সচিব পদোন্নতিতেও ডিও
দেলওয়ার হোসেন
প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২১ | ১৪:২৪
কর্মকর্তাদের সচিব হিসেবে পদোন্নতি দিতে আধা-সরকারি চাহিদাপত্র (ডিও লেটার) দিচ্ছেন মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা (এমপি)। এসবের ভিত্তিতে পদোন্নতি এবং চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও হচ্ছে। সম্প্রতি কয়েকজন অতিরিক্ত সচিবকে পদোন্নতি দিয়ে সচিব করার জন্য কয়েকজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও এমপি জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর কাছে চাহিদাপত্র দিয়েছেন। সেইসব পত্র জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী সচিবের কাছে পাঠিয়েছেন। বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর দেওয়া এমন চাহিদাপত্রের অনুলিপি সমকালের হাতে এসেছে।
এসব ডিও লেটার নিয়ে নানামুখী প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্নিষ্টরা। প্রশাসন-সংশ্নিষ্টরা মনে করেন, এসব ডিও লেটার অনাকাঙ্ক্ষিত। এটি আইনবহির্ভূত বলেও উল্লেখ করেছেন অনেকে। তদবির করতে পারেননি এমন কর্মকর্তারা শীর্ষ এই পদে পদোন্নতি থেকে বাদ পড়ছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
মন্ত্রীদের এমন ডিও লেটারে বিস্ময় প্রকাশ করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ও। এমন ঘটনাকে নজিরবিহীন বলে উল্লেখ করেছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। তার মতে, মন্ত্রীদের এমন ডিও লেটার নিয়মবহির্ভূত।
সচিবালয় নির্দেশমালায় বলা হয়েছে, 'সচিব' প্রশাসনিক স্তরের শীর্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ পদ। মন্ত্রণালয় বা বিভাগের কার্যসম্পাদন সম্পর্কে মন্ত্রীকে অবহিত রাখবেন সচিব। বরাদ্দকৃত অর্থ যাতে আইন অনুযায়ী ব্যয় হয়, তা নিশ্চিত করবেন। মন্ত্রীর পর সচিবই হচ্ছেন মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত দপ্তরগুলোর অন্যতম নিয়ন্ত্রক। তিনি তার মন্ত্রণালয় সংযুক্ত দপ্তর ও অধস্তন অফিসগুলোয় কার্যবিধিমালা সতর্কতার সঙ্গে পালনের জন্যও দায়ী থাকবেন।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন সমকালকে বলেন, সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী ডিও নেওয়া নিষিদ্ধ। এটা জেনেও অনেকে তদবির করেন। কারণ, অনেকের আত্মীয়স্বজন থাকে, সে জন্য হয়তো না করতে পারেন না। কিন্তু সংশ্নিষ্ট পদের জন্য উপযুক্ত না হলে কারও অনুরোধে কাজ হয় না। পদায়নের সময় সব বিষয়েই দেখা হয়।
সরকারের উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে পদোন্নতি বিধিমালা ২০০২-এ বলা হয়েছে, অতিরিক্ত সচিব কিংবা সচিব পদে পদোন্নতি প্রদানের ক্ষেত্রে সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তা সমগ্র চাকরিকালে পালনকৃত দায়িত্বের গুরুত্ব ও প্রকৃতি এবং তার ব্যক্তিগত সুনামসহ প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করা হবে। পদোন্নতি প্রদানের ভিত্তি হবে সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তার মেধা, দক্ষতা ও জ্যেষ্ঠতা। মূল্যায়নের জন্য নির্ধারিত ১০০ নম্বরও রয়েছে। সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) এসব মানদণ্ড বিবেচনা করে সচিবসহ অন্যান্য পদে পদোন্নতির সুপারিশ করে। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই সুপারিশ চূড়ান্ত অনুমোদন করেন।
সচিব হিসেবে পদোন্নতিপ্রত্যাশী বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের দশম ব্যাচের কয়েকজন অতিরিক্ত সচিব অভিযোগ করেন, যাদের তদবির নেই, তারা সচিব হতে পারেন না। কারণ, নিয়ম অনুযায়ী এখন পদোন্নতি হয় না। তার বড় প্রমাণ প্রশাসন ক্যাডারের দশম ব্যাচের কর্মকর্তারা। এ ব্যাচের মেধাতালিকায় যারা এগিয়ে আছেন, তারা এখনও পদোন্নতি পাননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, সিভিল সার্ভিসের মধ্যে যে ঐক্যবন্ধন ও ভ্রাতৃত্ববোধ ছিল, তদবিরবাজির কারণে তা নষ্ট হয়ে গেছে। সচিব হয়েছেন, কিন্তু সিনিয়র সচিব হতে পারছেন না- তার জন্যও তদবির! এরপর তদবির করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাচ্ছেন। এভাবে উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পেতে, পদায়ন নিতে, বদলি হতে- সবকিছুতেই চলছে তদবির। সবচেয়ে বেশি তদবির হচ্ছে ভালো জায়গায় পোস্টিং নিতে। এই ভালো জায়গা বলতে বোঝায় ঘুষের জায়গা। বর্তমানে যেখানে আছেন, সেখানে ঘুষ কম। তাই ঘুষ যেখানে বেশি, সেটা তাদের কাঙ্ক্ষিত জায়গা।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার সমকালকে বলেন, পদোন্নতির জন্য রাজনৈতিক নেতাদের কাছে ডিও নেওয়া সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার পরিপন্থি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। রাজনৈতিক নেতারাও এ বিষয়ে তদবির করতে পারেন না।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা সমকালকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী যে কর্মকর্তা সম্পর্কে জানেন, তাকেই সাধারণত সচিব করা হয়। যার সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর ধারণা নেই, তাকে সচিব করা হয় না। তবে অতিরিক্ত সচিবের ২১২টি পদে বর্তমানে কর্মরত আছেন ৪৯৮ কর্মকর্তা। এত সংখ্যক কর্মকর্তার সার্বিক বিষয়ে জানা অনেক কঠিন। তাই কর্মকর্তাদের পদোন্নতির জন্য নির্দিষ্ট বিধান তৈরি করেছে সরকার। বর্তমানে জ্যেষ্ঠ সচিব ও সচিব রয়েছেন ৭৭ জন। এর মধ্যে চারজন সচিবের পদ শূন্য আছে। চলতি মাসের মধ্যে আরও প্রায় ১০ কর্মকর্তা অবসরে যাবেন। বর্তমানে ২৪ জেলায় কোনো সচিব নেই। অথচ বরিশাল ও ঢাকা জেলায় পাঁচজন করে সচিব আছে। কয়েকটি জেলায় তিন থেকে চারজন করে সচিব আছেন।
সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার সমকালকে বলেন, সচিব শতভাগ কাঠামোবদ্ধ পদ। এ পদে পদোন্নতির জন্য চাকরিজীবনের ৩০-৩৫ বছরের কর্মকাণ্ড, সুনাম, সততা ও গোয়েন্দা প্রতিবেদন দেখে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। এ জন্য যদি ডিও লেখা হয়, তাহলে তার অযোগ্যতার প্রমাণ হয়। যদি কেউ মুখেও তদবির করে, সেটাও শিষ্টাচার পরিপন্থি। সিভিল সার্ভিসের ঐতিহ্য ও কাঠামো কি নষ্ট হয়ে গেছে, তাদের মধ্যে যোগ্য লোক নেই? এভাবে তাদের রীতিনীতি নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে।
সম্প্রতি কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত সচিব) নাসির উদ্দিন আহমেদকে সচিব পদে পদোন্নতি দিতে আধা-সরকারি পত্র দিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান। তিনি সমকালকে বলেন, পদোন্নতি নিয়মতান্ত্রিকভাবে হয়। আর সচিব হওয়ার জন্য যে নম্বর লাগে, সেগুলো তার ডিপার্টমেন্ট অনুযায়ী চলে যায়। তারপরও কারও কারও আত্মবিশ্বাস থাকে যে ডিও দিলে বুঝি পদোন্নতিটা হতে পারে।
প্রতিমন্ত্রী দাবি করেন, 'যে কর্মকর্তাকে চিনি, তাকেই শুধু ডিও দিই।'
সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. তরুণ কান্তি শিকদারকে সচিব হিসেবে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য তদবির করেছেন নেত্রকোনা-৩ আসনের এমপি অসীম কুমার উকিল। চাহিদাপত্রের বিষয়ে জানতে চাইলে ড. তরুণ কান্তি শিকদার দাবি করেন, পদোন্নতির জন্য ডিও লেটার নিয়ম পরিপন্থি। আমি ব্যক্তিগতভাবে চাকরিজীবনে কোনোদিন ডিও নিইনি। এ বিষয়ে বলতেও পারব না।'
তবে তিনি বলেন, মন্ত্রী-এমপি যদি পছন্দ করেন তো দিতে পারেন। ডিও তো কিছুই না, এটা একটা অনুরোধপত্র মাত্র।
এ ছাড়া প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবু বকর সিদ্দিককে সচিব পদোন্নতির জন্য আধা-সরকারি পত্র দিয়েছেন ওই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মিজানুল হক চৌধুরী এবং বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়ক কেন্দ্র (বিটাক) মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) আনোয়ার হোসেন চৌধুরীকে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য আধা-সরকারি পত্র দিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।
জানা গেছে, এমপি-মন্ত্রীরা ডিও দেওয়ার পর গত ৭ সেপ্টেম্বর বেশকিছু কর্মকর্তা অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। এ ছাড়া যুগ্ম সচিব পদোন্নতি প্রক্রিয়া শুরু না হলেও অনেক কর্মকর্তা এরই মধ্যে তদবির শুরু করছেন। যদিও সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা-১৯৭৯ অনুযায়ী, কোনো সরকারি কর্মচারী তার পক্ষে হস্তক্ষেপ করার জন্য কোনো অনুরোধ বা প্রস্তাব নিয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো সংসদ সদস্য বা অন্য কোনো বেসরকারি ব্যক্তির দ্বারস্থ হতে পারবেন না।
এসব ডিও লেটার নিয়ে নানামুখী প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্নিষ্টরা। প্রশাসন-সংশ্নিষ্টরা মনে করেন, এসব ডিও লেটার অনাকাঙ্ক্ষিত। এটি আইনবহির্ভূত বলেও উল্লেখ করেছেন অনেকে। তদবির করতে পারেননি এমন কর্মকর্তারা শীর্ষ এই পদে পদোন্নতি থেকে বাদ পড়ছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
মন্ত্রীদের এমন ডিও লেটারে বিস্ময় প্রকাশ করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ও। এমন ঘটনাকে নজিরবিহীন বলে উল্লেখ করেছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। তার মতে, মন্ত্রীদের এমন ডিও লেটার নিয়মবহির্ভূত।
সচিবালয় নির্দেশমালায় বলা হয়েছে, 'সচিব' প্রশাসনিক স্তরের শীর্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ পদ। মন্ত্রণালয় বা বিভাগের কার্যসম্পাদন সম্পর্কে মন্ত্রীকে অবহিত রাখবেন সচিব। বরাদ্দকৃত অর্থ যাতে আইন অনুযায়ী ব্যয় হয়, তা নিশ্চিত করবেন। মন্ত্রীর পর সচিবই হচ্ছেন মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত দপ্তরগুলোর অন্যতম নিয়ন্ত্রক। তিনি তার মন্ত্রণালয় সংযুক্ত দপ্তর ও অধস্তন অফিসগুলোয় কার্যবিধিমালা সতর্কতার সঙ্গে পালনের জন্যও দায়ী থাকবেন।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন সমকালকে বলেন, সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী ডিও নেওয়া নিষিদ্ধ। এটা জেনেও অনেকে তদবির করেন। কারণ, অনেকের আত্মীয়স্বজন থাকে, সে জন্য হয়তো না করতে পারেন না। কিন্তু সংশ্নিষ্ট পদের জন্য উপযুক্ত না হলে কারও অনুরোধে কাজ হয় না। পদায়নের সময় সব বিষয়েই দেখা হয়।
সরকারের উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে পদোন্নতি বিধিমালা ২০০২-এ বলা হয়েছে, অতিরিক্ত সচিব কিংবা সচিব পদে পদোন্নতি প্রদানের ক্ষেত্রে সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তা সমগ্র চাকরিকালে পালনকৃত দায়িত্বের গুরুত্ব ও প্রকৃতি এবং তার ব্যক্তিগত সুনামসহ প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করা হবে। পদোন্নতি প্রদানের ভিত্তি হবে সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তার মেধা, দক্ষতা ও জ্যেষ্ঠতা। মূল্যায়নের জন্য নির্ধারিত ১০০ নম্বরও রয়েছে। সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) এসব মানদণ্ড বিবেচনা করে সচিবসহ অন্যান্য পদে পদোন্নতির সুপারিশ করে। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই সুপারিশ চূড়ান্ত অনুমোদন করেন।
সচিব হিসেবে পদোন্নতিপ্রত্যাশী বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের দশম ব্যাচের কয়েকজন অতিরিক্ত সচিব অভিযোগ করেন, যাদের তদবির নেই, তারা সচিব হতে পারেন না। কারণ, নিয়ম অনুযায়ী এখন পদোন্নতি হয় না। তার বড় প্রমাণ প্রশাসন ক্যাডারের দশম ব্যাচের কর্মকর্তারা। এ ব্যাচের মেধাতালিকায় যারা এগিয়ে আছেন, তারা এখনও পদোন্নতি পাননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, সিভিল সার্ভিসের মধ্যে যে ঐক্যবন্ধন ও ভ্রাতৃত্ববোধ ছিল, তদবিরবাজির কারণে তা নষ্ট হয়ে গেছে। সচিব হয়েছেন, কিন্তু সিনিয়র সচিব হতে পারছেন না- তার জন্যও তদবির! এরপর তদবির করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাচ্ছেন। এভাবে উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পেতে, পদায়ন নিতে, বদলি হতে- সবকিছুতেই চলছে তদবির। সবচেয়ে বেশি তদবির হচ্ছে ভালো জায়গায় পোস্টিং নিতে। এই ভালো জায়গা বলতে বোঝায় ঘুষের জায়গা। বর্তমানে যেখানে আছেন, সেখানে ঘুষ কম। তাই ঘুষ যেখানে বেশি, সেটা তাদের কাঙ্ক্ষিত জায়গা।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার সমকালকে বলেন, পদোন্নতির জন্য রাজনৈতিক নেতাদের কাছে ডিও নেওয়া সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার পরিপন্থি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। রাজনৈতিক নেতারাও এ বিষয়ে তদবির করতে পারেন না।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা সমকালকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী যে কর্মকর্তা সম্পর্কে জানেন, তাকেই সাধারণত সচিব করা হয়। যার সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর ধারণা নেই, তাকে সচিব করা হয় না। তবে অতিরিক্ত সচিবের ২১২টি পদে বর্তমানে কর্মরত আছেন ৪৯৮ কর্মকর্তা। এত সংখ্যক কর্মকর্তার সার্বিক বিষয়ে জানা অনেক কঠিন। তাই কর্মকর্তাদের পদোন্নতির জন্য নির্দিষ্ট বিধান তৈরি করেছে সরকার। বর্তমানে জ্যেষ্ঠ সচিব ও সচিব রয়েছেন ৭৭ জন। এর মধ্যে চারজন সচিবের পদ শূন্য আছে। চলতি মাসের মধ্যে আরও প্রায় ১০ কর্মকর্তা অবসরে যাবেন। বর্তমানে ২৪ জেলায় কোনো সচিব নেই। অথচ বরিশাল ও ঢাকা জেলায় পাঁচজন করে সচিব আছে। কয়েকটি জেলায় তিন থেকে চারজন করে সচিব আছেন।
সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার সমকালকে বলেন, সচিব শতভাগ কাঠামোবদ্ধ পদ। এ পদে পদোন্নতির জন্য চাকরিজীবনের ৩০-৩৫ বছরের কর্মকাণ্ড, সুনাম, সততা ও গোয়েন্দা প্রতিবেদন দেখে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। এ জন্য যদি ডিও লেখা হয়, তাহলে তার অযোগ্যতার প্রমাণ হয়। যদি কেউ মুখেও তদবির করে, সেটাও শিষ্টাচার পরিপন্থি। সিভিল সার্ভিসের ঐতিহ্য ও কাঠামো কি নষ্ট হয়ে গেছে, তাদের মধ্যে যোগ্য লোক নেই? এভাবে তাদের রীতিনীতি নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে।
সম্প্রতি কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত সচিব) নাসির উদ্দিন আহমেদকে সচিব পদে পদোন্নতি দিতে আধা-সরকারি পত্র দিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান। তিনি সমকালকে বলেন, পদোন্নতি নিয়মতান্ত্রিকভাবে হয়। আর সচিব হওয়ার জন্য যে নম্বর লাগে, সেগুলো তার ডিপার্টমেন্ট অনুযায়ী চলে যায়। তারপরও কারও কারও আত্মবিশ্বাস থাকে যে ডিও দিলে বুঝি পদোন্নতিটা হতে পারে।
প্রতিমন্ত্রী দাবি করেন, 'যে কর্মকর্তাকে চিনি, তাকেই শুধু ডিও দিই।'
সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. তরুণ কান্তি শিকদারকে সচিব হিসেবে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য তদবির করেছেন নেত্রকোনা-৩ আসনের এমপি অসীম কুমার উকিল। চাহিদাপত্রের বিষয়ে জানতে চাইলে ড. তরুণ কান্তি শিকদার দাবি করেন, পদোন্নতির জন্য ডিও লেটার নিয়ম পরিপন্থি। আমি ব্যক্তিগতভাবে চাকরিজীবনে কোনোদিন ডিও নিইনি। এ বিষয়ে বলতেও পারব না।'
তবে তিনি বলেন, মন্ত্রী-এমপি যদি পছন্দ করেন তো দিতে পারেন। ডিও তো কিছুই না, এটা একটা অনুরোধপত্র মাত্র।
এ ছাড়া প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবু বকর সিদ্দিককে সচিব পদোন্নতির জন্য আধা-সরকারি পত্র দিয়েছেন ওই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মিজানুল হক চৌধুরী এবং বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়ক কেন্দ্র (বিটাক) মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) আনোয়ার হোসেন চৌধুরীকে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য আধা-সরকারি পত্র দিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।
জানা গেছে, এমপি-মন্ত্রীরা ডিও দেওয়ার পর গত ৭ সেপ্টেম্বর বেশকিছু কর্মকর্তা অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। এ ছাড়া যুগ্ম সচিব পদোন্নতি প্রক্রিয়া শুরু না হলেও অনেক কর্মকর্তা এরই মধ্যে তদবির শুরু করছেন। যদিও সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা-১৯৭৯ অনুযায়ী, কোনো সরকারি কর্মচারী তার পক্ষে হস্তক্ষেপ করার জন্য কোনো অনুরোধ বা প্রস্তাব নিয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো সংসদ সদস্য বা অন্য কোনো বেসরকারি ব্যক্তির দ্বারস্থ হতে পারবেন না।
- বিষয় :
- সচিব পদোন্নতি