কাশীরাম দাসের 'মহাভারত', কৃত্তিবাস ওঝার 'রামায়ণ', শাহ মুহম্মদ সগীরের 'ইউসুফ জোলেখা' বা আলাওলের 'পদ্মাবতী' বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিভিন্ন ভাষার অনূদিত গ্রন্থ। প্রাচীন যুগের পর বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগে সাহিত্যচর্চা শুরু হয় মূলত অনুবাদ সাহিত্যে। বাংলা ভূখণ্ডে বিভিন্ন রাজসভার কবি-বণিক শ্রেণি বা ধর্মীয় কারণে অনুবাদের চর্চা শুরু করেন। অনুবাদ সাহিত্যে বাংলা ভাষা বিভিন্ন ভাষার শব্দে হয়েছে সমৃদ্ধ। মধ্যযুগের পর আধুনিক যুগের বাংলা সাহিত্যিকরাও অনুবাদ সাহিত্যে গুরুত্ব দিতেন। একবিংশ শতাব্দীর লেখক-সাহিত্যিকরাও বিশ্বসাহিত্যের বিভিন্ন গ্রন্থ, উপন্যাস, কবিতা, রাজনৈতিক প্রবন্ধ, ইতিহাস, বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র অনুবাদ করেছেন। এসব অনুবাদ সাহিত্যের পাঠকও রয়েছে বেশ।

বাংলা সাহিত্যের উৎকর্ষের মহা-আয়োজন অমর একুশে গ্রন্থমেলায় অনুবাদ সাহিত্যে রয়েছে বিভিন্ন বয়সী শ্রেণি-পেশার মানুষের ঝোঁক। পাঠকের আগ্রহ থাকলেও বইমেলায় যে সংখ্যক অনুবাদ সাহিত্য আছে, সেগুলোর মান নিয়ে আছে প্রশ্ন।

অন্বেষা প্রকাশনের প্রকাশক সাহাদাত হোসেন বলেন, 'অনুবাদের বই এবার অনেক কম এসেছে। অনুবাদের বইয়ে পাঠকের আগ্রহ থাকলেও লেখকরা আক্ষরিক অনুবাদ করেন। কম সংখ্যক লেখকের লেখায় সাহিত্যভাব থাকে। অনেক লেখকের অনুবাদের মান ভালো নয়। আবার তাদের লেখা পাণ্ডুলিপি প্রকাশনায় জমা দেওয়া হয় মেলা শুরুর আগে। এই কম সময়ে লেখা সম্পাদনার সময় থাকে না। এ সময় ভালো পাণ্ডুলিপি এলেও না করতে হয়। অনেক প্রকাশনী সম্পাদনা ছাড়াই বই প্রকাশ করছে। এ ক্ষেত্রে লেখকদের আরও সচেতন হতে হবে। তবে ভালো লেখা যে নেই, তা নয়; সংখ্যাটা অনেক কম।'

তিনি আরও বলেন, 'শুধু বিশ্বসাহিত্যের বইগুলো অনুবাদ করলেই হবে না। আমাদের অনেক ভালো সাহিত্য আছে। এসব সাহিত্যকে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিতে অনুবাদ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার, বাংলা একাডেমি ও মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটকে দায়িত্ব নিতে হবে।'

লেখক আন্দালিব রাশদী বলেন, 'আমাদের দেশের অনুবাদের অবস্থা ভালো নয়। লেখকরা শুধু ফিকশন অনুবাদ করছেন। নন-ফিকশন সাহিত্যের অনুবাদ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের অনুবাদ সাহিত্যের পাঠের অভ্যাস ও আগ্রহ জন্মায়নি। এ ছাড়া বাংলা অনুবাদ সাহিত্যে শুধু ইংরেজি ভাষার অনুবাদ হচ্ছে। রাশিয়ান, ফ্রান্স, আরবি, হিন্দি, উর্দুসহ আরও অনেক ভাষায় বিখ্যাত সাহিত্য আছে। এগুলার অনুবাদ হচ্ছে না। এসব ভাষায় অনুবাদ করার মতো দক্ষ লোকও নেই। বাংলা সাহিত্যে ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ তার 'গীতাঞ্জলি' অনুবাদে নোবেল পুরস্কার পান। পরবর্তী একশ বছরে বাংলা সাহিত্যে আর কোনো অনুবাদ নেই। বাংলা সাহিত্যকে বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করে ছড়িয়ে দিতে হবে। সে কাজটাও হচ্ছে না।'

এই লেখক আরও বলেন, 'অনুবাদ সাহিত্যের জন্য বড় কাজটি করতে হবে সরকার বা বাংলা একাডেমিকে। বিশ্বসাহিত্যের টপিকস সিলেক্ট করে তা অনুবাদ করতে হবে। প্রকাশক সংগঠনও সে কাজটা করতে পারে। অনেকে বাংলা ভাষায় ভুল অনুবাদ করেন। পাণ্ডুলিপি জমা দেওয়ার পর সেটির অনুবাদ ঠিকঠাক হয়েছে কিনা, তা দেখার লোকও নেই। প্রকাশকরা তা পরীক্ষা করে দেখেন না। বাংলা একাডেমি সে অনুবাদ রিভিউ করে দেখার কাজটিও করতে পারে।'

ঐতিহ্য প্রকাশনী থেকে এ বছর মাত্র তিনটি অনুবাদের বই করা হয়েছে। ঐতিহ্য প্রকাশনীর ব্যবস্থাপক আমজাদ হোসেন খান কাজল বলেন, 'আমরাই প্রথম অনুবাদ বই প্রকাশ শুরু করি। লেখার মান ও অন্যান্য কারণে এখন অনুবাদ প্রকাশ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।'

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মহিবুল হক গালিবের ড্যান ব্রাউন ও ডি কোস্টারের বই পছন্দ। তিনি বলেন, মেলায় সব বইয়ের অনুবাদ পাওয়া যায় না। আবার একই বইয়ের অনেকজন অনুবাদ করেন, তাদের লেখায় আবার ঘটনা ভিন্নভাবে বর্ণনা করা হয়।

অনুবাদ লেখক রাজু আলাউদ্দিন বলেন, 'আমাদের দেশে এখন প্রচুর অনুবাদ হচ্ছে। তবে অনুবাদের সম্পাদনার কাজের অবস্থা নাজুক।'

পার্ল প্রকাশনীর প্রকাশক হাসান জাহিদি বলেন, 'ভালো অনুবাদ করতে সময় লাগে। লেখায় মূল লেখকের ভাবের সঙ্গে অনুবাদ লেখক নিজের ভাব মিশিয়ে লেখাকে আকর্ষণীয় করবেন। তবে এখন অনেকে করেন ভাবানুবাদ।'

তিনি বলেন, 'অনুবাদ না হলে বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে আমাদের সংযোগ থাকবে না। বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে আমাদের দেশের পাঠকরা জানবেন না, আবার বিশ্বে আমাদের সাহিত্যের পরিচয় ঘটবে না। তাই অনুবাদ সাহিত্য জরুরি।'

অনুবাদের নতুন বই: অনিন্দ্য প্রকাশ থেকে ওয়ালি খানের "ভারত ভাগের অজানা কাহিনি :দ্য আনটোল্ড স্টোরি অব ইন্ডিয়া'স পার্টিশন" অনুবাদ করেছেন জাহিদ হোসেন, ঐতিহ্য থেকে 'সাক্ষাৎ ফিল্মমেকার :বেলা তার' গ্রন্থনা ও অনুবাদ করেছেন রুদ্র আরিফ, ঐতিহ্য থেকে ড. লায়লা হামদানের 'নারীর জন্য নসিহা' অনুবাদ করেছেন আবদুল্লাহ শাকের, আলোঘর থেকে 'একাত্তরের দলিল' অনুবাদ করেছেন আন্দালিব রাশদী, তাম্রলিপি থেকে 'ফরাসি রূপকথা :রাজকুমারী রোস্যাট' অনুবাদ করেছেন বিপ্লব রঞ্জন সাহা, অনিন্দ্য প্রকাশ থেকে ডার্সি কোটসের 'দ্যা হান্টিং অব ব্ল্যাকউড হাউজ' অনুবাদ করেছেন অসীমা দত্ত, নালন্দা থেকে 'ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াৎ' অনুবাদ করেছেন আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু, বাতিঘর থেকে ফ্রিদরিখ এঙ্গেলসের 'জার্মান দেশের কৃষকযুদ্ধ' অনুবাদ করেছেন মুহাম্মদ তানিম নওশাদ, ডেবোরাহ এলিসের 'দ্য ব্রেডউইনার' অনুবাদ করেছেন জামাল নাসের, ওরহান পামুকের 'ইস্তাম্বুল :স্মৃতি ও শহর' অনুবাদ করেছেন আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু, অন্যপ্রকাশ থেকে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের 'নিঃসঙ্গতার একশ বছর' অনুবাদ করেছেন আনিসুজ জামান, অনন্যা প্রকাশনী থেকে 'রোয়াল্ড ডালের দশ গল্প' অনুবাদ করেছেন মনিজা রহমান, সময় প্রকাশন থেকে বার্ট্রান্ড রাসেলের 'পনেরোটি দার্শনিক প্রবন্ধ' অনুবাদ করেছেন আমিনুল ইসলাম ভুইয়া। এ ছাড়া প্রকাশনীগুলোতে পুরোনো অনেক অনুবাদের বই আছে। শনিবার বইমেলার ১৯তম দিনে নতুন বই আসে ১২৯টি।

মোড়ক উন্মোচন: লুৎফা হাসিম রোজির 'মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর :স্বাধীনতার যুদ্ধকাল' বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হয়েছে। গতকাল শনিবার বিকেলে বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে বইটির মোড়ক উন্মোচন করা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মুনির উদ্দিন, কবি মোহন রায়হান, বইমেলা আয়োজক কমিটির সদস্য সচিব জালাল আহমেদ, আফরোজা হক লিমা, লিনু হক প্রমুখ। বইটি অয়ন প্রকাশন থেকে প্রকাশ হয়েছে।

এদিকে, করপোরেট ব্যক্তিত্ব ও মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান 'উপায়'-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রেজাউল হোসেনের 'ওয়্যারলেস টু ক্যাশলেস' বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে। গতকাল থেকে আদর্শ স্টলে বইটি পাওয়া যাচ্ছে।

সন্ধ্যার পরে পূর্ণ পাত্রের কবিতা গ্রন্থ 'চুপ'-এর মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে। সোম্য প্রকাশনী বইটি প্রকাশ করেছে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক সচিব রমচন্দ্র দাশ। উপস্থিত ছিলেন সদ্য একুশে পদকজয়ী ঝর্না দাশ পুরকায়স্থ, বেতারের সাবেক ডিজি এম এ আজিজ, অতিরিক্ত সচিব দেওয়ান সাইদুল হাসান, পর্যটন করপোরেশনের ম্যানেজার (জনসংযোগ) জিয়াউল হক বাবলু, তানজীনা তমা, সেলিনা শিউলী, হাসান ফেরদৌস প্রমুখ।

আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান: বিকেল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় 'স্মরণ :কাজী মনজুরে মওলা ও হাবীবুল্লাহ সিরাজী' শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়। আলোচনায় অংশ নেন মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক, আসাদ মান্নান ও সাহেদ মন্তাজ। সভাপতিত্ব করেন সুব্রত বড়ূয়া।

লেখক বলছি অনুষ্ঠান: এই অনুষ্ঠানে নিজেদের বই নিয়ে আলোচনা করেন বিমল গুহ ও শাহেদ কায়েস। কবিতা পাঠ করেন কবি ঝর্ণা রহমান ও ইমরুল ইউসুফ। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছিল কাশফুল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদের পরিবেশনা।

আজকের অনুষ্ঠান: আজ রোববার মেলা চলবে বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে 'জন্মশতবার্ষিকী শ্রদ্ধাঞ্জলি :নীলিমা ইব্রাহিম' শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। সন্ধ্যায় রয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।