ঢাকা শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫

বিলাসবহুল ১১২ গাড়ি নিলামে পানির দামে নিতে সিন্ডিকেট

বিলাসবহুল ১১২ গাড়ি নিলামে পানির দামে নিতে সিন্ডিকেট

চট্টগ্রাম বন্দরে কার শেডে রাখা গাড়ির সারি- সমকাল

সারোয়ার সুমন, চট্টগ্রাম

প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০২১ | ১৩:৪৪

বিএমডব্লিউ, ল্যান্ড রোভার, মার্সিডিজ বেঞ্জ, লেক্সাস, জাগুয়ার, ফোর্ড, মিৎসুবিশির মতো বিখ্যাত ব্র্যান্ডের বিলাসবহুল ১১২ গাড়ি নিলাম থেকে পানির দামে নিতে চায় একটি সিন্ডিকেট। শতকোটি টাকা দামের এসব গাড়ি সস্তায় বিক্রি ঠেকাতে কোনো কোনো গাড়ির ক্ষেত্রে ১০ বার পর্যন্তও নিলামে তোলা হয়েছে। তার পরও কাঙ্ক্ষিত দাম পাচ্ছে না কাস্টম কর্তৃপক্ষ। তাদের প্রত্যাশিত দাম থেকে অনেক কম দাম হাঁকছে নিলামে অংশগ্রহণকারীরা।
কয়েকবার এমন সিন্ডিকেট হওয়ায় এবার চট্টগ্রামের বাইরেও নিলামের ব্যবস্থা করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তারপরও ন্যায্য দাম পাওয়া নিয়ে রয়েছে সংশয়। কারণ এক দশকেরও বেশি সময় বন্দরে
পড়ে আছে এসব গাড়ি। দীর্ঘদিন পড়ে থাকায় লাইফটাইম শেষ হয়ে গেছে বেশিরভাগ গাড়ির। আবার কোনো কোনো গাড়ির নেই চাবি। নষ্ট হয়ে গেছে ব্যাটারি। মরিচা ধরেছে ইঞ্জিনেও। ২০১৬ সাল থেকে এসব গাড়ি নিলামে উঠলেও এগুলো বিক্রির ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি এনবিআর।
অসাধু সিন্ডিকেট নিলামে পানির দামে যে গাড়িগুলো নিতে চায় তার মধ্যে আছে- মিৎসুবিশি ২৬টি, মার্সিডিজ বেঞ্জ ২৫টি, বিএমডব্লিউ ২৫টি, ল্যান্ড রোভার ৭টি, ল্যান্ড ক্রুজার ৭টি, একটি সিআরভি, লেক্সাস ৬টি, ফোর্ড ৫টি ও জাগুয়ার ব্র্যান্ডের ৩টি।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার ফখরুল আলম বলেন, গাড়িগুলোর ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে এনবিআর। কোন গাড়ির কী সমস্যা, কেন এগুলোর ন্যায্য দাম পাওয়া যাচ্ছে না সেটিও খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি আমরা। এনবিআরের নির্দেশে পৃথক কমিটি এ নিয়ে কাজ করেছে। কিছু গাড়ির পার্টসে সমস্যা থাকলেও নিলামে যে দাম উঠছে তা অপ্রত্যাশিত। তাই চট্টগ্রামের বাইরেও নিলামে অংশ নেওয়ার ব্যবস্থা করেছে এনবিআর।
এনবিআরের জনসংযোগ দপ্তর জানিয়েছে, বিলাসবহুল এসব গাড়ির নিলাম অনুষ্ঠিত হয়েছে ৩ ও ৪ নভেম্বর। এবার এনবিআর ও চট্টগ্রাম বন্দরের ওয়েসবাইটে নিলাম-সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও মোংলায় কাস্টম অফিসে রাখা টেন্ডার বাক্সে টেন্ডার আবেদন খামে জমা দেওয়ার সুযোগ ছিল। তবে গতকাল পর্যন্ত নিলামের ফলাফল জানা সম্ভব হয়নি। একাজে আরও কয়েকদিন লেগে যেতে পারে বলে সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন।
রিকন্ডিশন গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন বারবিডার সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান বলেন, গাড়িগুলো পানির দামে নিতে একটি চক্র সক্রিয় আছে। এনবিআর যথাসময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। এক দশক ধরে গাড়িগুলো বন্দরে পড়েছিল। কোনো কোনো গাড়ি ১০ বারেরও বেশি নিলামে উঠেছে। এনবিআর সময়ক্ষেপণ না করলে কিছু গাড়ির আরও ভালো দাম পাওয়া যেত।
জানা গেছে চট্টগ্রাম বন্দরে বিলাসবহুল যেসব গাড়ির ফের নিলামে তোলা হয়েছে সেগুলো বাংলাদেশে এসেছে কারনেট দ্য পেসেজ বা পর্যটন সুবিধায়। যথাযথ নিয়ম মেনে এসব গাড়ি আমদানি না হওয়ায় তা জব্দ করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ পর্যটকরা শুল্ক্কমুক্ত সুবিধার অপব্যবহার করে এসব গাড়ি আমদানি করেছিলেন। পরে এনবিআর ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়ে খালাসের শর্তারোপ করলে কেটে পড়েন পর্যটকরা।
কোন গাড়ির কত দাম :নিলামে তোলা গাড়ির মধ্যে রয়েছে ৪ কোটি টাকার ল্যান্ড রোভার, এক কোটি ৬১ লাখ টাকার মিৎসুবিশি জিপ, ২ কোটি ২৩ লাখ টাকার মার্সিডিজ বেঞ্জ জিপ, ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকার ল্যান্ড রোভার জিপ, ২ কোটি ১২ লাখ টাকার লেক্সাস জিপ, ১ কোটি ৭৪ লাখ টাকার মিৎসুবিশি পাজেরো, ১ কোটি ৬১ লাখ টাকার মার্সিডিজ, ৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকার রেঞ্জ রোভার, এক কোটি ৯২ লাখ টাকার বিএমউব্লিউ, ২ কোটি ২৯ লাখ টাকার টয়োটা, ৪ কোটি ৫ লাখ টাকার ল্যান্ড রোভার, এক কোটি ৬২ লাখ টাকার বিএমউব্লিউ এক্স ফাইভ।
আছে ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকার বিএমউব্লিউ এক্স ফাইভ জিপ, ৩ কোটি ২০ লাখ টাকার ল্যান্ড ক্রুজার জিপ, ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকার ল্যান্ড ক্রুজার, ৪ কোটি ৩০ লাখ টাকার ল্যান্ড রোভার, ২ কোটি ৭৮ লাখ টাকার বিএমউব্লিউ, ২ কোটি ২৭ লাখ টাকার মিৎসুবিশি শোগান, ৪ কোটি ৩০ লাখ টাকার রেঞ্জ রোভার, ৩ কোটি ৭০ লাখ টাকার বিএমউব্লিউ এক্স ফাইভ জিপ স্পোর্টস, ৪ কোটি ৫ লাখ টাকার ল্যান্ড রোভার, ২ কোটি ৭৯ লাখ টাকার লেক্সাস জিএস ৪৫০ এইচ, ৩ কোটি ৭০ লাখ টাকার বিএমউব্লিউ জিপ, এক কোটি ৯৯ লাখ টাকার মিৎসুবিশি শোগান, ২ কোটি ৮ লাখ টাকার মার্সিডিজসহ আরও নানা গাড়ি।
৫৮ গাড়ির চাবি নেই, ৭৯ গাড়ির ইঞ্জিনে মরিচা :এনবিআরের নির্দেশে গঠিত পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি বন্দরে থাকা গাড়িগুলো সরেজমিন পরিদর্শন করে একটি প্রতিবেদন দেয়। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী ৫৮টি গাড়ির চাবি নেই, চাকা ও ব্যাটারি নষ্ট ১১৪টি গাড়ির। ইঞ্জিনে জং ধরেছে ৭৯টির। আবার কিছু গাড়ির চাকা ফেটে দেবে গেছে। কিছু গাড়ির কাচ ভেঙে গেছে। দুটি গাড়ির পেছনের কাচ ভাঙা।
কাস্টমস মূল্যায়ন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি এ রিপোর্ট দেয়। গাড়ির ন্যায্য দাম পেতে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে নিলামে তোলার সুপারিশও করে তারা এ রিপোর্টে। এ জন্য ১১২টি গাড়ি ফের নতুন নিয়মে নিলামে তুলেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
ভুয়া ঠিকানা জাল পে অর্ডার দিয়েও পণ্য খালাস :চট্টগ্রাম বন্দরে নিলাম থেকে পণ্য কিনতে হলে প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানা উল্লেখ করে অংশ নিতে হয় টেন্ডারে। ১০ শতাংশ টাকা জামানত রেখে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে জমা দিতে হয় পে-অর্ডার। কিন্তু কাস্টমকে ঘিরে গড়ে ওঠা নিলাম সিন্ডিকেট মানছে না কিছুই। ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে তারা অংশ নিচ্ছে নিলামে। আবার জামানতের টাকার বিপরীতে জমা দিচ্ছে জাল পে অর্ডার।
এই জালিয়াত চক্রেরই একজন হেলাল উদ্দিন। মিরপুর-১ ঢাকার ঠিকানা দিয়ে মেসার্স আরাফাত এন্টারপ্রাইজ ও সততা ট্রেডার্স নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে নিলামে অংশ নেন তিনি। ছয় কোটি টাকার পণ্য পেতে তিনি মাস কয়েক আগে ৬০ লাখ ৯৭ হাজার টাকার ২৯টি পে-অর্ডার জামানত রাখলেও তার প্রতিটিই ছিল জাল!
সিন্ডিকেটের আরেকটি চক্র নিলামে অংশ নিচ্ছে একাধিক নামে। ভিন্ন ভিন্ন নামে তারা নিলামে অংশ নেওয়ায় ঘুরেফিরে পণ্য যায় তাদের ঘরেই। বিএমডব্লিউ, ফোরসে, ল্যান্ড ক্রুজার, মাসির্ডিজের মতো বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের এসব গাড়ির প্রথম ও দ্বিতীয় নিলামে অংশ নিয়ে এ চক্রের ১৩টি প্রতিষ্ঠান ঘুরেফিরে ৬৩টি গাড়ির সর্বোচ্চ দরদাতা হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম শেখ মুজিব রোডের তাজ ট্রেডিং একাই সর্বোচ্চ দরদাতা হয়েছে ১৭টি গাড়ির। ১০টি গাড়ির সর্বোচ্চ দরদাতা ছিল চট্টগ্রামের হালিশহর কে-ব্লকের আরঅ্যান্ডএইচ সিন্ডিকেট। সাতটি গাড়ির সর্বোচ্চ দরদাতা আগ্রাবাদ এলাকার প্রতিষ্ঠান আলিফা এন্টারপ্রাইজ। আবার নিজেদের মধ্যে যোগসাজশ থাকায় ২০টি গাড়ির নিলামে দর দেয়নি কেউই। এসব কারণে বিলাসবহুল এসব গাড়ি নিলামে তোলা হচ্ছে বারবার।
জানা গেছে, নিলামে অংশ নেওয়া কিছু প্রতিষ্ঠানের মালিক বন্দর-কাস্টমসেরই কর্মকর্তা। তাই এই অংশটি নাম গোপন করেই নিলামে অংশ নিচ্ছে। আরেকটি অংশ ট্যাক্স ও ভ্যাট ফাঁকি দিতে গোপন করছে ঠিকানা।
এ কারণে গাড়ির পরবর্তী নিলামগুলোতে ভোটার আইডি কার্ড ও টিআইএন-সংবলিত সনদ জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ঘোষিত তথ্যে কোনো গরমিল পেলে আটকে দেওয়া হচ্ছে পে-অর্ডার। এ কারণে কেউ কেউ জাল পে-অর্ডার দিয়ে নিলামে অংশ নিচ্ছে। আবার কেউ পণ্য পাওয়ার পর তা হাত বদল করতে ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করছে। টেন্ডারে বিজয়ী না হলে পুরো প্রক্রিয়ায় জটিলতা তৈরি করাও কারও কারও উদ্দেশ্য হতে পারে। সিন্ডিকেট ভাঙতে তাই এবার চট্টগ্রামের বাইরে ঢাকা ও মোংলাতেও টেন্ডার জমা দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে।
গাড়িসহ বিভিন্ন পণ্যের নিলামে অংশ নেওয়া মেসার্স আর রেজা প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী সৈয়দ জহিরুল ইসলাম বলেন, 'এনবিআরের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে গাড়িগুলোর বেশিরভাগ অকেজো হয়েছে বন্দরেই। তারা গাড়ির যে দাম হিসাব করেছে তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই।'

আরও পড়ুন

×