- বইমেলা
- প্রবন্ধ থেকে শিশুতোষ সবখানেই বঙ্গবন্ধু
অমর একুশে গ্রন্থমেলা
প্রবন্ধ থেকে শিশুতোষ সবখানেই বঙ্গবন্ধু
জয়নাল আবেদীন |
জয়নাল আবেদীন
প্রকাশ: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০
আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রকাশ: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ । আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ । প্রিন্ট সংস্করণ
এবার গ্রন্থমেলার মধ্যমণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ সামনে রেখে কী নেই আয়োজনে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সুবিশাল পরিসরের মেলায় যেদিকেই চোখ যায়, দৃষ্টিজুড়ে জাতির পিতার প্রতিচ্ছবি। তবে সবকিছু ছাড়িয়ে নতুন বইয়ের ঘ্রাণেই বেশি উজ্জীবিত তিনি। ছুঁয়ে গেছেন সব লেখকের হৃদয়। মিশে আছেন প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা থেকে শিশুতোষ নানা গ্রন্থে; কথা আর ছন্দে। প্রতিদিনই তাকে ঘিরে প্রকাশিত হচ্ছে অনেক বই।
বইমেলার প্রথম দিনই প্রকাশিত হয় বঙ্গবন্ধুর তৃতীয় গ্রন্থ 'আমার দেখা নয়াচীন'। এখন পর্যন্ত এ বইয়ের কাটতি সবচেয়ে বেশি। সঙ্গে তার পুরোনো দুটি গ্রন্থ তো আছেই। বঙ্গবন্ধুকে পরিপ্রেক্ষিত করে আয়োজিত মেলায় বাংলা একাডেমি থেকে প্রতিদিন একটি করে গ্রন্থ প্রকাশ হচ্ছে। তবে জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে সব মিলিয়ে ১০০টি গ্রন্থ প্রকাশ করবে একাডেমি।
এ ছাড়া বড়-ছোট অধিকাংশ প্রকাশনীই এবার বঙ্গবন্ধুবিষয়ক গ্রন্থ প্রকাশ করে চলেছে। শুধু প্রকাশেই শেষ নয়, পাঠকেরও আগ্রহের কেন্দ্রে রয়েছেন জাতির পিতা। বয়োজ্যেষ্ঠদের জন্য যেমন রয়েছে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধের বই, খুদে পাঠকের জন্যও আছে সাবলীল সহজবোধ্য ছড়া-কবিতার বই। তরুণ থেকে শুরু করে সব শ্রেণির, সব বয়সের পাঠক এবার তাদের মতো করে খুঁজে পাচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমানকে। গতকাল রোববার নতুন বই এসেছে ১৫৪টি। এর মধ্যে ১৭টিই ছিল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা। মেলার ২২ দিনে প্রকাশিত তিন হাজার ৭৮৫টি বইয়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধুবিষয়ক গ্রন্থের সুনির্দিষ্ট হিসাব নেই। বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্রে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রকাশিত মাত্র ১০১টি গ্রন্থের নাম জমা পড়েছে।
এরই মধ্যে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- সৈয়দ শামসুল হকের 'বঙ্গবন্ধুর বীরগাথা', হারুন-অর-রশিদের 'বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব :কী ও কেন', অজয় দাশগুপ্তের 'বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন কৌশল ও হরতাল', নূহ-উল-আলম লেনিনের 'রাজনীতিতে হাতেখড়ি ও কলকাতায় শেখ মুজিব', এম আবদুল আলীমের 'বঙ্গবন্ধু ও ভাষা-আন্দোলন', সুব্রত বড়ূয়ার 'বঙ্গবন্ধুর জীবনকথা', আসাদ চৌধুরীর 'সংগ্রামী নায়ক বঙ্গবন্ধু', শাহ্জাহান কিবরিয়ার 'জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু', পিয়াস মজিদের 'মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলা একাডেমি'।
আগামী এনেছে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর 'বঙ্গবন্ধু :মধ্যরাতের সূর্যতাপস' এবং 'বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ ও শেখ হাসিনা'। এখান থেকে বঙ্গবন্ধুবিষয়ক বেশ কিছু বই প্রকাশ হয়েছে। অনন্যা এনেছে মহাদেব সাহার 'আত্মস্মৃতি ১৯৭৫ :সেই অন্ধকার সেই বিভীষিকা', মুনতাসীর মামুনের 'বঙ্গবন্ধুর জীবন :জেল থেকে জেলে', আমীরুল ইসলামের 'মুজিববর্ষে আলোর ফুল'সহ অন্তত ১২টি গ্রন্থ। অন্যপ্রকাশ এনেছে সৈয়দ শামসুল হকের 'বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে', পাঞ্জেরী এনেছে সেলিনা হোসেনের ইংরেজি গ্রন্থ 'আওয়ার বিলাভড শেখ মুজিব', মোনায়েম সরকারের 'লাইফ এন্ড টাইমস অব দি ফাদার অব দি ন্যাশন শেখ মুজিবুর রহমান'। কথাপ্রকাশ থেকে এসেছে শেখ সাদীর 'বঙ্গবন্ধু অভিধান'; নালন্দা থেকে আনোয়ার কবিরের 'বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচার'; ভাষাপ্রকাশ থেকে মনি হায়দারের 'বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞাসা'; সময় এনেছে ফরিদুর রেজা সাগর সম্পাদিত 'তোমার নেতা আমার নেতা'; শোভাপ্রকাশ এনেছে আবুল আহসান চৌধুরীর 'বঙ্গবন্ধু :অন্নদাশঙ্কর রায়ের স্মৃতি-অনুধ্যানে', লাবণী এনেছে শাবান মাহমুদের 'বঙ্গবন্ধুর সারা জীবন' ও 'বাঙালির আত্মপরিচয়'।
এ ছাড়া ঐতিহ্য থেকে এসেছে জাকারিয়া পলাশের 'বঙ্গবন্ধু ও শের-এ কাশ্মীর', পাঠক সমাবেশ থেকে ড. সাজেদুল আউয়ালের 'শেখ মুজিবুর রহমান :নির্বাচিত উক্তি', কাকলী থেকে ড. সাইদ হায়দারের 'উপমহাদেশে বিভাজনের রাজনীতি বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ', উৎস থেকে মুস্তফা মনওয়ার সুজনের 'বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক মতবাদ', পার্ল থেকে আনিসুল হকের 'বঙ্গবন্ধুর জন্য ভালোবাসা', চিলড্রেন থেকে খায়রুল আলম মনির 'মহান নেতা বঙ্গবন্ধু', আহমদ পাবলিশিং থেকে জুলফিকার নিউটনের 'বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা ও স্থপতি', ঝিঙেফুল থেকে খায়রুল আলম মনির 'ছোটদের হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু'। এর বাইরেও অধিকাংশ প্রকাশনী বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একাধিক গ্রন্থ প্রকাশ করেছে।
পাঞ্জেরীর বিপণন ইনচার্জ ইফতেখার আহমেদ সমকালকে বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনের ওপর প্রকাশিত গ্রন্থগুলো পাঠককে খুবই টানছে। বিভিন্ন বয়সী পাঠক বঙ্গবন্ধুর ওপর লেখা বই কিনছেন। জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ ঘিরে পুরো ব্যাপারটি সত্যিই খুব আনন্দদায়ক।
বাংলা একাডেমির বিভিন্ন প্যাভিলিয়নের বিক্রয়কর্মীরা জানান, প্রথম দিন থেকেই পাঠকের আগ্রহের কেন্দ্রে রয়েছে 'আমার দেখা নয়াচীন'। এখন পর্যন্ত এ বইটি সম্ভবত বাংলা একাডেমির সর্বোচ্চ বিক্রীত বই। পুরোনো বইগুলোও বিক্রি হচ্ছে বেশ। তবে এটি নিয়ে সব মহলের আগ্রহ প্রত্যাশার চেয়েও বেশি।
বিভিন্ন প্রকাশনীর বিক্রয়কর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, বইগুলোতে উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা, সংগ্রাম, রাজনৈতিক জীবন ও ভাষা আন্দোলনের নানা অজানা কাহিনি। প্রতিদিনই বঙ্গবন্ধুবিষয়ক বই প্রকাশিত হচ্ছে। এ ধরনের বই নতুন প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরার অনন্য প্রয়াস।
পাঠ-উন্মোচন : গতকাল গ্রন্থ উন্মোচন মঞ্চে পাঠ-উন্মোচন হয় খন্দকার মিজানুর রহমানের ইংরেজি গ্রন্থ 'টি-টোয়েন্টি টাচ স্টোন'। পাঠ-উন্মোচন করেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুল মতিন খসরু। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন সাবেক এমপি অধ্যক্ষ নূরী নেওয়াজ, অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আলী চৌধুরী, মো. শাহজালাল, অধ্যাপক ড. আনোয়ারা বেগম, অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী।
গ্রন্থটির লেখক মিজানুর রহমান বলেন, বইটিতে মূলত থ্রিডি মেথডসহ ইংরেজি ভাষা শেখার নানা কৌশল তুলে ধরা হয়েছে।
এ ছাড়া গতকাল মেলায় আসা নতুন বইয়ের মধ্যে রয়েছে- আহমদ রফিকের 'বাংলাদেশ জাতীয়তা ও জাতিরাষ্ট্রের সমস্যা' (অনিন্দ্য), মিজানুর রহমান খানের 'একাত্তরে এক বিন্দু শিশির' (বর্ষা দুপুর), আলী ইমামের 'রোমাঞ্চকর জ্যোতির্বিজ্ঞান' (সৃজনী), বিশ্বজিৎ ঘোষের 'লোকপুরাণ জনসমাজ ও কথাশিল্প' (অন্যপ্রকাশ), মোজাফ্ফর হোসেনের 'তিমিরযাত্রা' (পাঞ্জেরী), রথো রাফির 'অক্ষর ও বালির পৃথিবী' (আনন্দম)।
মঞ্চের আয়োজন : বিকেল ৪টায় অনুষ্ঠিত হয় মুর্শিদা বিন্তে রহমান রচিত 'স্বাধীনতার পথে বঙ্গবন্ধু :পরিপ্রেক্ষিত ১৯৭০-এর নির্বাচন' শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি। আলোচনায় অংশ নেন আখতার হুসেন, মাহবুব সাদিক ও আলম খোরশেদ। লেখকের বক্তব্য দেন মুর্শিদা বিন্তে রহমান। সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান।
মুস্তাফিজ শফি বলেন, বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতির দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই- গভীর আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে শোষকের বিরুদ্ধে নিরলস সংগ্রামী নেতা হিসেবে গড়ে তুলেছেন। জেল-জুলুম-হুলিয়া সত্ত্বেও তিনি মানুষের মুক্তির মন্ত্র ছড়িয়ে যাচ্ছেন মানুষের মধ্যেই। নিজে প্রস্তুত হয়েছেন, জাতিকে প্রস্তুত করেছেন স্বাধিকার ও স্বাধীনতার জন্য। দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ঘুরে বেড়িয়ে বঙ্গবন্ধু আসলে যেন নিজেকে চেনাচ্ছিলেন।
তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু ধীরে ধীরে হয়ে উঠছিলেন বাঙালি জাতির বিশ্বাস ও আস্থার প্রতীক। তার সেই ত্যাগ ও সংগ্রাম বৃথা যায়নি। তার নেতৃত্বে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল বিস্ময় ছড়িয়ে। বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বের অন্যান্য স্বাধীনতাকামী জাতিরও অনুপ্রেরণার নাম, মুক্তির মন্ত্র।
অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে একটি জাতিকে যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়া। স্বাধীনতার পথে বঙ্গবন্ধু :পরিপ্রেক্ষিত ১৯৭০-এর নির্বাচন গ্রন্থের মধ্য দিয়ে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তা হলো বঙ্গবন্ধুর মানস-জগতে স্বাধীনতার চিন্তা রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই বিদ্যমান ছিল, যার প্রতিফলন ঘটে তার সামগ্রিক আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে।
গতকাল 'লেখক বলছি' অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন মশিউল আলম, মাহবুব রেজা, রুমা মোদক ও চাণক্য বাড়ৈ।
কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠ করেন কবি শামীম আজাদ, ফেরদৌস নাহার, আমিনুর রহমান সুলতান, মুস্তাফিজ শফি, প্রত্যয় জসীম ও সঞ্জীব পুরোহিত। সংগীত পরিবেশন করেন অপর্ণা খান, মো. মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া, ডালিয়া সুলতানা, সুমন চন্দ্র দাস, মো. নূরুল ইসলাম, হাসান মাহমুদ ও সৈয়দা কবিতা। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন অভিজিৎ রায় (তবলা), হোসেন আলী (বাঁশি), ইফতেখার হোসেন সোহেল (কিবোর্ড), সুমন কুমার শীল (দোতারা)।
মন্তব্য করুন