অমর একুশে গ্রন্থমেলা
জমজমাট মেলার আভাস

জয়নাল আবেদীন
প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | ১৩:৩০
করোনাভাইরাস নিয়ে পৃথিবীজুড়ে এমনিতেই আলোচনায় চীন। আর বাংলা একাডেমি এবং
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আলোচনায় নয়াচীন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা
তৃতীয় গ্রন্থ 'আমার দেখা নয়াচীন' খুঁজে ফিরছেন পাঠক। মাত্র দু'দিনে ঠিক কোন
ধরনের বইয়ের চাহিদা বেশি, তা স্পষ্ট করতে পারছিলেন না অনেকে। তবে এ দিন
একবাক্যে তারা উচ্চারণ করেছেন বঙ্গবন্ধুর লেখা এ বইটির কথা। সোহরাওয়ার্দী
উদ্যানে বাংলা একাডেমির ৩ নম্বর স্টলের বিক্রয়কর্মীরা জানান, গতকাল মেলা
শুরুর প্রথম তিন ঘণ্টায় ৫০টির বেশি বই বিক্রি হয়েছে। মেলার দুই অংশ মিলিয়ে
একাডেমির একটি প্যাভিলিয়নের পাশাপাশি রয়েছে ছয়টি স্টল। প্রায় সব স্টলেই
পাঠকের নজর নয়াচীনের দিকে। বঙ্গবন্ধুর অন্য দুটি বইও কিনছেন পাঠকেরা।
জমজমাট মেলার আভাস :ছোট্ট মুনিরার হাতে মীর আবু সালেহ্ শামসুদ্দীন শিশিরের
লেখা শিশুতোষ বই 'আলোর ফেরিওয়ালা'। আরও কিছু বই হাতে সে ছুটছিল শিশু
চত্বরের এদিক-ওদিক। নতুন বইয়ের ঘ্রাণে মেয়েটির আনন্দ যেন আর ধরে না।
বিভিন্ন বই দেখিয়ে একদিকে মায়ের ডাক, অন্যদিকে নানুর। কোন বই পছন্দ
মুনিরার। আদরের মেয়েকে ঘিরেই পাঁচ স্বজনের বইমেলার আনন্দ। আনন্দের প্রকাশ
এমন হবে না কেন, মেলায় ঘুরে বই কিনবে বলে মুনিরা এসেছে সেই নড়াইল থেকে।
ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মুর্তজা আর চিত্রা নদীর প্রতিবেশী তারা। বইমেলাকে
উপলক্ষ করে নানাবাড়িও ভ্রমণ হবে।
গতকাল সোমবার ছিল অমর একুশে গ্রন্থমেলার দ্বিতীয় দিন। ছুটির দিন নয়, তবু
পাঠকের পদচারণায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আর বাংলা একাডেমিজুড়ে বিস্তৃত বইমেলায়
প্রাণের কোলাহল। বিক্রয়কর্মী জাহিদুল ইসলাম চৌধুরী স্মরণ করিয়ে দিলেন সেই
পুরোনো প্রবাদ, সকাল দেখেই বলা যায় দিনটি কেমন যাবে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে
বাংলা একাডেমির ৩ নম্বর স্টলের এই বিক্রয়কর্মীর মতে, দ্বিতীয় দিনের
প্রথমার্ধে পাঠকের উপস্থিতি এবং আশানুরূপ বিক্রি জমজমাট মেলারই আভাস।
মেলাপ্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা যায়, বিকেল থেকে দলে দলে উদ্যানে প্রবেশ করেন
দর্শনার্থী। স্টল থেকে স্টলে যান। উল্টেপাল্টে দেখেন নতুন বই। এ দিন বই
বিক্রির পরিমাণ প্রথম দিনের চেয়ে কিছুটা বেশি ছিল। অনেকে ব্যস্ত ছিলেন
মোবাইাল ফোনের ক্যামেরায় পোজ দিয়ে। মেলাপ্রাঙ্গণে বিভিন্ন স্থানে তুলে ধরা
হয়েছে শেকড়, সংগ্রাম, মুক্তি এবং অর্জন। এর সামনে দাঁড়িয়েই ছবি তুলছিলেন
দর্শনার্থীরা।
অনেকের মতে, বইমেলা মানে শুধুই বই কেনা নয়, প্রাণের এই মেলাকে ঘিরে ফিরে
যাওয়া বাঙালির ইতিহাস আর ঐতিহ্যে। প্রিয়জন-স্বজনদের নিয়ে কিছুটা সময়
কাটানো। শ্যামলী থেকে আসা চাকরিজীবী মোহাম্মদ নাসির কিনেছেন আনিসুল হকের
উপন্যাস 'ভালোবেসে তোমাকে দিলাম'। মুচকি হেসেই বলছিলেন, 'প্রিয়জনকে উপহার
দেব।'
শিক্ষার্থী হিমু আহমেদ বলেন, এবার মেলায় স্টলের বিন্যাস অসাধারণ হয়েছে।
বইয়ের স্টলে সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বইয়ের সংগ্রহও ভালো মনে হচ্ছে।
নড়াইল থেকে আসা শিশু মুনিরার মা তাসলিমা আক্তার বলেন, ঢাকা থেকে দূরে হলেও
প্রতিবারই বইমেলায় আসার চেষ্টা করেন। এবার শুরুর দিকে চলে এসেছেন মেয়ের
পীড়াপীড়িতে। গল্প এবং ছবি আঁকার বই খুবই পছন্দ মুনিরার। গতকাল মেয়ের
পছন্দসই অনেক বই কিনেছেন।
একদিনের ব্যবধানে আরেকটু জমে উঠেছে লিটলম্যাগ চত্বর। দ্বিতীয় দিনে প্রায়
অর্ধেকের মতো স্টল ছিল বইয়ে ভরা। পাঠকের আনাগোনাও শুরু হয়েছে। প্রতিকথার
জহুরুল ইসলাম জাহিদ এবং শালুকের বিক্রয়কর্মী রিশতিয়াক আহমেদ জানান, দ্বিতীয়
দিন হিসেবে মন্দ না। টুকটাক বিক্রি হচ্ছে। তবে লিটলম্যাগ চত্বর এখানে
স্থানান্তর হওয়াটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
গতকাল মেলায় ঢুকতেই কানে এলো ঘোষণা, প্রতিটি প্যাভিলিয়ন ও স্টলে
বাধ্যতামূলক করা হয়েছে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র। বাংলা একাডেমির ৬৭ নম্বর স্টল
থেকে এই যন্ত্র সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে।
স্বাধীনতা স্তম্ভের সামনে গড়ে তোলা লেখক মঞ্চে বিকেলে কথা বলেন কবি রাজু
আহমেদ মামুন। সামনে চেয়ারে বসে ছিলেন মুগ্ধ শ্রোতারা। পাঠক দীর্ঘসময় লেখকের
কথা শোনেন, মাঝে আবার প্রশ্নও করেন। গতকাল এই মঞ্চে আরও কথা বলেন গিরীশ
গৈরিক, কৌস্তুভ শ্রী, হামিম কামাল।
নতুন বই :দ্বিতীয় দিনে ৩৭টি নতুন বই প্রকাশের খবর রয়েছে তথ্যকেন্দ্রে। এর
বাইরেও মেলায় অনেক বই এসেছে। নতুন বইয়ের মধ্যে অন্যতম হলো- আনা ইসলামের
'নভেরা :বিভূঁইয়ে স্বভূমে' (অন্যপ্রকাশ), সেলিনা হোসেনের 'আওয়ার বিলাভড শেখ
মুজিব' (পাঞ্জেরী), সৈয়দ শামসুল ইসলামের 'নুন-পূর্ণিমা' (বেঙ্গল
পাবলিকেশন্স), আয়মান সাদিক ও সাকিব বীন রশীদের 'লোকে কি বলে?' (আদর্শ), ড.
সালিম সাবরীনের 'ভাষা সাম্রাজ্যবাদ ও মানবাধিকার' (আগামী), ড. মোহাম্মদ
আমীনের 'এক নজরে বঙ্গবন্ধু' (আগামী), মোশতাক আহমেদের 'জোছনার ছায়া'
(অনিন্দ্য), মহাদেব সাহার 'আত্মস্মৃতি ১৯৭৫ :সেই অন্ধকার সেই বিভীষিকা'
(অনন্যা), ধ্রুব এষের 'পরেশের বউ' (পাঞ্জেরী)।
মূল মঞ্চের আয়োজন :'আমার দেখা নয়াচীন' বই নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় বিকেল
৪টায়। অনুষ্ঠানে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, জাতির পিতা
বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনের এক অনুপম আলেখ্য ধরা রইল 'আমার দেখা নয়াচীন'
বইয়ে। তরুণ শেখ মুজিব চীন দেশ ভ্রমণে তার যে অভিজ্ঞতা ও মূল্যায়ন তুলে
ধরেছেন যেন তারই আলোকে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পন্ন করেছেন এবং
শোষণমুক্ত স্বাধীন স্বদেশ গড়ে তুলতে চেয়েছেন।
স্বাগত বক্তব্যে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন,
বঙ্গবন্ধু আমাদের সব চেতনায় মিশে আছেন। তার নতুন বই আমার দেখা নয়াচীনের
পাতায় পাতায় আন্তর্জাতিকতাবাদী এক মহান ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি যেমন টের
পাওয়া যায়, তেমনি বাঙালি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তার সংকল্প প্রস্ম্ফুটিত
হয়। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান।
আলোচনায় অংশ নেন ড. ফকরুল আলম এবং কবি তারিক সুজাত। তারা বলেন, ১৯৫২ সালের ২
থেকে ১২ অক্টোবর চীনের পিকিংয়ে এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক শান্তি
সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান প্রতিনিধি
দলের সদস্য হিসেবে এ সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে নয়াচীন সফর করেন। 'আমার
দেখা নয়াচীন' স্মৃতিনির্ভর ও ভ্রমণকাহিনি তিনি রচনা করেন ১৯৫৪ সালে
কারাগারে রাজবন্দি থাকাকালে। শিল্পিত মন ও সূক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণে সদ্য
বিপ্লবোত্তর গণচীনের শাসন ব্যবস্থা ও জীবনচিত্র তুলে ধরেছেন প্রাঞ্জল
ভাষায়।
মূলমঞ্চে কবিতা আবৃত্তি করেন কবি মোহাম্মদ সাদিক, খালেদ হোসাইন ও নাসির
আহমেদ। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী সৈয়দ হাসান ইমাম, আসাদুজ্জামান
নূর এবং লায়লা আফরোজ। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী মহিউজ্জামান চৌধুরী, তিমির
নন্দী, শ্যামা সরকার এবং কে. এম. আব্দুল্লাহ আল মূর্তজা মুহিন।
আজকের আয়োজন :আজ গ্রন্থমেলার তৃতীয় দিন। মেলা চলবে বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা
পর্যন্ত। বিকেল ৪টায় মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ রচিত
'বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব :কী ও কেন' শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ
উপস্থাপন করবেন অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন অধ্যাপক
এম অহিদুজ্জামান এবং সাংবাদিক মোজাম্মেল বাবু। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন
কবি কামাল চৌধুরী। সন্ধ্যায় রয়েছে কবিকণ্ঠে কবিতাপাঠ, আবৃত্তি এবং
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
- বিষয় :
- গ্রন্থমেলা