বিচার শেষের আগেই ফাঁসি
'আসামিরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন'

সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০২১ | ১৩:৪৫
সর্বোচ্চ আদালতে চূড়ান্ত বিচার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগে হত্যা মামলায় চুয়াডাঙ্গার দুই আসামির ফাঁসি কার্যকর করা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এক্ষেত্রে আসামিরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বলে মনে করেন আইনজ্ঞরা। তাদের মতে, আসামিদের একটি আপিল সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের কার্যতালিকায় থাকা এটাই প্রমাণ করে যে, কোনো না কোনো পক্ষের গাফিলতি রয়েছে। কারও গাফিলতি ছাড়া এই আপিলটি শুনানির জন্য সুপ্রিম কোর্টের কার্যতালিকায় আসার কথা নয়। এ ঘটনায় অবশ্যই সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন বা কারা কর্তৃপক্ষকে দায় নিতে হবে।
যদিও কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, সর্বোচ্চ আদালতের রায়সহ সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই আসামিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
আপিল নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই চুয়াডাঙ্গার দুই আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিষয়টি গতকাল বৃহস্পতিবার বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সরকার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই মামলায় আসামিদের একাধিক আপিল সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন ছিল। অন্য আপিলগুলো নিষ্পত্তি হলেও একটি আপিল আসামি পক্ষের আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্টের মূল মামলার শুনানির সময় আদালতের নজরে আনেননি। এ কারণে বিষয়টি দীর্ঘদিন পর আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় শুনানির জন্য এসেছে।
অ্যাটর্নি জেনারেল মনে করেন, সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা ডিজিটালাইজড হলে এই ধরনের সমস্যা হতো না। অর্থাৎ, মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পরে আসামিদের আপিল শুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় আসত না।
১৯৯৪ সালের ২৮ জুন চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার কুমারি ইউনিয়নের দুর্লভপুর গ্রামের সাবেক ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার মুক্তিযোদ্ধা মো. মনোয়ার হোসেন খুন হন। ওই ঘটনায় তার ভাই মো. অহিমউদ্দিন বাদী হয়ে ২১ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। মামলার এজাহারে আবদুল মকিম ও গোলাম রসুল ঝড়ুর নাম আসে। তারা নিষিদ্ধ ঘোষিত চরমপন্থি দল পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। এ ঘটনায় ২০০৮ সালের ১৭ এপ্রিল রায় দেন বিচারিক আদালত। রায়ে তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড, দুইজনকে যাবজ্জীবন ও অপর ১৬ আসামিকে খালাস দেওয়া হয়। ২০১৩ সালের ৭ ও ৮ জুলাই হাইকোর্ট আসামি মকিম ও ঝড়ুর মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় দেন। বাকি আসামিদের খালাস দেওয়া হয়।
বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক সমকালকে বলেন, এই মামলা নিঃসন্দেহে প্রশাসনিকভাবে ভুল হয়েছে। যাদের অদক্ষতা, অবহেলা ও গাফিলতির কারণে এটা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে ব্যাপারে বিচার বিভাগকে নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, বিচার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত না হয়ে যেহেতু ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে, সেহেতু এই ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা দেওয়া সরকারের কর্তব্য। আইনের শাসন ও গণতন্ত্র আছে এই রকম দেশে এ জাতীয় মারাত্মক ও নির্মম ভুলের জন্য উচ্চপদস্থ অনেকেই পদত্যাগ করতে বাধ্য হতেন। আমাদের দেশে অন্তত পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণই একমাত্র প্রত্যাশা।
সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী আরও বলেন, যেহেতু বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয়নি, সেহেতু ন্যায়বিচার হয়েছে সেটা বলার কোনো সুযোগ নেই। এই দুই আসামি আপিল শুনানিতে নির্দোষ প্রমাণিত হতেন না এই নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবেন না। তবে, যারা বিচারিক আদালতে, হাইকোর্টে ও আপিল বিভাগে মামলা পরিচালনার জন্য দক্ষ আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারেন, তাদের কদাচিত ফাঁসি হয়।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান সমকালকে বলেন, সমগ্র বিচার যতক্ষণ পর্যন্ত শেষ না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত দণ্ড কার্যকর করা যাবে না। আপিল করার পরেও যদি আপিল নাকচ হয়ে একজন আসামি কিন্তু রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করতে পারেন। সেটা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত দণ্ড কার্যকর করা আইনের লঙ্ঘন। এখানে যেটা করা হয়েছে সেটা ন্যায়বিচারের প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে, এটা সংবিধান, মৌলিক অধিকার ও আইনের শাসনের লঙ্ঘন।
তার মতে, আসামিদের দুটি আপিলের মধ্যে একটি নিষ্পত্তি হলো, অপরটি না করেই রায় কার্যকর করা হলো, এটা তো সঠিক হয়নি। যদি গুরুত্বই না থাকে তাহলে এই বিধান রাখা হলো কেন? যেখানে একটা সুবিধা বা সুযোগ রাখা হয়েছে, তার মানেই একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি সেটার সুযোগ নিতে পারেন। যাদের অবহেলা ও গাফিলতির কারণে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির আগেই এই দু'জনের প্রাণদণ্ড কার্যকর হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা রয়েছে? একজন দাগি আসামিরও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এ ধরনের ঘটনা আইনের প্রতি, বিচার ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের চিড় ধরিয়ে দেয়।
রাষ্ট্রপক্ষ যা বলছে :আইনমন্ত্রী আনিসুল হক দাবি করেছেন, 'আপিল শুনানির আগে চুয়াডাঙ্গায় দুই আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের যে সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা সঠিক নয়।' তিনি বলেন, তার কাছে যে তথ্যাদি আছে সেটার সঙ্গে প্রকাশিত খবরের মিল নেই।
আইনমন্ত্রী আরও বলেন, যাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে, তাদের বিচারিক আদালতে মৃত্যুণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছিল। তারপর হাইকোর্ট বিভাগে তাদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ 'কনফার্ম' করা হয়েছিল। এরপর তারা জেল আপিল করেছিলেন। এই জেল আপিলের শুনানি শেষে আপিল বিভাগ বিচারিক আদালত ও হাইকোর্টের রায়কে বহাল রাখেন। সবশেষে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চান। প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ করার পর তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। সুতরাং আপিল শুনানির আগে তাদের মৃত্যুণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়েছে- এ কথাটি সঠিক নয়।
অ্যাটর্নি জেনারেল এ এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, সর্বোচ্চ আদালতে চূড়ান্ত বিচার শেষ করেই চুয়াডাঙ্গার মুক্তিযোদ্ধা মনোয়ার হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি মকিম ও ঝড়ূর ফাঁসি যথাযথভাবে কার্যকর করা হয়েছে।
তার মতে, আসামি মকিম ও ঝড়ূ জেলখানা থেকে যে আপিল করেছিলেন, সেটি ছিল জেল আপিল। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে তিনজন বিচারপতি শুনানি করে সে আপিল ২০১৬ সালের ১৫ নভেম্বর চূড়ান্ত রায়ের মাধ্যমে তা খারিজ করে দেন। কিন্তু তিনি ব্যক্তিগতভাবে আরও একটি আপিল (নিয়মিত) দায়ের করেন, যেটি ৩ নভেম্বর আপিল বিভাগের দৈনন্দিন কার্যতালিকায় ছিল।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সংবিধান সংশোধনের ফলে লিভ টু আপিল (আপিল শুনানির আবেদন) শুনানি হয় না, সরাসরি আপিল শুনানি হয়। যে কারণে ওই আপিলটি কার্যতালিকায় ছিল। তবে তার আইনজীবীর উচিত ছিল দুটি আপিল একসঙ্গে শুনানি করা বা আদালতের দৃষ্টিতে নিয়ে আসা। যেহেতু তারা আদালতের দৃষ্টিতে আনেননি, তাই তাদের যে জেল আপিল ছিল, তা সুপ্রিম কোর্টের ফুলকোর্টে শুনানি হয়ে নিষ্পত্তি হলো। এরপর রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করলেন, সেটিও নিষ্পত্তি হলো। আপিল এবং প্রাণভিক্ষার আবেদন খারিজ হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবে দণ্ড কার্যকর করা হলো। যেহেতু এই আপিলটি আলাদাভাবে করা হয়েছে, একসঙ্গে ট্যাগ করা হয়নি, এ কারণে সেটি রয়ে গেছে। বিচার তো শেষ হয়ে গেছে। আদালতে তাদের আইনজীবীরা শুনানি করেছেন, আদালত সবকিছু শুনে বিচার করে খারিজ করে দিয়েছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও দাবি করেন, ফাঁসি দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের নিয়মের কোনো ব্যত্যয় হয়নি। যথাযথ নিয়ম মেনে তাদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, আমাদের জানা মতে এরকম ঘটনা ঘটেনি। প্রথম কথা হলো- এই ফাঁসির ক্ষেত্রে একটা প্রসিডিউর আছে। যিনি ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত হন, প্রথমে তিনি আপিল করতে পারেন। তিনি হাইকোর্টে আপিল করেছেন। মঞ্জুর না হওয়ায় তিনি আবার আপিল বিভাগে আবেদন করেছেন। জেল থেকে তিনি আপিল করেছেন, যেটাকে জেল আপিল বলে। জেল আপিল নিষ্পত্তি হওয়ার পর, নামঞ্জুর হলে তিনি সর্বশেষ রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়েছেন। রাষ্ট্রপতি প্রাণভিক্ষার আবেদন নামঞ্জুর করেছেন। এরপর সিস্টেম অনুযায়ী তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, যথাযথ নিয়ম অনুযায়ী তাদের দণ্ড কার্যকর হয়েছে। কোনো আপিল বিচারাধীন ছিল বলে আমাদের কিংবা কারা কর্তৃপক্ষের জানা নেই।
বিচার শেষ হওয়ার পর আপিল কার্যতালিকায় আসা প্রসঙ্গে এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, আমাদের দেশে এখনও তো এনালগ সিস্টেম। এখনও ডিজিটাল হয়নি যে, একটা চাপ দিলেই সব চলে আসবে। আমি মনে করি, আইনজীবীদের দায়িত্ব হচ্ছে আদালতের নজরে নিয়ে আসা যে, এ আপিলের সঙ্গে আরও একটি আপিল আছে। আমরা যখন রিভিউ শুনানি করি তখন প্রতিটির ভেতর দেখি, সমস্যার সম্মুখীন হই। দেখা যাচ্ছে যে, আপিল আসে না। আদালতে বলি সময় দেন সাত দিন, খুঁজে বের করতে হয়। আশাকরি এখন যেহেতু ডিজিটালাইজড হয়ে যাচ্ছে, হয়তো এ সমস্যাগুলো থাকবে না।
তিনি বলেন, সব গুণাগুণ বিচার করে আপিলে রায় দিয়েছেন। এখানে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।
জড়িতদের শাস্তির দাবি পরিবারের :ঝড়ূর স্ত্রী আনজিরা খাতুন বলেন, আমরা তো আপিল করেছিলাম। আপিল শেষ না হওয়ার পরও ফাঁসি হয়েছে যাদের কারণে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। ঝড়ূর মেয়ে ফাতেমাও এ ঘটনায় দোষীদের শাস্তির দাবি করেন।
ঝড়ূর ছোট ভাই আজিম উদ্দিন বলেন, বিচার চলমান অবস্থায় ভাইয়ের ফাঁসি- সেটা আমরা জানতাম না। কীভাবে এটা হলো জানা নেই। সরকারের কাছে এ ঘটনার বিচার চাই।
চুয়াডাঙ্গা জজকোর্টের আইনজীবী আহসান আলী বলেন, এ ঘটনায় মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। অপরাধী যেই হোক, তার শাস্তি আইন মেনেই হোক।
যদিও কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, সর্বোচ্চ আদালতের রায়সহ সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই আসামিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
আপিল নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই চুয়াডাঙ্গার দুই আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিষয়টি গতকাল বৃহস্পতিবার বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সরকার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই মামলায় আসামিদের একাধিক আপিল সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন ছিল। অন্য আপিলগুলো নিষ্পত্তি হলেও একটি আপিল আসামি পক্ষের আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্টের মূল মামলার শুনানির সময় আদালতের নজরে আনেননি। এ কারণে বিষয়টি দীর্ঘদিন পর আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় শুনানির জন্য এসেছে।
অ্যাটর্নি জেনারেল মনে করেন, সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা ডিজিটালাইজড হলে এই ধরনের সমস্যা হতো না। অর্থাৎ, মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পরে আসামিদের আপিল শুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় আসত না।
১৯৯৪ সালের ২৮ জুন চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার কুমারি ইউনিয়নের দুর্লভপুর গ্রামের সাবেক ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার মুক্তিযোদ্ধা মো. মনোয়ার হোসেন খুন হন। ওই ঘটনায় তার ভাই মো. অহিমউদ্দিন বাদী হয়ে ২১ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। মামলার এজাহারে আবদুল মকিম ও গোলাম রসুল ঝড়ুর নাম আসে। তারা নিষিদ্ধ ঘোষিত চরমপন্থি দল পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। এ ঘটনায় ২০০৮ সালের ১৭ এপ্রিল রায় দেন বিচারিক আদালত। রায়ে তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড, দুইজনকে যাবজ্জীবন ও অপর ১৬ আসামিকে খালাস দেওয়া হয়। ২০১৩ সালের ৭ ও ৮ জুলাই হাইকোর্ট আসামি মকিম ও ঝড়ুর মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রায় দেন। বাকি আসামিদের খালাস দেওয়া হয়।
বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক সমকালকে বলেন, এই মামলা নিঃসন্দেহে প্রশাসনিকভাবে ভুল হয়েছে। যাদের অদক্ষতা, অবহেলা ও গাফিলতির কারণে এটা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে ব্যাপারে বিচার বিভাগকে নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, বিচার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত না হয়ে যেহেতু ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে, সেহেতু এই ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা দেওয়া সরকারের কর্তব্য। আইনের শাসন ও গণতন্ত্র আছে এই রকম দেশে এ জাতীয় মারাত্মক ও নির্মম ভুলের জন্য উচ্চপদস্থ অনেকেই পদত্যাগ করতে বাধ্য হতেন। আমাদের দেশে অন্তত পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণই একমাত্র প্রত্যাশা।
সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী আরও বলেন, যেহেতু বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয়নি, সেহেতু ন্যায়বিচার হয়েছে সেটা বলার কোনো সুযোগ নেই। এই দুই আসামি আপিল শুনানিতে নির্দোষ প্রমাণিত হতেন না এই নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবেন না। তবে, যারা বিচারিক আদালতে, হাইকোর্টে ও আপিল বিভাগে মামলা পরিচালনার জন্য দক্ষ আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারেন, তাদের কদাচিত ফাঁসি হয়।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান সমকালকে বলেন, সমগ্র বিচার যতক্ষণ পর্যন্ত শেষ না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত দণ্ড কার্যকর করা যাবে না। আপিল করার পরেও যদি আপিল নাকচ হয়ে একজন আসামি কিন্তু রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করতে পারেন। সেটা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত দণ্ড কার্যকর করা আইনের লঙ্ঘন। এখানে যেটা করা হয়েছে সেটা ন্যায়বিচারের প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে, এটা সংবিধান, মৌলিক অধিকার ও আইনের শাসনের লঙ্ঘন।
তার মতে, আসামিদের দুটি আপিলের মধ্যে একটি নিষ্পত্তি হলো, অপরটি না করেই রায় কার্যকর করা হলো, এটা তো সঠিক হয়নি। যদি গুরুত্বই না থাকে তাহলে এই বিধান রাখা হলো কেন? যেখানে একটা সুবিধা বা সুযোগ রাখা হয়েছে, তার মানেই একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি সেটার সুযোগ নিতে পারেন। যাদের অবহেলা ও গাফিলতির কারণে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির আগেই এই দু'জনের প্রাণদণ্ড কার্যকর হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা রয়েছে? একজন দাগি আসামিরও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এ ধরনের ঘটনা আইনের প্রতি, বিচার ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের চিড় ধরিয়ে দেয়।
রাষ্ট্রপক্ষ যা বলছে :আইনমন্ত্রী আনিসুল হক দাবি করেছেন, 'আপিল শুনানির আগে চুয়াডাঙ্গায় দুই আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের যে সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা সঠিক নয়।' তিনি বলেন, তার কাছে যে তথ্যাদি আছে সেটার সঙ্গে প্রকাশিত খবরের মিল নেই।
আইনমন্ত্রী আরও বলেন, যাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে, তাদের বিচারিক আদালতে মৃত্যুণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছিল। তারপর হাইকোর্ট বিভাগে তাদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ 'কনফার্ম' করা হয়েছিল। এরপর তারা জেল আপিল করেছিলেন। এই জেল আপিলের শুনানি শেষে আপিল বিভাগ বিচারিক আদালত ও হাইকোর্টের রায়কে বহাল রাখেন। সবশেষে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চান। প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ করার পর তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। সুতরাং আপিল শুনানির আগে তাদের মৃত্যুণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়েছে- এ কথাটি সঠিক নয়।
অ্যাটর্নি জেনারেল এ এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, সর্বোচ্চ আদালতে চূড়ান্ত বিচার শেষ করেই চুয়াডাঙ্গার মুক্তিযোদ্ধা মনোয়ার হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি মকিম ও ঝড়ূর ফাঁসি যথাযথভাবে কার্যকর করা হয়েছে।
তার মতে, আসামি মকিম ও ঝড়ূ জেলখানা থেকে যে আপিল করেছিলেন, সেটি ছিল জেল আপিল। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে তিনজন বিচারপতি শুনানি করে সে আপিল ২০১৬ সালের ১৫ নভেম্বর চূড়ান্ত রায়ের মাধ্যমে তা খারিজ করে দেন। কিন্তু তিনি ব্যক্তিগতভাবে আরও একটি আপিল (নিয়মিত) দায়ের করেন, যেটি ৩ নভেম্বর আপিল বিভাগের দৈনন্দিন কার্যতালিকায় ছিল।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সংবিধান সংশোধনের ফলে লিভ টু আপিল (আপিল শুনানির আবেদন) শুনানি হয় না, সরাসরি আপিল শুনানি হয়। যে কারণে ওই আপিলটি কার্যতালিকায় ছিল। তবে তার আইনজীবীর উচিত ছিল দুটি আপিল একসঙ্গে শুনানি করা বা আদালতের দৃষ্টিতে নিয়ে আসা। যেহেতু তারা আদালতের দৃষ্টিতে আনেননি, তাই তাদের যে জেল আপিল ছিল, তা সুপ্রিম কোর্টের ফুলকোর্টে শুনানি হয়ে নিষ্পত্তি হলো। এরপর রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করলেন, সেটিও নিষ্পত্তি হলো। আপিল এবং প্রাণভিক্ষার আবেদন খারিজ হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবে দণ্ড কার্যকর করা হলো। যেহেতু এই আপিলটি আলাদাভাবে করা হয়েছে, একসঙ্গে ট্যাগ করা হয়নি, এ কারণে সেটি রয়ে গেছে। বিচার তো শেষ হয়ে গেছে। আদালতে তাদের আইনজীবীরা শুনানি করেছেন, আদালত সবকিছু শুনে বিচার করে খারিজ করে দিয়েছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও দাবি করেন, ফাঁসি দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের নিয়মের কোনো ব্যত্যয় হয়নি। যথাযথ নিয়ম মেনে তাদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, আমাদের জানা মতে এরকম ঘটনা ঘটেনি। প্রথম কথা হলো- এই ফাঁসির ক্ষেত্রে একটা প্রসিডিউর আছে। যিনি ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত হন, প্রথমে তিনি আপিল করতে পারেন। তিনি হাইকোর্টে আপিল করেছেন। মঞ্জুর না হওয়ায় তিনি আবার আপিল বিভাগে আবেদন করেছেন। জেল থেকে তিনি আপিল করেছেন, যেটাকে জেল আপিল বলে। জেল আপিল নিষ্পত্তি হওয়ার পর, নামঞ্জুর হলে তিনি সর্বশেষ রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়েছেন। রাষ্ট্রপতি প্রাণভিক্ষার আবেদন নামঞ্জুর করেছেন। এরপর সিস্টেম অনুযায়ী তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, যথাযথ নিয়ম অনুযায়ী তাদের দণ্ড কার্যকর হয়েছে। কোনো আপিল বিচারাধীন ছিল বলে আমাদের কিংবা কারা কর্তৃপক্ষের জানা নেই।
বিচার শেষ হওয়ার পর আপিল কার্যতালিকায় আসা প্রসঙ্গে এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, আমাদের দেশে এখনও তো এনালগ সিস্টেম। এখনও ডিজিটাল হয়নি যে, একটা চাপ দিলেই সব চলে আসবে। আমি মনে করি, আইনজীবীদের দায়িত্ব হচ্ছে আদালতের নজরে নিয়ে আসা যে, এ আপিলের সঙ্গে আরও একটি আপিল আছে। আমরা যখন রিভিউ শুনানি করি তখন প্রতিটির ভেতর দেখি, সমস্যার সম্মুখীন হই। দেখা যাচ্ছে যে, আপিল আসে না। আদালতে বলি সময় দেন সাত দিন, খুঁজে বের করতে হয়। আশাকরি এখন যেহেতু ডিজিটালাইজড হয়ে যাচ্ছে, হয়তো এ সমস্যাগুলো থাকবে না।
তিনি বলেন, সব গুণাগুণ বিচার করে আপিলে রায় দিয়েছেন। এখানে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।
জড়িতদের শাস্তির দাবি পরিবারের :ঝড়ূর স্ত্রী আনজিরা খাতুন বলেন, আমরা তো আপিল করেছিলাম। আপিল শেষ না হওয়ার পরও ফাঁসি হয়েছে যাদের কারণে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। ঝড়ূর মেয়ে ফাতেমাও এ ঘটনায় দোষীদের শাস্তির দাবি করেন।
ঝড়ূর ছোট ভাই আজিম উদ্দিন বলেন, বিচার চলমান অবস্থায় ভাইয়ের ফাঁসি- সেটা আমরা জানতাম না। কীভাবে এটা হলো জানা নেই। সরকারের কাছে এ ঘটনার বিচার চাই।
চুয়াডাঙ্গা জজকোর্টের আইনজীবী আহসান আলী বলেন, এ ঘটনায় মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। অপরাধী যেই হোক, তার শাস্তি আইন মেনেই হোক।
- বিষয় :
- বিচার শেষের আগেই ফাঁসি