
বইয়ের মেলায় এবার মেলবন্ধ ঘটেছে ভাষা আর মুক্তিসংগ্রামের। সময় বাড়ানোর ফলে ভাষা আন্দোলনের মাস পেরিয়ে বইমেলা স্পর্শ করেছে অগ্নিঝরা মার্চকে। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ আর অসহযোগের দিনগুলোকে, জাতির পিতার জন্মদিনকে। বিভিন্ন প্রকাশনীর এবারের প্রকাশনা থেকে শুরু করে মেলার স্থাপত্য-সজ্জাতেও তাই সুস্পষ্ট স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের আবহ।
২০১৯ সাল থেকে বইমেলার নকশা করছেন স্থপতি এনামুল কবির নির্ঝর। এবারের মেলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'বাংলা একাডেমি নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে বইমেলা আয়োজন করে আসছে। তাদের সামান্য সহযোগিতার চেষ্টা করছি মাত্র। মেলা প্রাঙ্গণে যেসব স্থাপনা রয়েছে, সেসবের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ স্বাধীনতা স্তম্ভ। সেটার সঙ্গে মেলাকে সংযুক্ত করে দেওয়া একটা বড় কাজ। এতে মেলার সৌন্দর্য ও নান্দনিকতা যেমন বেড়েছে, তেমনি স্বাধীনতা স্তম্ভের মতো স্থাপনার উদ্দেশ্যও কার্যকারিতা পেয়েছে। তবে মেলায় যারা আসছে, তাদের সচেতন থাকতে হবে। যেমন- লেকের পানি যেন পরিস্কার থাকে। মাঠে কোনো ইট বিছানো হয়নি। সবকিছু প্রাকৃতিক রাখার চেষ্টা করেছি।'
তিনি বলেন, 'মেলার নকশায় এবার মূল ভাবনাটা ছিল দেশপ্রেম। মেলা যেন শুধু এক মাস বই বিক্রির জায়গায় পরিণত না হয়। আমাদের জাতিগত সংস্কৃতিচর্চার যে জায়গাটা আছে, সেটা আমরা কতটা উজ্জীবিত করতে পারি- সে বিষয়টার দিকে নজর রাখা হয়েছে।'
মেলায় বই কিনতে এসে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুবিষয়ক গ্রন্থ বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন, এমন পাঠক অনেক। অনন্যা প্রকাশনীর প্যাভিলিয়নের সামনে পাওয়া গেল এমন এক পাঠক আবুল হাশমীকে। মিরপুর থেকে আসা হাশমী নেড়েচেড়ে দেখছিলেন অনন্যা থেকে প্রকাশিত অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেনু সম্পাদিত 'দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময়-১৯৭৫'। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও ইতিহাস সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা অর্জন করতে পারলে আমাদের রাজনীতির ভবিষ্যৎ সুন্দর হয়ে উঠবে।
অনন্যা এবার আরও এনেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই মুনতাসীর মামুনের 'একাত্তরের বন্ধু যারা' ও 'গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-২৮', ইমদাদুল হক মিলনের 'মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসসমগ্র' ও '১৯৭১', সুভাষ সিংহ রায়ের 'মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু পরিবার', সুরমা জাহিদের 'কিশোরীদের দেখা একাত্তরের ভয়াবহ স্মৃতি', মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামানের 'যুক্তফ্রন্ট ও বঙ্গবন্ধু' ইত্যাদি।
পার্ল প্রকাশনীর প্রকাশক হাসান জাহিদি বললেন, আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা, ৭ মার্চ, বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নতুন প্রজন্মকে জানানো উচিত। মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাসের ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত। নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানও গবেষণার মাধ্যমে তুলে নিয়ে আসা প্রয়োজন।
কবি মনিরুজ্জামান মিন্টু বললেন, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে অনেক লেখা হচ্ছে। প্রকাশকরাও বই ছাপছেন। এত বইয়ের ভিড়ে অনেক ভুল তথ্যও যোগ হচ্ছে। গবেষণা ছাড়াই অনেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখছেন। তাতে ভুল হচ্ছে বেশি। তবে এর মধ্যে অনেক ভালো লেখাও আসছে।
প্রাইম ইউনিভার্সিটির বাংলা বিভাগের শিক্ষক অয়নিকা আলপনা জানালেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রকাশনার ক্ষেত্রে সম্পাদনার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কারণ, ভুল ইতিহাস লেখা হলে নতুন প্রজন্ম ভুল শিখবে।
এবারের মেলায় ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ প্রকাশ করেছে আগামী, সময়, কথাপ্রকাশ, মাওলা ব্রাদার্স, প্রথমা, বাতিঘর, সাহিত্যপ্রকাশ, পুথিনিলয়, পার্ল, বাংলাপ্রকাশ ইত্যাদি প্রকাশনী।
গতকাল রোববার ছিল অমর একুশে বইমেলার ২০তম দিন। মেলা চলে বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। আজ নতুন বই এসেছে ৪৬টি।
আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান: বিকেল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় 'জন্মশতবার্ষিকী শ্রদ্ধাঞ্জলি :নীলিমা ইব্রাহিম' শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নিশাত জাহান রানা। আলোচনা করেন আজিজুর রহমান আজিজ ও আহমেদ মাওলা। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক মনিরুজ্জামান।
প্রাবন্ধিক বলেন, একাত্তর-পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের তথ্যভিত্তিক যে ন্যারেটিভগুলো তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে হৃদয়স্পর্শী রচনাগুলোর অন্যতম 'আমি বীরাঙ্গনা বলছি'। বস্তুনিষ্ঠ তথ্যভিত্তিক এই অসামান্য গ্রন্থটি রচনার ভেতর দিয়েই নীলিমা ইব্রাহিম ইতিহাসের পাতায় তার নাম খোদাই করেছেন নিশ্চিতভাবে। তবে এই গ্রন্থ রচনার বহু আগে থেকেই নীলিমা ইব্রাহিম তার জীবনকে উৎসর্গ করেছেন বৃহত্তর মানুষের জীবনের মুক্তির সংগ্রামে। আজ থেকে একশ বছর আগে জন্মগ্রহণকারী এই অসামান্য নারী একটি সুস্থ, সমৃদ্ধ, সংবেদনশীল এবং মানবিক সমাজ বিনির্মাণে একটার পর একটা মাইলফলক অর্জন করেছেন তার দীর্ঘ পথচলায়।
আলোচকবৃন্দ বলেন, বাঙালি নারীসমাজের কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন নীলিমা ইব্রাহিম। নারীমুক্তি ও মানবপ্রগতির ব্যাপারে তিনি সারাজীবন সক্রিয় থেকেছেন। বাংলা একাডেমির প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র নারী মহাপরিচালক হিসেবেও তিনি আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসের সম্মানের স্থান করে নিয়েছেন।
সভাপতির বক্তব্যে মনিরুজ্জামান বলেন, অধ্যাপক নীলিমা ইব্রাহিম ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী এবং জ্ঞানপিপাসু। তার মাতৃবৎসলতার কারণে শিক্ষার্থীদের কাছে ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। সামাজিক সচেতনতা ও নারীমুক্তির সার্থক প্রকাশ ঘটেছিল তার মধ্যে।
'লেখক বলছি' অনুষ্ঠানে নিজেদের বই নিয়ে আলোচনা করেন সালমা বাণী ও সাইমন জাকারিয়া। অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি জাহিদ মুস্তাফা ও নাসরীন নঈম। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী শাকিলা মতিন মৃদুলা ও মো. মাহমুদুল হাকিম। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছিল সাংস্কৃতিক সংগঠন 'সংগীত ভবন'-এর পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী খুরশিদ আলম, মুর্শিদ আনোয়ার, আঞ্জুমান আরা শিমুল, ফারহানা শিরিন, চম্পা বণিক, অনন্যা আচার্য্য, মো. রেজওয়ানুল হক ও মেহেরুন আশরাফ। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ পাল, দীপঙ্কর রায়, শাহরাজ চৌধুরী ও ইফতেখার হোসেন সোহেল।
আজকের অনুষ্ঠান: আজ সোমবার অমর একুশে বইমেলার ২১তম দিন। মেলা চলবে বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ স্মরণে অনুষ্ঠিত হবে 'বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ :বহুমাত্রিক পরিপ্রেক্ষিত' শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। আলোচনায় অংশ নেবেন মো. নজরুল ইসলাম খান ও মনজুরুল আহসান বুলবুল। সভাপতিত্ব করবেন বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। সন্ধ্যায় রয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
মন্তব্য করুন