বসন্তের প্রথম দিনের ঢেউ জেগেছিল বইমেলার প্রথম দিনেও। মেলার উদ্বোধন হচ্ছিল ভার্চুয়ালি, তাই ছিল না কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী। এদিকে বসন্তের মিষ্টি রোদ ছড়িয়েছিল পথে। প্রাণের মেলার টানে তাই অনেকেই বেরিয়ে পড়েছিলেন দুপুরের সূর্য খানিকটা হেলে পড়তেই। বাংলা একাডেমির মূল প্রাঙ্গণে প্রবেশের ক্ষেত্রে একটু কড়াকড়ি থাকলেও তারা অনায়াসেই প্রবেশ করতে পারছিলেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বইমেলা প্রাঙ্গণে।

তবে সেখানে এখনও শেষ হয়নি প্রকাশকদের প্রস্তুতি পর্ব। মেলা হবে কিনা— এ অনিশ্চয়তাই স্টল নির্মাণের প্রস্তুতিকে পিছিয়ে দিয়েছে। ছোট-মাঝারি অনেক স্টল তো বটেই, প্রথম দিনের শেষ বিকেলে দেখা গেল, ‘অন্যপ্রকাশ’ কিংবা ‘পাঞ্জেরী’র মতো প্রকাশনীর প্যাভিলিয়ন নির্মাণের কাজ চলছে। মাওলা ব্রাদার্সের প্যাভিলিয়নে প্রকাশনীর সংগঠকরা ব্যস্ত ছিলেন বই গোছাতে। 

ছোট এক প্রকাশনীর প্রকাশক জানালেন, ‘ভাই, স্টল পাওয়ার আবেদনের টাকা দিয়ে ফেলেছি। ফেরত পাওয়ার উপায় নাই। নইলে এই মেলায় হয়তো অংশ নিতাম না।’

প্রস্তুতি পর্ব শেষ হয়নি বলে মেলা প্রাঙ্গণও অপরিচ্ছন্ন, অগোছালো ছিল মঙ্গলবার। প্রাঙ্গণে পড়ে ছিল কাঠ ও বাঁশের টুকরো, ছেঁড়া দড়ি, নানা নির্মাণ উপকরণ। হাতুড়ি ও করাতের শব্দও শোনা যাচ্ছিল শান্ত বিকেলে। কোথাও কোথাও এখনও ইটের সারি ও বালুর ঢিবির অস্তিত্ব মনে করিয়ে দিচ্ছিল, বেশ প্রস্তুতিহীনভাবেই এবারের মেলায় অংশ নিতে হচ্ছে প্রকাশকদের। তবে মেলা তো শুরু হয়ে গেছে, যত দ্রুত সম্ভব স্টল ও প্যাভিলিয়নের কাজ শেষ করতে মরিয়া তারা।

স্টল ও প্যাভিলিয়নের স্থান নিয়ে বরাবরের মতো এবারও অতৃপ্ত অনেক প্রকাশক— বিশেষ করে তারা, যারা স্টল পেয়েছেন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের গেটের পরে জাদুঘরের পাশের লেকের ধারে। তবে সন্ধ্যার পর এ স্থানেও ছিল প্রচুর মানুষের ভিড়। 

এবার লিটল ম্যাগ প্রাঙ্গণ নির্ধারিত হয়েছে বেশ সুবিধাজনক স্থানে। যদিও এখন পর্যন্ত সেখানে কোনো স্টলের নির্মাণকাজই শেষ হয়নি। 

বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে দেখা গেল, সেখানে বৈদ্যুতিক সংযোগ দেওয়ার কাজে ব্যস্ত ইলেকট্রিশিয়ানরা। কোনো কোনো লিটল ম্যাগ ব্যানার টাঙালেও এখনও স্টল সাজায়নি।

প্রথম দিন— তাই বই বিক্রি যে হয়নি বললেই চলে, সেটা বলাই বাহুল্য। লেখকদের উপস্থিতিও ছিল না তেমন। যারা এসেছিলেন, তাদেরও দেখা গেছে সন্ধ্যার পর। সবাই ফাল্গুনের আস্বাদ নিয়েছেন খোলা প্রাঙ্গণে, আড্ডা দিয়েছেন প্রাণ খুলে। কার কী বই ছাপা হচ্ছে, আসবে কোন প্রকাশনী থেকে, বইমেলার সময় বাড়বে কিনা, করোনা পরিস্থিতি কোনদিকে গড়াবে— এসব নিয়ে আলোচনায় মেতে ছিলেন তারা।

এবার মেলা প্রাঙ্গণজুড়ে রয়েছে তিন শতাধিক ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা। করোনার কারণে দুই সপ্তাহ দেরিতে শুরু হওয়া বইমেলায় প্রবেশের ক্ষেত্রেও রয়েছে কড়াকড়ি। সবাইকে সঙ্গে রাখতে হবে টিকাসনদ, যথাযথভাবে পরতে হবে মাস্ক, তা ছাড়া মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধি। ‘টিকাসনদ দেখছেন না?’—মেলার টিএসসির দিকের প্রবেশমুখ পেরোনোর পর জিজ্ঞেস করা হয়েছিল এক পুলিশ সদস্যকে। খানিকটা থতমত খেয়ে তিনি উত্তর দিয়েছেন, ‘আজ প্রথম দিন তো। মানুষজনের সমাগমও কম। তাই কড়াকড়িও একটু কম।’

প্রথম দিন হলেও মেলায় নতুন বইয়ের কমতি ছিল না। ‘যে বইটি এখনও পড়িনি, এখনও দেখিনি, সেটি তো নতুন বই-ই’— বলতে শোনা গেল বই দেখায় ব্যস্ত এক পড়ুয়াকে। 

মেলার তথ্যকেন্দ্র এখনও বলতে গেলে চালুই হয়নি, তাই নতুন বই সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া গেল না সেখান থেকে। তবে মেলায় খোদ বাংলা একাডেমির স্টলেই দেখা গেল অনেক নতুন বই। 

বাংলা একাডেমির একজন কর্মী জানালেন, নতুন ও পুনঃপ্রকাশ মিলিয়ে তাদের বই এসেছে ১০৭টি। 

এবারের বইমেলার প্রতিপাদ্য, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী’। এ উপলক্ষে বাংলা একাডেমি প্রকাশ করছে ‘জন্মশতবর্ষ গ্রন্থমালা’ সিরিজভুক্ত বেশ কয়েকটি বই। তাম্রলিপি থেকেও ‘বঙ্গবন্ধু জন্মশতবর্ষ গ্রন্থমালা’ সিরিজের আওতায় এসেছে ৪৬টি বই। কথাপ্রকাশ এনেছে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘জাতীয়তাবাদের উদ্বিগ্ন হৃদয়’ (প্রবন্ধ), ওয়াসি আহমেদের ‘নিশিযাপন’ (ছোটগল্প), সিরাজ সালেকীনের ‘ভাটির দেশে বাঙাল’ (প্রবন্ধ), ঐতিহ্য পুনর্মুদ্রণ করেছে মওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁর ‘মোছলেম বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস’, অবসর প্রকাশনী এনেছে সংকলন ‘গল্পরথ’, গ্রন্থকুটির এনেছে হামীম কামরুল হামীমের ‘যেখানে খুঁজেছ তুমি জীবনের মানে’ (উপন্যাস), পাঠক সমাবেশ এনেছে রাশিদা সুলতানার 'শূন্যমার্গে' (উপন্যাস) এবং নিঝুম শাহ সংকলিত ও সম্পাদিত ‘নাট্যাচার্য্য বললেন’ (সাক্ষাৎকার) ইত্যাদি গ্রন্থ।

বইমেলা চলবে প্রতিদিন দুপুর ২টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার খোলা থাকবে সকাল ১১টা থেকে। তবে রাত সাড়ে ৮টার পর কাউকে মেলায় প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।