
ঝলমলে রোদ। বইছে মধ্য-ফাল্কগ্দুনের মৃদুমন্দ হাওয়া। টিএসসি মোড়ে নেমে মেট্রোরেলের কংক্রিটের নিচ দিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটার পর চোখে পড়ল সবুজ। গাছগুলো ঝরিয়ে দিচ্ছে তাদের পুরাতন পাতা। জেগে উঠেছে নব কিশলয়। সেই পাতা-বৃষ্টির নিচ দিয়ে সবাই ঢুকছে মেলা প্রাঙ্গণে। কোথাও কোনা তাড়া নেই। কেননা, বইমেলা তো আজই শেষ হয়ে যাচ্ছে না; হিসাবমতো যা হওয়ার কথা ছিল।
গতকাল সোমবার বইমেলায় ঢুকে প্রথমেই চোখে পড়ল লেখক-শিল্পী-পাঠক-প্রকাশকদের মধ্যে জেগে ওঠা নতুন উদ্দীপনা। মেলার মেয়াদ বাড়িয়ে ১৭ মার্চ পর্যন্ত করায় তাদের শরীরী ভাষায়ও যেন ফুটে উঠেছে আনন্দ-উচ্ছ্বাসের অনুভূতি। তাদের সঙ্গে কথা বলে এবারের বইমেলাকে বিভিন্ন দিক থেকে পরখ করাও হলো। বইমেলা নিয়ে তাদের অনুভূতি, ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি-বিচ্যুতি, প্রকাশনা সংস্থাগুলোর সম্পাদনাসহ নানা বিষয়ে তাদের অভিমত জানা হলো। তবে এবারের বইমেলা যে অনেক সাজানো-গোছানো, পরিপাটি- তা প্রায় সবাই স্বীকার করলেন।
ডিএমপির কল্যাণ ও ফোর্স ডিভিশনে চাকরি করেন শামীমা বেগম। এ পুলিশ সদস্য তার দুই মেয়ে জারিফা সারাহ ও মাহরিন সওদাকে নিয়ে এসেছেন মেলায়। ৫ম ও ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী এ শিশু দুটির চোখেমুখে আনন্দের ঢেউ। তাদের পছন্দ গল্পের বই। মেলায় ঘুরতে ঘুরতে বই পছন্দ করছে বলে জানাল তারা।
বাতিঘরের স্বত্বাধিকারী দীপঙ্কর দাশ বললেন, শেষ পর্যন্ত এটি একটি সফল বইমেলা হবে, মনে হয়। মেলা আগের যে কোনো সময়ের চাইতে গোছানো। তবে লিটল ম্যাগাজিন চত্বর আরেকটু পরিকল্পিত হতে পারত। মেলায় এবার চা খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। এটা দুঃখজনক। বইমেলায় লেখক-পাঠক-শিল্পী-প্রকাশকদের আড্ডার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ চায়ের ব্যবস্থা না থাকায় আক্ষেপ করলেন আরও অনেকে।
পারিজাত প্রকাশনীর স্টলের সামনে কথা হলো এর স্বত্বাধিকারী শওকত হোসেন লিটুর সঙ্গে। তিনি বললেন, মেলার সময় বাড়ানোয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে তিনি কৃতজ্ঞ। এবার হয়তো ক্ষতি কাটিয়ে লাভের মুখ দেখতে পারবেন। এবার তারা ৩০টি বই করেছেন। এগুলোর মধ্যে সৈয়দ আবুল হোসেনের ডকু ফিকশন 'রাজপুত্র শেখ রাসেল', কাজী আনারকলির মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস 'বীরাঙ্গনা মর্জিনা', মাহীরা ফারহীনের কিশোর ফ্যান্টাসি 'ভিনজেল মিউনিখ', শেখ নজরুলের কবিতা 'শায়েরি', মোনায়েম সরকারের ইতিহাসভিত্তিক প্রবন্ধ 'মুজিবনগর সরকারের সংকট ও সাফল্য' বেশি বিক্রি হচ্ছে।
মেলায় এসেছে কবি সাখাওয়াত টিপুর কবিতার বই 'স্নায়ুযুদ্ধ'। কাকতালীয়ভাবে এখন চলছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। তিনি বললেন, 'স্নায়ুযুদ্ধ কবিতাটি লিখেছিলাম আজ থেকে ১৮ বছর আগে। বইয়ের নাম ঠিক করেছি তিন মাস আগে। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়া-ইউরোপীয় ইউনিয়ন-ন্যাটোর ঘটনা যেন কবিতাটিকে জীবন্ত করে তুলেছে। কবিতা যে ভবিষ্যতের ভাষা- সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম!'
চিত্রশিল্পী মাসুক হেলাল এবার প্রথমা প্রকাশনীর জন্য ৫২টির মতো প্রচ্ছদ করেছেন। বললেন, 'বইমেলা দীর্ঘায়িত হওয়ায় প্রকাশকদের জন্য খুব ভালো হয়েছে। তরুণ প্রকাশকরাও বেঁচে যাবেন। গতবার তাদের খুবই ক্ষতি হয়েছিল।' তারও দুটি বই বেরোবে। তবে মেলার পরে, বৈশাখের দিকে। একটির নাম এখনও ঠিক করেননি। আরেকটি বই 'মুখ ও মুখোশ'-এর তৃতীয় পর্ব বের হবে পারিজাত থেকে।
কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক দেবদুলাল মুন্নার গবেষণাধর্মী বই 'একটি পূর্ণাঙ্গ এন্টি সুইসাইডাল ড্রাগস' এনেছে বৈতরণী। পরিবেশক চৈতন্য। মুন্না বলেন, 'বইমেলায় আসার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এখানে ১০০ জনের মধ্যে ৫ জন বই কেনেন। অন্যরা ঘুরতে আসেন; সেলফি তোলেন। ফলত সামাজিক বিচ্ছিন্নতা না বুঝেই তারা ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনে ভোগেন।'
এবারের মেলায় কথাসাহিত্যিক নূরুননবী শান্তর বই প্রকাশিত হয়নি। তবে গতবার আদর্শ প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছিল গল্পগ্রন্থ 'মড়ার মাথা', যা বইমেলায় পাওয়া যাচ্ছে। শান্ত বললেন, ডিজিটাল মাধ্যমে আসক্ত নতুন প্রজন্মকে বইবান্ধব করার ক্যাম্পেইন কার্যক্রম মেলায় থাকতে পারত। বইমেলার অসাম্প্রদায়িক চরিত্র যাতে বিঘ্নিত না হয়, সে প্রচেষ্টা থাকা দরকার। মানসম্মত বই নিশ্চিত করতে প্রত্যেক প্রকাশনা সংস্থার পেশাদার সম্পাদক থাকা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত।
কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র পরিচালক রেজা ঘটকের গবেষণা ও প্রবন্ধের বই 'চলচ্চিত্রের দেশ বিদেশ' প্রকাশ করেছে ত্রয়ী প্রকাশন। করোনা মহামারিকে ভোলার জন্য এবারের বইমেলাকে তিনি বলছেন 'এক ধরনের প্রতিবাদী সাংস্কৃৃতিক মিলনমেলা', যা আদতে তার মতে, সুদূরপ্রসারী মানসিক রোগ নিয়ন্ত্রণের এক মহৌষধ।
লিটলম্যাগ চত্বরে গিয়ে 'পথিক' স্টলে কথা হলো কবি তারেক মাহমুদের সঙ্গে। লেখালেখি প্রকাশনা থেকে এসেছে তার কাব্যগ্রন্থ 'যে শহরে তুমি নেই'। তিনি জানালেন, মেলায় এলে বহুদিন পর লেখক-বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়, আড্ডা হয়। এটাই তার পরম পাওয়া।
অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী শাহ আলম সস্ত্রীক 'পথিক' স্টলে এসে কিনলেন লিটলম্যাগটির দুটি সংখ্যা। তিনি বললেন, লিটলম্যাগ অগ্রসরমান চিন্তাশীলদের জায়গা। তাই এখানে এসে তিনি তৃপ্তি পান।
নতুন বই :মেলায় এসেছে সমগ্র প্রকাশনা থেকে কবি জুলফিকার মতিনের 'কাব্যসংগ্রহ'। এসেছে মোনায়েম সরকারের 'মুজিবনগর সরকারের সংকট ও সাফল্য' (পারিজাত), মুহম্মদ নূরুল হুদার 'আয়না দিঘি', মুনতাসীর মামুনের 'একাত্তরের বন্ধু যারা', গোলাম মাওলা রনির 'একটি রাম ছাগলের আত্মকথা', মুহাম্মদ ফরিদ হাসান সম্পাদিত 'স্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ' (পাঞ্জেরী), মো. জাহাঙ্গীর কবিরের 'বিচিত্র কয়েদখানা' (পাঞ্জেরী) ইত্যাদি গ্রন্থ।
আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান :বিকেল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় 'আনিসুজ্জামান, রফিকুল ইসলাম, শামসুজ্জামান খান' শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে 'আনিসুজ্জামান :নিষ্ঠাবান গবেষক, অঙ্গীকারবদ্ধ সমাজ-চিন্তক' শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গোলাম মুস্তাফা। 'স্মরণ :রফিকুল ইসলাম, শামসুজ্জামান খান' শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এম আবদুল আলীম। আলোচনায় অংশ নেন সারওয়ার আলী এবং সাইমন জাকারিয়া। সভাপতিত্ব করেন মুনতাসীর মামুন।
'লেখক বলছি' মঞ্চ :'লেখক বলছি' মঞ্চে গতকাল নিজেদের বই নিয়ে আলোচনা করেন হরিশংকর জলদাস এবং মোহিত কামাল। অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি বদরুল হায়দার, হাসনাইন সাজ্জাদী ও হানিফ খান। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আহসানউল্লাহ তমাল, সাফিয়া খন্দকার রেখা, ডা. আওরঙ্গজেব এবং মিজানুর রহমান সজল। সাংস্কৃতিক পর্বে ছিল সাংস্কৃৃতিক সংগঠন 'অচিন পাখি' এবং 'উজান'-এর পরিবেশনা।
গতকাল এ মঞ্চে বাংলাদেশ জেলের ডিআইজি প্রিজন্স মো. জাহাঙ্গীর কবিরের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'বিচিত্র কয়েদখানা'র মোড়ক উন্মোচন করা হয়। বইটির প্রকাশক পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স।
আজকের অনুষ্ঠান :আজ মঙ্গলবার অমর একুশে বইমেলার ১৫তম দিন। মেলা চলবে বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে 'স্মরণ :জামিলুর রেজা চৌধুরী' শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন আব্দুল কাইয়ুম। আলোচনায় অংশ নেবেন মোহাম্মদ কায়কোবাদ, মাসুদুল হক এবং মুনির হাসান। সভাপতিত্ব করবেন আইনুন নিশাত। সন্ধ্যায় রয়েছে সাংস্কৃৃতিক অনুষ্ঠান।
মন্তব্য করুন