অমর একুশে গ্রন্থমেলা
ফাগুনরাঙা সারাবেলা
দীপন নন্দী
সত্যিই মন ভালো করে দেওয়ার মতো দৃশ্য। মানুষ আসছে; প্রিয়জনের হাত ধরে,
বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে দল বেঁধে। প্রতিটি মানুষকে দেখতেই ভালো লাগছে। কী
সুন্দর করে বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে, ফতুয়া-পাঞ্জাবি পরে হাজির হয়েছিলেন তারা
অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। এত মানুষের আগমনে উড়ছিল ধুলো, তবে তাতে বাদ সাধেনি
উৎসবের আমেজের। বেলা ৩টায় মেলার দ্বার উন্মোচনের সময় থেকে শেষ পর্যন্ত
পহেলা ফাল্কগ্দুনের আবির মাখানো মানুষ ভিড় জমিয়েছিলেন মেলায়।
পাঠক-দর্শনার্থীদের এই উচ্ছল আগমনে খুশি প্রকাশকরা। এমন ভিড় আজ বুধবার
বিশ্ব ভালোবাসা দিবসেও অব্যাহত থাকবে, সেটি আর বলার অপেক্ষা থাকে না; এ
মন্তব্য তাদেরই।
গতকাল মেলার দুই প্রান্ত বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘুরে দেখা
যায়, মেলাজুড়েই লেগেছিল বসন্তের রঙ। পাঠক-দর্শনার্থীদের 'বাসন্তী' আগমনে
মনে হচ্ছিল এ যেন হলুদ কোনো ফুলের বাগান। শুধু পাঠকদের মাঝেই না, বসন্তের এ
আগমনী ছোঁয়া লেগেছিল স্টলগুলোতেও। বিক্রয়কর্মীরাও সেজে এসেছিলেন বসন্তের
রঙের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। প্রতিটি স্টলেই ছিল বইপ্রেমীর ভিড়। বইপ্রেমীরা
বসন্তে রঙের সঙ্গে নিয়েছেন নতুন বইয়ের ভাঁজ খোলার সোঁদা গন্ধ। যাচাই-বাছাই
করে কিনে নিয়েছেন পছন্দের লেখকের নতুন বই। বসন্তের রঙ মনে নিয়ে বই কিনে আর
ঘুরে ফিরেছেন মেলাজুড়ে। এ কারণে মেলায় গতকাল বেচাকেনা ছিল বেশ ভালো।
গতকালকের মেলা নিয়ে জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির নির্বাহী পরিচালক
কামরুল হাসান শায়ক সমকালকে বলেন, 'বেচাকেনা যেমনই হোক এখন মেলা পরিপূর্ণ।
কারণ, বসন্ত আমাদের প্রাণের উৎসব। বিক্রির সঙ্গে একে মেলালে হবে না, উৎসবের
এই পরিপূর্ণ আনন্দকে উপভোগ করতে হবে। আমরা সেটাই করেছি।'
গতকাল দুটি ভিন্ন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করতে মেলাপ্রাঙ্গণে হাজির হয়েছিলেন
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।
তাদের সঙ্গী হয়েছিলেন ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। মোড়ক উন্মোচনের
আনুষ্ঠানিকতা সেরে তারা গল্প করতে বসেছিলেন অন্যপ্রকাশের প্যাভিলিয়নে।
হাজারও সরকারি কর্মব্যস্ততা ভুলে দারুণ খোশগল্পে মেতেছিলেন তারা।
আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে কথা বলতে রাজি হলেন না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তবে বললেন,
দারুণ লাগছে ফাল্কগ্দুনের প্রথম দিনের মেলা। মানুষ কী সুন্দর করে বাসন্তী
রঙে সেজে এসেছে মেলায়। এতটুকু বলেই বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবি পরে দাঁড়িয়ে থাকা
আসাদুজ্জামান নূরের সঙ্গে রসিকতা করে বললেন, 'এই যে দেখেন, আমাদের
সংস্কৃতিমন্ত্রী কী সুন্দর বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবি পরে আছেন।' সব মিলিয়ে
মেলা ভালো লেগেছে জানান মন্ত্রী।
আর মেলা নিয়ে সংস্কৃতিমন্ত্রী বললেন, 'বেশ খোলামেলা, সুন্দর মেলা। মানুষ
আসছেন, বই কিনছেন- এর চেয়ে সুন্দর আর কী হতে পারে?' এবারের মেলায় তার
সম্পাদিত 'বেলা অবেলা সারাবেলা' বইটির চতুর্থ খণ্ড এসেছে। বইটি কেমন যাচ্ছে
জানতে চাইলে এক গাল হেসে বললেন, 'আমি কি লেখক, নাকি সম্পাদক! বই কেমন
বিক্রি হচ্ছে সেটা প্রকাশকই ভালো বলতে পারবেন।' একটু দুঃখ করে বললেন,
'চারপাশে এত মোবাইলের ক্যামেরা যে, ছবি তুলেই সময় পার হয়ে যাচ্ছে; বই কিনতে
পারছি না।' তবে তার প্রকাশকরা, বন্ধুরা তাকে চমৎকার সব বই উপহার দেন বলেও
জানিয়ে দিলেন সবার প্রিয় 'বাকের ভাই'।
আজ মেলা রাঙাবে ভালোবাসার রঙে :আজ বুধবার বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। এ দিবস
উপলক্ষে আজও মেলা জমজমাট থাকবে এমনটাই প্রত্যাশা করছেন প্রকাশকরা। তাদের
সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, গতকাল ফাল্কগ্দুনের প্রথম দিনেই অনেকে ভালোবাসার
প্রিয় মানুষকে নতুন বই উপহার দিয়েছেন। তারপরও, ভালোবাসা দিবসে অনেকেই নতুন
বই কিনে প্রিয়জনকে উপহার দেবেন এমনটাই প্রত্যাশা তাদের।
নতুন বই :একাডেমির সমন্বয় ও জনসংযোগ উপবিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী,
গতকাল মেলার ১৩তম দিনে নতুন ১৫০টি বই এসেছে। এর মধ্যে গল্প ১৬, উপন্যাস ২৭,
প্রবন্ধ ৫, কবিতা ৫৭, গবেষণা ৩, শিশুসাহিত্য ৩, জীবনী ৬, মুক্তিযুদ্ধ ৩,
ভ্রমণ ২, বিজ্ঞান ৪, রাজনীতি ১, চিকিৎসা/স্বাস্থ্য ১, অনুবাদ ১, বৈজ্ঞানিক
কল্পকাহিনী ১ এবং অন্যান্য বিষয়ের ওপর আরও ১৭টি বই প্রকাশ পেয়েছে।
এর মধ্যে রয়েছে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর 'ভূতের নয় ভবিষ্যতের' (রোদেলা), আল
মাহমুদের 'জীবন যখন বাঁক ঘোরে' (সরলরেখা), অধ্যাপক এস এম আনোয়ারার
'বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব' (ন্যাশনাল পাবলিকেশন্স), হাসান আজিজুল হকের
'আমার যেদিন গেছে ভেসে' (যুক্ত), অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল্লাহ্র 'সুস্থ
থাকুন' (ঐতিহ্য), আলফ্রেড খোকনের 'উড়ে যাচ্ছে মেঘ' (শ্রাবণ প্রকাশনী), ড.
মাহবুবুল হকের 'রুশ বিপ্লবের বিজয়গাথা' (কথাপ্রকাশ), শামসুজ্জামান খানের
'ফোকলোর সংগ্রহশালা ১২১' (বাংলা একাডেমি), আহসান হাবীবের 'সত্যি
অ্যাডভেঞ্চার' সৈয়দ শামসুল হকের 'শ্রেষ্ঠ কবিতা' (চারুলিপি); শওকত আলীর
'শুন হে লখিন্দর' (বাঁধন); নির্মলেন্দু গুণের 'নির্বাচিত ৫০ কবিতা'
(ইন্তামিন); মুজিব ইরমের 'প্রেমের কবিতা' (পাঞ্জেরী); আলফ্রেড খোকনের 'নগরে
নিবন্ধনহীন' (কথাপ্রকাশ); মোজাফ্ফর হোসেন সম্পাদিত 'আর্নেস্ট হেমিংওয়ে
নির্বাচিত গল্প' (আলোঘর); ফিরোজ এহতেশামের 'সাধুকথা' (মেঘ) এবং মোস্তফা
মামুনের 'ক্যাম্পাস ১৯৯৫' (অনন্যা)।
মেলামঞ্চের আয়োজন :গতকাল গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় 'নারীর নিরাপদ
পরিসর ও পরিবেশ' শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন খুশী কবির।
আলোচনায় অংশ নেন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, হোসনে আরা শাহেদ, সুবাস সিংহ
রায় এবং নূরুন্নাহার মুক্তা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন আয়শা খানম। সন্ধ্যায়
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী সন্দীপন দাস, আঞ্জুমান
আরা শিমুল ও কাজী মুয়ীদ শাহরিয়ার সিরাজ জয়।
আজকের অনুষ্ঠান :আজ বুধবার মেলা চলবে বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত।
বিকেলে গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে 'শিশু সংগঠন নিষ্ফ্ক্রিয়তা ও
শিশুর সাংস্কৃতিক বিকাশ' শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন
করবেন মোহিত কামাল। আলোচনায় অংশ নেবেন সুব্রত বড়ূয়া, দিলারা হাফিজ ও হাসান
শাহরিয়ার। সভাপতিত্ব করবেন শিল্পী হাশেম খান। সন্ধ্যায় রয়েছে সাংস্কৃতিক
অনুষ্ঠান।