
যাকে বলে সরগরম- বইমেলার ২৫তম দিনে, শেষ শুক্রবারে গতকাল ছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মেলা প্রাঙ্গণে এমন অবস্থা। পছন্দসই বই সংগ্রহ করতে সকালেই জমে ওঠে মেলা প্রাঙ্গণ। পরিবার-পরিজন নিয়েও আসেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। শিশুরা আরেকবার ইকরি-হালুমকে কাছে পেয়ে ছিল উচ্ছ্বসিত। বেচাকেনাও হয়েছে ভালো। লেখক-পাঠক আর প্রকাশকের মিলনমেলা সব মিলিয়ে ছিল জমজমাট।
তবে চাপা ক্ষোভও ছিল প্রকাশকদের মধ্যে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মেলা প্রাঙ্গণ বাড়িয়ে স্টলগুলো ছড়িয়ে দেওয়া হলেও লেকপাড়ে প্যাভিলিয়নগুলোকে রাখা হয়েছে একপাশে। এতে মেলার জনসমাগম হয়ে পড়েছে এককেন্দ্রিক। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের দিকের স্টল-প্যাভিলিয়নগুলোতে মেলার শুরু থেকেই ক্রেতাদের আনাগোনা কম। গত বছরের বইমেলা থেকেই এ দিকটি পরিচিতি পেয়েছে 'ভাসানচর' নামে। এ অংশের স্টলগুলোয় ক্রেতাদের আনাগোনা একটু কম। স্টল বরাদ্দের এ অব্যবস্থাপনায় ক্ষুব্ধ প্রকাশকরা।
কথা হলো প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক আহমাদ মাযহারের সঙ্গে। বইমেলার টানে সুদূর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ছুটে এসেছেন তিনি। কথায় কথায় বললেন, অন্য সময় দেশে ফিরলে অনেকের সঙ্গেই দেখা না হওয়ার অপূর্ণতা থাকে। কিন্তু বইমেলায় সবার সঙ্গেই দেখা হয়ে যায়। কয়েক বছর ধরে তাই এ সময়েই দেশে ফিরি। এবারের মেলায় অনন্যা প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছে তার নতুন বই 'আমেরিকান বাঙালির মন'। অনেকেই আগ্রহী হয়ে উঠেছেন এ বইটির ব্যাপারে।
ছুটির দিনে পরিবার নিয়ে বইমেলায় এসেছেন সরকারি কর্মকর্তা আলতাফ হোসেন। সঙ্গে তার দুই মেয়ে মৌমিতা ও প্রান্তিকা। এতদিন টিভিতে দেখলেও গতকালের মেলায় সিসিমপুর সামনে থেকেই দেখেছে তারা। দেখেছে ইকরি ও হালুমকে। তাদের সঙ্গে ছবিও তুলেছে। আলতাফ হোসেন জানালেন, এর আগেও একদিন এসেছিলেন। এবার তিনি আলী রিয়াজের 'ভয়ের সংস্কৃতি'সহ বিভিন্ন বই কিনেছেন। মেয়েরা কিনেছে শিশুতোষ নানা বই।
ঝুমঝুমি প্রকাশনীর প্রকাশক শায়লা রহমান তিথি জানালেন, মেলার পূর্ব পাশটা বলতে গেলে অবহেলিত। এদিকটায় আলোও বেশ কম। অভিযোগ করার পরও তা ঠিক করা হয়নি। এ অংশে ক্রেতাদের আনাগোনাও কম। প্রসঙ্গত, মেলার পূর্ব দিকে রয়েছে অনুপম, পুথিনিলয়, কাকলী, আকাশসহ বিভিন্ন প্রকাশনীর স্টল ও সময় প্রকাশনীর প্যাভিলিয়ন।
অনন্যা প্রকাশনের প্রকাশক মো. মনিরুল হক বলেন, প্রথমে শঙ্কা থাকলেও মেলা অনেক ভালো যাচ্ছে। আজ শেষ শুক্রবারের সকাল থেকেই ক্রেতা-পাঠকের উপস্থিতি ভালো। অনন্যা প্রকাশনী থেকে ইমদাদুল হক মিলনের 'অচিন ফুলের গন্ধ', আনিসুল হকের 'কিশোর অভিযানসমগ্র' ও নিশাদ ইসলামের 'মন' পাঠক মহলের মধ্যে ভালো সাড়া জাগিয়েছে।
তবে মনিরুল হক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মেলা প্রাঙ্গণের আয়তন বাড়ানো ঠিক হয়নি। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের দিকে মেলার পূর্বপাশের স্টলগুলো অনেকটাই অবহেলিত। অনেকে এ অংশের নাম দিয়েছেন ভাসানচর। অথচ উদ্যানের এই অংশেই সব স্টল রাখা সম্ভব।
আগামী প্রকাশনীর প্রকাশক ওসমান গণিও বললেন, এবারের মেলায় কিছু অংশের অবস্থা খুবই খারাপ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এ পাশে অনেক জায়গা খালি। অথচ পূর্বদিকে ভাসানচরের সৃষ্টি হলো। আমি মনে করি মূল মাঠেই সুন্দর করে মেলা আয়োজন সম্ভব। এত বিশাল জায়গাজুড়ে মেলা আয়োজনের প্রয়োজন নেই। এতে কিছু প্রকাশনা প্রতি বছর লাভবান হয়। কিছু প্রকাশনা ক্ষতির শিকার হয়।
রোদেলা প্রকাশনীর ব্যবস্থাপক মহিউদ্দিন আকন্দ রাসেল জানালেন, মেলায় ক্রেতাদের উপস্থিতি থাকলেও এখনও কেনাবেচা আগের মেলাগুলোর তুলনায় কম। আগে এক থেকে দেড় লাখ টাকার বই বেচাকেনা হতো, এখন সেটা ৩০-৪০ হাজারে নেমে এসেছে। আগে বই উপহারের রেওয়াজ ছিল, এখন সেই সংস্কৃতিরও পরিবর্তন ঘটেছে।
লিটলম্যাগ চত্বর মেলা শেষের সপ্তাহেও জমে ওঠেনি। তবে ছোটকাগজ একান্নবর্তীর প্রকাশক শেলী সেন গুপ্তা বলেন, কেনাবেচা কম হলেও এ চত্বরে আনন্দটা অনেক বেশি। আমার স্টলে দিনে চার থেকে পাঁচটি পত্রিকাও বিক্রি হয় না। তবে এতেই আমি খুশি। বেচাকেনা না থাকলেও এখানে আনন্দ অনেক। সন্ধ্যা হলে আমরা মাটিতে বসেই গানের আসর জমাই।
মেলা আয়োজক কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ বলেন, মেলার জন্য সার্বিকভাবে চিন্তা করতে হবে। মেলায় উন্মুক্ত জায়গাও রাখতে হবে। স্থায়ী বা অস্থায়ী যেমন স্থাপনাই হোক না কেন, তা নির্মাণ করতে বৈজ্ঞানিকভাবে ভাবতে হবে। বইমেলায় শুধু সাধারণ দিনগুলোর কথা বিবেচনা করে জায়গা ফাঁকা রাখা হয়নি। শুক্র-শনিবার, ১৩ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২১ ফেব্রুয়ারি, ৭ মার্চ এবং ১৭ মার্চের ভিড়কে চিন্তা করেই জায়গা ফাঁকা রাখা হয়েছে।
গতকাল মেলা চলেছে সকাল ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত মেলায় ছিল শিশুপ্রহর। আজ নতুন বই এসেছে ৩১২টি।
আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান: বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় 'নান্দনিক সমাজ গঠনে আবৃত্তির ভূমিকা' শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নিমাই মণ্ডল। আলোচনায় অংশ নেন লায়লা আফরোজ এবং শাহাদাৎ হোসেন নিপু। সভাপতিত্ব করেন কবি জাহিদুল হক।
'লেখক বলছি' অনুষ্ঠানে নিজেদের বই নিয়ে আলোচনা করেন ড. মাসুদুজ্জামান এবং ড. মো. আলমগীর।
আজকের অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি নাহার আহমেদ এবং রাসেল আশেকী। সাংস্কৃতিক পর্বে ছিল রাজেশ দাসের পরিচালনায় 'উঠোন', সুকান্ত গুপ্তের পরিচালনায় 'শ্রুতি সিলেট' এবং মো. হায়দার আলীর পরিচালনায় 'কৃষ্টিবন্ধন'-এর পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী আলী হোসাইন এবং মো. রফিকুল ইসলাম। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন অভিজিৎ রায়, মো. হোসেন আলী এবং শ্যামা প্রসাদ মজুমদার।
আজকের অনুষ্ঠান: আজ শনিবার অমর একুশে বইমেলার ২৬তম দিন। মেলা চলবে সকাল ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত থাকছে 'শিশুপ্রহর'। বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে রয়েছে 'একুশের গল্প ও উপন্যাস' শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন রফিকুর রশীদ। আলোচনায় অংশ নেবেন পাপড়ি রহমান এবং স্বকৃত নোমান। সভাপতিত্ব করবেন ইমদাদুল হক মিলন। সন্ধ্যায় রয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
মন্তব্য করুন