নির্দিষ্ট সময়ের দুই সপ্তাহ পর শঙ্কার মধ্যেই শুরু হয়েছিল এবারের বইমেলা। যদিও করোনা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটায় পরবর্তী সময়ে মেলার সময়সীমা দুই সপ্তাহ বাড়ানো হয়। বইমেলার প্রথম দিন থেকেই পাঠক-ক্রেতার উপস্থিতি প্রাঙ্গণকে মুখর করে তোলে। মেলাপ্রাঙ্গণের পরিসর বড় হওয়ায় এবং সময় বাড়িয়ে দেওয়ায় করোনাকালীন ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার আশায় বুক বেঁধেছিল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু মেলার শেষ দিকে এসে তারা বলছেন, বই বিক্রির প্রত্যাশা পূরণ হয়নি তাদের।

জার্নিম্যান বুকসের মানবসম্পদ কর্মকর্তা শুভ জানালেন, শেষ সপ্তাহে এসে বই বিক্রির যে প্রত্যাশা থাকে, সেটা পূরণ হয়নি আমাদের। অবশ্য আমাদের কিছু স্বতন্ত্র সংগ্রহ থাকার কারণে নির্দিষ্ট লেখকদের বই বেশ বিক্রি হচ্ছে। তবে শেষ সাত দিনে হুলুস্থূল বিক্রির ব্যাপারটা এবারের মেলায়, অন্তত আমাদের মেলায় দেখা যাচ্ছে না।
ঐতিহ্যের ব্যবস্থাপক আমজাদ হোসেন খান কাজল বলছিলেন, ফেব্রুয়ারির মেলা মার্চে গড়ানোর বিষয়টিকে অনেক পাঠক বা ক্রেতা ভালোভাবে নেননি। তবু শেষ শুক্রবার ভালো বেচাবিক্রির আশা ছিল আমাদের। কিন্তু সেই আশা পূরণ হয়নি। তবে মেলা যেহেতু চলছে, শেষ হওয়া পর্যন্ত থাকতেই হবে।
গত বছরের তুলনায় এ বছরের মেলাকে 'মন্দের ভালো' হিসেবে আখ্যায়িত করছেন প্রকাশকরা। গত শুক্র ও শনিবার ক্রেতার দেখা মিললেও সাধারণ দিনগুলোতে তেমন মিলছে না। তবে তাম্রলিপি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী এ কে এম তারিকুল ইসলাম রনি এখনও প্রত্যাশা করছেন, শেষ সময়ে ক্রেতার দেখা মিলবে। তিনি বলেন, করোনায় প্রকাশকদের যে ক্ষতি হয়েছে, তা আগামী দশ বছরেও পূরণ হবে না। এবার এই ক্ষতি আমরা খানিকটা কাটাতে পারব কিনা জানি না। তবে ক্রেতা বাড়লে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারব।

বাংলা প্রকাশের ব্যবস্থাপক নুরুন্নবী চৌধুরী বলেন, আশানুরূপ বিক্রি করতে পারিনি শেষ সপ্তাহেও। আসলে ফেব্রুয়ারির মেলা ফেব্রুয়ারিতে করাই সব থেকে ভালো। মার্চের গরম আর সামনে টানা তিন দিন সরকারি ছুটি মিলিয়ে মানুষ এখন ঢাকা ছাড়ছে। এই অবস্থায় মেলার বাকি ক'দিন আর কেমন বিক্রি হবে, সেটা খুব সহজেই বোঝা যায়।
গতকাল মঙ্গলবার ছিল অমর একুশে গ্রন্থমেলার ২৯তম দিন। মেলা চলে বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। নতুন বই এসেছে ১২১টি। নতুন বইয়ের মধ্যে রয়েছে- ওয়াসী আহমেদের 'রৌদ্র ও ছায়ার নকশা' ও হরিশংকর জলদাসের 'দুর্যোধন' (কথাপ্রকাশ), পারভেজ হোসেনের 'সুবর্ণপুরাণ' (সংবেদ), মোহাম্মদ নাজিমউদ্দিনের 'নেক্সট' (বাতিঘর), রাসেল আশেকীর 'নামহীন মহাকাব্য' (শান্তির প্রবেশ), কিযী তাহনিনের 'দেড় নম্বরী' (পাঠক সমাবেশ), জয়দীপ দে'র 'উদয়ের পথে' (কবি) ইত্যাদি।

আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান :বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় 'ভাষাসংগ্রামী অজিত কুমার গুহ :জীবন ও কর্ম' শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন হাসান ইমাম মজুমদার। আলোচনায় অংশ নেন জাফর ওয়াজেদ, মোহাম্মদ জয়নুদ্দীন এবং রাজীব সরকার। সভাপতিত্ব করেন বেগম আকতার কামাল।
সভাপতির বক্তব্যে বেগম আকতার কামাল বলেন, ছাত্রদের মধ্যে আদর্শ একটি জীবনচেতনা গড়ে তোলাই ছিল অজিত কুমার গুহের শিক্ষক জীবনের লক্ষ্য। অসাম্প্রদায়িক চেতনার এই বিরল মানুষ বহু অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন। মানবতাবাদী, দেশপ্রেমী ও উদার মানসিকতার অধিকারী অজিত কুমার গুহের আদর্শ অনুসরণ করেই আগামীর পথে অগ্রসর হতে হবে।
সন্ধ্যা ৬টায় বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে আগামী প্রকাশনীর বঙ্গবন্ধু-মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলনবিষয়ক ১০টি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। বইগুলোর মধ্যে রয়েছে- আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর 'ইডিপাসের গল্প এবং বাংলাদেশ', মেসবাহ কামাল সম্পাদিত 'একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবী :মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নির্মাণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়' (দুই খণ্ড), আনোয়ারা সৈয়দ হকের 'বঙ্গমাতা ও দুই কন্যার কথা' এবং 'রাসেল তার আব্বুর হাত ধরে হেঁটে যায়', মোনায়েম সরকারের 'বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ', মো. শহীদুল্লাহ সিকদারের 'স্বপ্নপূরণে সুশাসন', বিভুরঞ্জন সরকারের 'বঙ্গবন্ধু :ইতিহাসের নির্মাতা', এম আবদুল আলীমের 'রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন :জেলাভিত্তিক ইতিহাস' এবং সিরাজুল ইসলাম মুনিরের 'রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি'।
'লেখক বলছি' মঞ্চ :'লেখক বলছি' অনুষ্ঠানে নিজের বই নিয়ে আলোচনা করেন আহমাদ মোস্তফা কামাল।

গতকালের অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি রাম চন্দ্র দাস, মোতাহের হোসেন মাহবুব, আয়শা জাহান নূপুর এবং ইসমাত শান্তি। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী রাশেদ হাসান, সুবর্ণা আরফীন, নাসিমা খান বকুল, ফারজানা করিম এবং রুমা সরকার। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছিল ফয়জুল্লাহ সাঈদ পরিচালিত 'ঢাকা স্বরকল্প', অতনু করণজাই পরিচালিত 'ভোলা থিয়েটার', মো. মাসুম হুসাইন পরিচালিত 'পরম্পরা নৃত্যালয়' এবং সুফী ব্যান্ড 'আনজুমানে রহমানিয়া মইনীয়া মাইজভান্ডারীয়া'র পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী সাধিকা সৃজনী তানিয়া।

আজকের অনুষ্ঠান :আজ বুধবার অমর একুশে গ্রন্থমেলার ৩০তম দিন। মেলা চলবে বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে 'শহীদ জননী জাহানারা ইমাম :আমৃত্যু সংগ্রামী এক মহাপ্রাণ' শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন তপন পালিত। আলোচনায় অংশ নেবেন সাবিহা পারভীন, জয়দুল হোসেন এবং আহমেদ আহসানুজ্জামান। সভাপতি করবেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ।