন ভাবনার অচেতন প্রকাশ? সোনিয়া কড়াও এমন স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে জটা রেখে দিয়েছেন। কিন্তু লাপোলের মা সাতোল কড়া স্বপ্নাদেশ উপেক্ষা করেছেন। মাথা ন্যাড়া করে জটা হতে শুরু করা চুল স্বাভাবিক রেখেছেন। কারণ, সাতোল কড়ার ভূতটা নাকি দুষ্টু ছিল। সে বলেছিল, সাতোল কড়ার পরিবারে সে অনেক সম্পদ এনে দেবে, কিন্তু তার বড় ছেলে সাপোলকে নিয়ে যাবে। মা হয়ে সেই প্রস্তাবে রাজি হননি সাতোল। সে জন্য তিনি জটা কেটে দিলেন, মাথা ন্যাড়া করে। কথাবার্তা বলে মনে হলো, সোনিয়ার ভূতটা ভালো। সোনিয়াকে সে শান্তি, সমৃদ্ধি আনতে এবং বিদ্যাচর্চা করতে সাহায্য করেছে। সোনিয়ার সমৃদ্ধি মানে যদিও কেবল মোটা ভাত, মোটা কাপড়। কিন্তু তার আত্মবিশ্বাস এবং বিদ্যাবুদ্ধিকে খুব সাদামাটাভাবে দেখার সুযোগ নেই। কড়া জাতির ধর্ম-সম্পর্কিত জ্ঞান, চিকিৎসাচর্চা সবেতেই আছেন সোনিয়া কড়া। তা ছাড়া গ্রামের ছেলেমেয়েদের তিনি নাচ-গান শেখান। তাকে গুরুমাতা বললে বেশি বলা হবে না। গানের গলাটিও ভারি মিঠে তার। ২৪ পরিবারের গ্রামটিতে খাবার জোটাতে না পারলেও ভরসার জোগান দেন তিনি। তার কবিরাজি চিকিৎসার কথা ভাবতে গিয়ে সত্যজিৎ রায়ের 'আগন্তুক' চলচ্চিত্র নিয়ে কফিল আহমেদের মন্তব্য মনে পড়ল। করোনাকাল এবং লোকায়ত চিকিৎসা নিয়ে মন্তব্যটি করেছিলেন তিনি- 'বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটা আন্তর্জাতিক সংস্থা। নিশ্চয় তার মতামত, পরামর্শের গুরুত্ব আছে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, পৃথিবীতে মানুষের বাঁচা-মরার ইতিহাস, পৃথিবীর চিকিৎসাশাস্ত্রের ইতিহাস তো আর এই একটি সংস্থার ইতিহাস না। ভুলে গেলে চলবে না, চিকিৎসাশাস্ত্রের বড় আবিস্কারগুলো যুগে যুগে মানুষের আরাধ্য সাধনারই ফল! একটি সংস্থার ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেলে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনেক সম্ভাবনাই স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার কথা যে! সে জন্যই কথা কয়টা বলছিলাম। কিউবার কথা মনে আসছে, কিউবা কিংবা আরও অনেক দেশের আবিস্কার বা দক্ষতা কি এই স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনের অপেক্ষায় ছিল? পৃথিবীর চিকিৎসাবিজ্ঞান আর মানুষের বাঁচা-মরার ইতিহাস কী কথা বলে আমাদের?'
প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসাবিজ্ঞান অনেকদূর পৌঁছালেও আর সবকিছুর মতো চিকিৎসাও বাজারের পণ্য। সবাই সেই পণ্য কিনতে সক্ষম নন। আবুল বারকাত গবেষণা করে দেখিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশে প্রতিবছর ৫০ হাজার পরিবার চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে মধ্যবিত্ত থেকে নিম্ন-মধ্যবিত্তে পরিণত হচ্ছে। নিম্নবিত্ত এবং প্রান্তিক একটি জাতির মানুষের জন্য সোনিয়া কড়ারাই ভরসা। সোনিয়ার ঝাড়ফুঁক ও ভেষজ চিকিৎসাকে বাতিল না করে, তাদের চিকিৎসাকে আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার আগের ধাপ হিসেবে দেখতে চাই আমি। কখনও কখনও যদিও হাসপাতালের চেয়ে হার্ড ইমিউনিটি বেশি কাজে লাগে। আমি বরং বাতিল ও বিচ্ছিন্নতার বদলে সংযোগ এবং সমন্বয়ের পথ খোঁজার পক্ষে। সোনিয়া নিজের জাতির শিল্প এবং সংগীতকেও পরের প্রজন্মের কাছে রেখে যেতে চেষ্টা করছেন। আমরা তো জানি, সংস্কৃতি হারিয়ে গেলে শরীর থাকলেও হৃদয় বেঁচে থাকে না একটা জাতির। সোনিয়ার জটা ধরেই শিব এবং সমৃদ্ধি আসুক কড়াদের জীবনে।
সোনিয়া কড়াকে নিয়ে মাসুদুল হকের একটা কবিতা পড়েছিলাম ঝিনাইকুড়ি যাওয়ার বেশ আগে, সেটাই মনে পড়ল আবার- 'ভাদ্রের পূর্ণিমায় সোনিয়া কড়া গাঁওরাখ?ওয়াল পুজো দিয়ে উঠতেই পাখির ডানায় মৃত্যু/ উড়ে আসে/ ঘরের পাশে নিমডালে! মৃত্যু। মৃত্যু!/ মৃত্যু ওকে নিয়ে যেতে আসে এক প্যাঁচার মুখোশে!/ সোনিয়া ওর জটা খুলে হেলিকপ্টারের মতো ঘোরায়/ মৃত্যুর ডানায় গেঁথে দেয় রোদ!/ উনুনে চাপায় শামুকের চড়চড়ি/ মৃত্যু, প্যাঁচা আর সোনিয়া কড়ার দাপাদাপিতে/ চড়চড়ির পোড়া গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত কড়াপাড়ায়!'

আরও পড়ুন

×