ঢাকা শুক্রবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৫

চলছে না গণপরিবহন, বিপাকে সাধারণ মানুষ

চলছে না গণপরিবহন, বিপাকে সাধারণ মানুষ

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চলছে না বাস, ট্রাক। ছবি-জাহিদুর রহমান

সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২১ | ২১:৪৭ | আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০২১ | ০২:৪৩

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে শুক্রবার ভোর থেকে সারা দেশে বাস-ট্রাক ধর্মঘট শুরু হয়েছে। এই ধর্মঘটে বিপাকে পড়েছে সাধারণ মানুষ। জরুরি পণ্য পরিবহন, জরুরি চিকিৎসা সেবার কাজে ঘর থেকে বের হওয়া মানুষ গণপরিবহন বন্ধ থাকায় বিকল্প পরিবহনের খোঁজে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। 

সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন চাকরি প্রার্থীরা। কারণ শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে শুরু হচ্ছে খাদ্য অধিদপ্তরের নিয়োগ পরীক্ষা। বাস বন্ধে তারা অনেকেই অটোরিকশা, থ্রি হুইলার ও হিউম্যান হলারে পাড়ি দিচ্ছেন গন্তব্যে। জ্বালানির দাম বৃদ্ধির অজুহাতে ডিজেলচালিত এসব হালকা যানবাহনেও গুনতে হচ্ছে বাড়তি ভাড়া।

শুক্রবার ভোরে রাজধানীর বাড্ডা, রামপুরা, মালিবাগ, মগবাজার, তেজগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে সেই দুর্দশার চিত্র। 

প্রগতি সরণির মেরুল বাড্ডা থেকে বাড্ডা লিঙ্ক রোড পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে সারি করে রাখা হয়েছিল সদরঘাট-টঙ্গী রুটের বাসগুলো। সড়কের দুই পাশে সাধারণ মানুষ অপেক্ষা বাড়ছে ক্রমাগত। 

শুক্রবার সকালে ধানমন্ডিতে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে যাওয়ার কথা ছিল আফসানা সুমার। কিন্তু গণপরিবহন সঙ্কটে স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে তিনি পড়েন বিপাকে। 

তিনি সমকালকে বলেন, ‘বাস চলবে কি না চলবে না, এ নিয়ে কাল রাতভর কনফিউশনে ছিলাম। কেউ বলেছিল, বাস চলবে, কেউ বলেছিল চলবে না। রাস্তায় নেমে পড়লাম। এখন দেখি বাসটাস কিছু নেই। মেয়েটারে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাব। এদিকে সিএনজিও পাওয়া যাচ্ছে না।’ 

রাজধানীর মেরুল বাড্ডা এলাকার গণপরিবহনের অপেক্ষায় সাধারণ মানুষ। ছবি- জয়ন্ত সাহা
বাড্ডার আদর্শনগর থেকে কমলাপুর স্টেশনে যাচ্ছিলেন রনি তালুকদার। বাস, সিএনজি কিছুই না পেয়ে তিনি পায়ে হেঁটেই রওনা হয়েছেন। 

তিনি বলেন, ‘বাস চলবে না জানতাম। কিন্তু সিএনজিও পাওয়া যাচ্ছে না। সব গ্যারেজে ঢুকে বসে আছে মনে হচ্ছে। রিকশাও খালি পাচ্ছি না।ট্রেন ধরতে হবে। তাই পায়ে হেঁটে রওনা হয়েছি। কতক্ষণ আর বসে থাকব। সামনে কোথাও রিকশা পেলে উঠে পড়ব।’ 

শুক্রবার সকাল ৮টার দিকে মহাখালীর আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালে এসেছিলেন আসলাম। 

তিনি বলেন, ‘আমি জামালপুর যাব। মেয়েটার আমার খুব জ্বর। তারে দেখতে যাইতেই হবে। কিন্তু বাস তো ছাড়তেসে না। এখন দেখি কোনো ট্রাকে উঠে হলেও যাইতেই হবে।’  

রাজধানীর জিগাতলা, মোহাম্মদপুর, শুক্রাবাদ এলাকা ঘুরে সমকালের স্টাফ রিপোর্টার রাজীব আহাম্মদ জানান, রাজধানীর সড়কে বিআরটিসির কয়েকটি বাস ছাড়া আর কোনো গণপরিবহন চলছে না। শুক্রবার রাজধানীতে খাদ্য অধিদপ্তর ও সাতটি বেসরকারি ব্যাংকে নিয়োগ পরীক্ষা দিতে আসা পরীক্ষার্থীরা বেশ বিপাকে পড়েন।

শুক্রবার দুপুরে ধানমন্ডির শুক্রাবাদ এলাকায় মিরপুর রোড ছিল প্রায় ফাঁকা। ছবি : রাজীব আহাম্মদ 

ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষা দিতে আসা তরুণ উৎপল দত্ত শুক্রাবাদের একটি কলেজে পরীক্ষা দিতে এসেছিলেন। 

তিনি বলেন, ‘বাস চলবে না সেটা গতকাল রাতেই আন্দাজ করেছিলাম। তাই গভীর রাতেই ঢাকা চলে এসেছি। নইলে আজ আর পরীক্ষাই দিতে পারতাম না। আমি আজ (শুক্রবার) ভোরে যাত্রাবাড়ী থেকে বিআরটিসির বাসে কারওয়ান বাজার আসি। সেখান থেকে রিকশা নিয়ে কলেজে এসেছি।’

মগবাজার মোড়ে বাসের অপেক্ষায় থাকা তরুণী আশা খাতুন বলেন, ‘এক ঘণ্টার মতো অপেক্ষা করলাম। কোনো বাস আসল না। আমি মিরপুর যাব বাবার বাসায়। রিকশা, সিএনজি কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। কিছু দূর হাঁটব। দেখি রিকশা পেলে যাব, তা আজ যত টাকাই ভাড়া নিক না কেন।’

ট্রাক বন্ধ থাকায় পণ্য পরিবহনে বিপাকে পড়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। ময়মনসিংহের ভালুকা, জামালপুরের ইসলামপুর, নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জের বেশকয়েকজন ব্যবসায়ী জানালেন, ট্রাক বন্ধ থাকায় তারা সবজি, মাছ কিছুই রাজধানীতে পাঠাতে পারেননি। 

ভালুকার মাছ ব্যবসায়ী ইদ্রিস আলী সমকালকে বলেন, ‘হুট করে বাস, ট্রাক সব বন্ধ কইরা ফেলল। অনেকবার রিকোয়েস্ট করছি ট্রাক মালিকদের। পিক আপও একটা রাতে ঠিকঠাক করছিলাম। কিন্তু সে অনেক রাতে ফোন করে বলে যে ঢাকা যাইতে পারবে না। এখন এলাকার বাজারে এই মাছ কম দামে বিক্রি করা লাগবে। আমার বহু টাকা লস হয়ে গেল।’ 

সমকালের স্টাফ রিপোর্টার জাহিদুর রহমান মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া এলাকা থেকে জানান, ভোর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কোনো বাস-ট্রাক চলছে না। মহাসড়কে বিক্ষিপ্তভাবে সিএনজি, রিকশা চলতে দেখা গেছে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমাদের সমিতি কিন্তু ধর্মঘট ডাকে নাই। মালিকরা বাস চালাচ্ছেন না। তারা মনে করছেন, তেলের দাম বাড়ার পর ভাড়া নতুন করে সমন্বয় করা না হলে তারা লোকসানে পড়বেন। আমরা তাদের জোর করছি না বাস চালাতে। আবার তাদের কেউ রাস্তায় বাস নামালে কেউ বাধাও দিচ্ছে না।’ 

তবে বাংলাদেশ ট্রাক মালিক ও শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সদস্য সচিব তাজুল ইসলাম বলেন, ‘ডিজেলের দাম না কমা পর্যন্ত আমরা সড়কে ট্রাক নামাব না। আমাদের ধর্মঘট চলবে।’

রাজধানীর তিনটি আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী থেকে কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। 

এ বিষয়ে বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান রমেশ চন্দ্র ঘোষ বলেন, ‘দূরপাল্লার গাড়ি চলাচলে নিষেধাজ্ঞা তো ছিল না সমিতির পক্ষ থেকে। এখন মালিকরা বাস না ছাড়লে আমরা আর কী করতে পারি?’

রাজধানীর সায়েদাবাদ আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালে দূরপাল্লার যাত্রীদের অপেক্ষা ছিল দিনভর। ছবি-বকুল আহমেদ


গত বুধবার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৬৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে প্রতি লিটার ৮০ টাকা করেছে সরকার। বাংলাদেশে ব্যবহূত জ্বালানির দুই-তৃতীয়াংশই ডিজেল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু পরিবহন নয়, কৃষি ও ব্যবসাতেও বিরূপ প্রভাব পড়বে। 

দাম বৃদ্ধির প্রত্যক্ষ প্রভাব বৃহস্পতিবার বিকেলেই দেখা দিয়েছে পরিবহন খাতে। ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বাসের ভাড়া বেড়েছে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে ৩৬ টাকার ভাড়া ৫০ টাকা নেওয়া হয়। জিগাতলা থেকে রামপুরা রুটের বাসে ১০ বাড়িয়ে ৪০ টাকা ভাড়া নেওয়া হয়।

দাম বৃদ্ধির কড়া প্রতিক্রিয়া এসেছে পণ্যবাহী যানবাহনের মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো থেকে।

এসব সংগঠনের শীর্ষ নেতারা সরকার সমর্থক কিংবা সরকারি দলের পদধারী হলেও সরাসরি ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খানের নেতৃত্বাধীন সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিলেও ধর্মঘটের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। 

ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেছেন, 'মালিকরা গাড়ি বন্ধ রাখলে শ্রমিকরা কী করে চালাবে?'

তবে পণ্যবাহী সমিতির তুলনায় নমনীয় সরকার সমর্থক বাস মালিকদের সংগঠন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি গতকাল দুপুরেই বাস ভাড়া বৃদ্ধির আবেদন করে চিঠি দেয় সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কাছে। তবে বিভিন্ন জেলা-উপজেলার সমিতিগুলো সরাসরি বাস বন্ধের ডাক দিয়েছে।

বাংলামোটরের কার্যালয়ে বাস মালিকদের বৈঠক শেষে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বৃহস্পতিবার সমকালকে বলেন, ‘ধর্মঘট ডাকা হয়নি। তেলের দাম এক লাফে ১৫ টাকা বাড়ায় দূরপাল্লার প্রতি ট্রিপে দেড় থেকে আড়াই হাজার টাকা খরচ বেড়েছে। এতে মালিকদের লোকসান হচ্ছে। লোকসান থেকে বাঁচতে কোনো মালিক যদি বাস চালাতে না চান, তাহলে বন্ধ রাখতে পারবেন।’

তবে বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, ‘বাস বন্ধ করতে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছে। বৈঠক থেকেই মালিকরা বাস বন্ধ রাখতে মোবাইল ফোনে নির্দেশ দেন নিজ নিজ পরিবহন কোম্পানিকে। সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান বলেছেন, লোকসান এড়াতে এ ছাড়া উপায় নেই।’

রাজধানীতে বাস চলে গ্যাসে; তারপরও কেন বন্ধের সিদ্ধান্ত- এ প্রশ্নে মাহবুবুর রহমান বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ায় এখন ৮০ শতাংশ বাসই ডিজেলে চলে।

খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, সর্বশেষ ২০১৩ সালে দূরপাল্লার বাস ভাড়া বেড়েছিল। ডিজেলের দাম কমায় ২০১৬ সালে ভাড়া কিলোমিটারে ৩ পয়সা কমিয়ে ১ টাকা ৪২ পয়সা করে সরকার। গত আট বছরে যন্ত্রাংশ, বেতন-ভাতা, ভ্যাট-ট্যাক্সসহ সব দাম বেড়েছে। ২০১৯ সালে বিআরটিএর ব্যয় বিশ্নেষণ কমিটি দূরপাল্লার বাসে কিলোমিটারে ২ টাকা ৭ পয়সা এবং ঢাকা চট্টগ্রামের অভ্যন্তরীণ বাসের ভাড়া ১ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে কিলোমিটারে ২ টাকা ২১ পয়সা নির্ধারণের প্রস্তাব করেছিল। সরকার সে ভাড়া কার্যকর করেনি। তেলের দাম ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ায় ভাড়া আরও বাড়ানো উচিত।

ভাড়া বৃদ্ধির আবেদন প্রসঙ্গে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার সমকালকে বলেন, এ নিয়ে আলোচনা হবে। আগামী রোববার মালিকদের সঙ্গে বসবেন।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটি সবকিছু পর্যালোচনা করে ভাড়া নির্ধারণ করবে। তা বিআরটি মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। সরকার অনুমোদন করলে ভাড়া বাড়বে। মালিকরা এ প্রক্রিয়া ছেড়ে বাস বন্ধ করলে জনগণের ভোগান্তি ছাড়া আর কিছু হবে না।

পণ্যবাহী পরিবহনের ধর্মঘট প্রসঙ্গে সচিব বলেন, তাদের ভাড়া সরকার নির্ধারণ করে না। মালিক ও পণ্য পরিবহনকারীর চুক্তিতে নির্ধারিত হয়। তাদের দাবির বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের কিছু করার নেই।

ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, ট্যাঙ্কলরি মালিক শ্রমিক সমন্বয় পরিষদের আহ্বায়ক রুস্তম আলী খান সমকালকে বলেন, মাত্র দু'দিন আগেই সেতুর টোল বেড়েছে। করোনায় সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে পরিবহন খাতের। এমন সময়ে তেলের দাম এক লাখে ১৫ টাকা বৃদ্ধি জুলুম। তাদের সংগঠনের সারাদেশের ২০০ শাখা ধর্মঘট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ডিজেলের দাম না কমা পর্যন্ত ধর্মঘট চলবে।


আরও পড়ুন

×