'সে ভুলে ভুুলুক, কোটি মন্বন্তরে/আমি ভুলিব না, আমি কভু ভুলিব না।' এটি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের 'শাশ্বতী' কবিতার শেষ দুই লাইন। বইমেলার সঙ্গে এই কবিতার সরাসরি কোনো সংযোগ নেই, আবার আছেও। করোনা মহামারিকালে গতকাল শুক্রবার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিনে বইপ্রেমী মানুষের যে ঢল নেমেছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, তা দেখে শাশ্বতী কবিতার শেষ দুটি লাইনই বারবার মনে পড়ে। মহামারিও এদিন ঠেকাতে পারেনি বইয়ের প্রতি ভালোবাসাকে। তাই মেলার নবম দিনে এসে ফিরে পেয়েছে তার পুরোনো যৌবন। এতে প্রতিদিন সকালে তেমন জনসমাগম না থাকলেও বিকেলে পূর্ণ হয় লোকসমাগমে। শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশের দর্শনার্থী বইমেলায় আসছেন। মহামারিকালে যেখানে অনেকেই আতঙ্কে ঘরে থাকছেন, সেখানে সবকিছু একপাশে রেখে অনেকেই এদিন ছুটেছেন বইমেলায়। মেলায় প্রবেশের ক্ষেত্রে মাস্ক থাকার বাধ্যবাধকতা থাকলেও প্রাঙ্গণে কিন্তু তার বালাই ছিল না। অনেককেই দেখা গেছে মাস্ক ছাড়া ঘুরে বেড়াতে।
চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার বইমেলায় এসেছেন বিভা ইন্দু। এবারের বইমেলায় লিটলম্যাগ প্রতিষ্ঠান 'দেয়াঙ' থেকে 'এক চিলতে ভেজা উঠোন' নামে তার একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। বইমেলার লিটলম্যাগ চত্বরে দেখা হয় তার সঙ্গে। সরকারি স্কুলের এই শিক্ষক বলেন, 'সকালে ঢাকায় পৌঁছার পর আমার ছেলে অভিমান করেই বলছিল এই মহামারির মধ্যে বইমেলায় কেন আসা লাগবে! ওকে কীভাবে বোঝাই প্রতিবছর বইমেলায় আসা আমি, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আয়োজনের বিশেষ এই মেলা কোনোভাবেই মিস করতে চাই না।' বিভা ইন্দুর মতো আরও অনেকেই গতকাল মেলায় এসেছিলেন সুবর্ণজয়ন্তীতে সাজা নতুন এই বইমেলা দেখতে।
গতকাল বিকেল থেকে বইমেলায় জায়গায় জায়গায় ছিল জটলা। তবে সবচেয়ে বেশি সমাগম হয়েছে বইমেলার বাইরে টিএসসির দিকের গেটের সামনে। এখানে দর্শনার্থীদের দেশাত্মবোধক গান বাজিয়ে শুনিয়েছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের সদস্যরা। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা একজন বিজিবি সদস্য বলেন, 'আমাদের বাহিনীর ৩৩ জন সদস্য এখানে অংশ নিচ্ছেন। স্বাধীনতা দিবসে এমনভাবেই আমরা আমাদের অনুশীলন করি।'
থিয়েটারবিষয়ক লিটলম্যাগ 'ক্ষ্যাপা'র সম্পাদক পাভেল রহমান বলেন, 'এ বছরের বইমেলা শুরুর পর থেকে আজকে (শুক্রবার) মেলায় লোকসমাগম হয়েছে সবচেয়ে বেশি।' আর অবসর প্রকাশক আলমগীর রহমান সমকালকে জানান, অন্যদিনের তুলনায় আজকে (শুক্রবার) আমাদের বিক্রিও বেড়েছে। আশা করছি, সামনের দিনগুলোতে এমন রীতিই বজায় থাকবে।
গতকালের বইমেলায় নতুন বই এসেছে ২৭৬টি। এর মধ্যে গল্পের ৩৭টি, ৪৭টি উপন্যাস, প্রবন্ধের ১২টি, কবিতার ৯৫টি, গবেষণার ৭টি, ছড়ার ৪টি, ৩টি শিশুসাহিত্য, ৯টি জীবনীর, মুক্তিযুদ্ধের ১১টি, বিজ্ঞানের ৪টি, ভ্রমণের ২টি, ইতিহাসের ১টি, রাজনীতির ২টি, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ৮টি, রম্য/ধাঁধার ৪০টি, ধর্মীয় ২টি, অনুবাদ ২টি, সায়েন্স ফিকশন ২টি এবং অন্যান্য ২৪টি। এর মধ্যে কথাপ্রকাশ এনেছে মোঃ আবদুল হামিদের ভূমিকায় ও মুস্তাফিজ শফি সম্পাদিত প্রবন্ধ 'মুজিব কেন জরুরি', সেলিনা হোসেনের 'ছোটদের বঙ্গবন্ধু', রামেন্দু মজুমদারের 'শতবর্ষে বঙ্গবন্ধু ও বিবিধ ভাবনা', আগামী এনেছে আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী, মোনায়েম সরকার ও সৈয়দ জাহিদ হাসানের যৌথ সম্পাদনায় 'একাত্তরের ঐতিহাসিক মার্চ শতপ্রবন্ধ', আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর 'বঙ্গবন্ধু-মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের রাজনীতি', পাঞ্জেরী এনেছে সঙ্গীতা ইমামের 'স্বাধীনতা ও আত্মজার গল্প' প্রহেলিকা প্রকাশন এনেছে হাবীবুল্লাহ সিরাজীর 'হাওয়া কলে জোড়া-গাড়ি' ইত্যাদি।
স্বাধীনতা দিবস ও মূল মঞ্চের আয়োজন :মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে গতকাল সকালে বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে শিখা চিরন্তনে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। বিকেলে বইমেলার মূল মঞ্চে 'স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী :স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০ বছরের অভিযাত্রা' শিরোনামে আলোচনা সভা হয়। এতে স্বাগত বক্তব্য দেন একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মফিদুল হক। আলোচনায় অংশ নেন শাহরিয়ার কবির এবং মোহাম্মদ হান্‌নান। এতে সভাপতিত্ব করেন একাডেমির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান।
এ ছাড়াও গতকাল লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের বই নিয়ে আলোচনা করেন চঞ্চল আশরাফ, হামিম কামাল, চৌধুরী শহীদ কাদের। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী রূপা চক্রবর্তী, রফিকুল ইসলাম। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী মৌটুসী পার্থ, সন্দীপন দাশ এবং তানভীর আলম সজীব।
আজকের অনুষ্ঠান :আজ বইমেলার দশম দিনে মেলা চলবে সকাল ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে 'স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী : বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতি' বিষয়ক আলোচনা সভা হবে। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন জালাল ফিরোজ। আলোচনায় অংশ নেবেন আশফাক হোসেন ও সাব্বির আহমেদ। এতে সভাপতিত্ব করবেন মইনুল কবির।