রাজু ভাস্কর্যের সামনে গাড়ি থেকে নামলেন সুলতান-উজ-জামান। সড়ক দুর্ঘটনায় ডান পা হারিয়েছেন প্রায় এক যুগ আগে। অনেক স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে। তবে প্রাণের বইমেলা তাকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেনি কখনও। তিনি গাড়ি থেকে নামতেই হুইলচেয়ার নিয়ে এগিয়ে যান মইনুল ফয়সাল। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন 'সুইচ'-এর হয়ে তারা সেবা দেন প্রতিবন্ধী ও বয়োজ্যেষ্ঠদের।

হুইলচেয়ারের চাকা ঘুরতে শুরু করলে কথা হয় ষাটোর্ধ্ব সুলতানের সঙ্গে। পরিবার নিয়ে থাকেন রাজধানীর নর্দ্দা এলাকায়। গ্রামের বাড়ি নাটোর। সেখানেই এক সড়ক দুর্ঘটনায় তার চলার পথ স্থবির হয়ে আসে। একটু সামনের দিকে হেলে হুইলচেয়ার ঠেলতে থাকা মইনুলের চোখেমুখে তখন দারুণ আত্মতৃপ্তির ছাপ। প্রায় প্রতিদিনই এ রকম তৃপ্তি নিয়ে হলে ফেরেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী।

হুইলচেয়ার গিয়ে থামল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বাংলা একাডেমির প্যাভিলিয়নের সামনে। কোনোরকম যাচাই-বাছাই ছাড়াই কিনে নিলেন বঙ্গবন্ধুর তৃতীয় গ্রন্থ 'আমার দেখা নয়াচীন'। মইনুলকে সঙ্গে নিয়ে আরও কয়টা বই কিনলেন তিনি।

গতকাল ছিল মেলার ২৩তম দিন। আর মাত্র পাঁচ দিন থাকছে অমর একুশের গ্রন্থমেলা। বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রতিটি কোণে দেখা যায় ছোট ছোট আড্ডা। বিকেল ৩টায় খোলে মেলার দুয়ার। প্রথম ঘণ্টায় মেলা হয়ে ওঠে জমজমাট। শেষ মুহূর্তে কাঙ্ক্ষিত বইখানা কিনতে ভুল করছেন না পাঠক।

লিটল ম্যাগ এবং শিশুচত্বরে উপচেপড়া ভিড় দেখা না গেলেও পাঠকশূন্য কাটেনি। অনেকেই সপরিবারে মেলায় এসেছেন গতকালও। শিশুদের কিনে দিয়েছেন চাহিদামাফিক শিশুতোষ গ্রন্থ। এ ছাড়া শেষ বেলায় বেশিরভাগ প্যাভিলিয়ন ও স্টলেই পাঠকের ভিড় দেখা গেছে।

ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ফাহিম মাহমুদ বলেন, 'এ নিয়ে চতুর্থ দিনের মতো মেলায় এসেছি। প্রথম দিনে দুটি বই কিনেছিলাম। এরপর আর কেনা হয়নি। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে সন্ধ্যা পর্যন্ত আড্ডা হয়, এমন একটি পরিবেশ তো পাওয়াই যায় না। মেলায় আরও আসব, শেষদিকে আরও বই কিনব।'

ফাহিমের মতোই নুসরাত সুলতানা, কানিজ মাহমুদ, সুরভী ইসলামেরা কয়েকবার করে মেলায় ঘুরেছেন। বইমেলা তাদের কাছে প্রাণের মেলায় রূপ নিয়েছে। একসঙ্গে ঘোরাঘুরি এবং বই কেনা। তবে তারা শেষদিকেই বই কিনে থাকেন। গতকাল বিকেল ৪টার দিকে বইমেলা ঘুরে দেখেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার রীভা গাঙ্গুলী দাশ। এ সময় তাকে মেলার বিভিন্ন অংশ ঘুরিয়ে দেখান বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর তিনটি গ্রন্থ উপহার হিসেবে তুলে দেন রীভা গাঙ্গুলীর হাতে।

গতকালও জমিয়ে আড্ডা হয় লেখক-পাঠকের। লেখক বলছি মঞ্চে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন ইকবাল হাসান, ফেরদৌস নাহার, আশরাফ আহমেদ এবং জাকির জাফরান। বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সামনের মাঠে চেয়ার পেতে কিংবা ঘাসের ওপর গোল হয়ে বসে লেখকদের কথা শুনেছেন পাঠকরা। হঠাৎ মনে জেগে ওঠা প্রশ্নটি লেখকের দিকে ছুড়ে দিতেও ভুলে যাননি তারা।

এদিকে, কথাশিল্পী মোজাফ্‌ফর হোসেনের প্রথম উপন্যাস 'তিমিরযাত্রা' এসেছে মেলায়। মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা, মানবিক অবক্ষয় ও ব্যক্তিগত হতাশার নতুন গল্প নিয়ে এই উপন্যাস লেখা। প্রচ্ছদ এঁকেছেন গৌতম ঘোষ। উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে পাঞ্জেরী পাবলিকেশনস।

নতুন বই : গতকাল নতুন বই এসেছে ২০৭টি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আহমদ মমতাজ ও রাইহান নাসরিনের 'বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী' (বাংলা একাডেমি), সেলিনা হোসেনের 'স্মরণে শেখ মুজিব' (আগামী), অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরীর 'মুক্তিযুদ্ধ ও মুজিব বাহিনী (মিজান পাবলিশার্স), আহসান হাবীবের 'জাস্ট জোক্‌স' (রাত্রি প্রকাশনী), আলী ইমামের 'রূপোলি আলো' (দি রয়েল পাবলিশার্স), আবুল খায়েরের সম্পাদনায় 'বাংলাদেশ গণপরিষদের কার্যবিবরণী ও প্রাসঙ্গিক তথ্য' (র‌্যামন পাবলিশার্স), সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের 'অলস দিনের হাওয়া' (অরিত্র প্রকাশনী), জি. এম. তারিকুল ইসলামের সম্পাদনায় 'বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিচিত্র রচনাসম্ভার' (গ্রন্থকুটির), সৈয়দ আবদাল আহমদের 'বুড়িগঙ্গা তীরের রহস্যনগরী' (টুনটুনি প্রকাশন), আবদুল খালেকের 'ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ' (মিজান পাবলিশার্স), হাসিনা মমতাজের 'বিবর্ণ রঙ' (বর্ণক), রাইহান নাসরিনের 'আটপৌরে জীবনের কথা' (অক্ষর প্রকাশনী), মশিউল আলমের 'দুধ' (মাওলা ব্রাদার্স), মাজেদুল নয়নের 'হাউজ টিউটর' (পুঁথিনিলয়)।

মঞ্চের আয়োজন : বিকেল ৪টায় অনুষ্ঠিত হয় সাইমন জাকারিয়া রচিত 'সাধক কবিদের রচনায় বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতি' শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ পাঠ করেন সুমনকুমার দাশ। আলোচনায় অংশ নেন নাসির আহমেদ। লেখকের বক্তব্য প্রদান করেন সাইমন জাকারিয়া। সভাপতিত্ব করেন কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা।

গ্রন্থের লেখক বলেন, এ দেশের অবহেলিত বিস্মিত লোকসাধক ও কবিগণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে ছিলেন সদাসচেতন। এসব সাধক কবির পরিচিতিতেই বিশ্বের কাছে বাংলা সংস্কৃতি আজ মর্যাদার আসন পেয়েছে।

মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, বাংলার লোকসাধকদের নির্মল ও নিঃস্বার্থ ভাষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমগ্র জীবন উঠে এসেছে। সাধক কবিগণ বাংলার বৃহত্তর লোকসমাজের প্রতিনিধি।

কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠ করেন কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, মাহমুদ আল জামান, ইকবাল হাসান, আশরাফ আহমেদ, জাফর আহমদ রাশেদ, ফারুক আহমেদ এবং রাসেল রায়হান। সন্ধ্যায় ছিল শাহাবুদ্দিন আহমেদ দোলনের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন 'সুর সুধা সংগীতায়ন' এবং শাহ্‌ সাদিয়া আফরিন মল্লিকের পরিচালনায় 'হামিবা সাংস্কৃতিক একাডেমি'র পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন লুভা নাহিদ চৌধুরী, সালাউদ্দিন আহমেদ, সাজেদ আকবর, সালমা আকবর, প্রমোদ দত্ত এবং আবিদা রহমান সেতু। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন সুবীর চন্দ্র ঘোষ (তবলা), অসিত বিশ্বাস (এসরাজ), ইফতেখার হোসেন সোহেল (কি-বোর্ড), নাজমুল আলম খান (মন্দিরা)।