ঢাকা মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই ২০২৫

আমাদের মুক্তাঞ্চল

লেখক

আমাদের  মুক্তাঞ্চল

আফরোজা সোমা

আফরোজা সোমা

প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০০:২৬

প্রতিটি ভূখণ্ডে, প্রতিটি গোত্রের মানুষের মধ্যেই সমবেত কিছু স্মৃতি থাকে। থাকে কিছু সমবেত সুখ, দুঃখ, স্বপ্ন ও আশা। অমর একুশে বইমেলাও আমাদের জন্য তেমন কিছু। ’৭১-পরবর্তী বাংলা ভূখণ্ডের সমবেত সাংস্কৃতিক স্মৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ এই বইমেলা।

সদ্য স্বাধীন দেশে মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক রুচি নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে একুশের বইমেলা। এই প্রভাব বানের জলের মতো হুড়মুড় করে আসেনি। বইমেলা
 রেখেছে স্নোবল ইফেক্ট। দিন যত গড়িয়েছে, এর অভিঘাত গভীর ও ব্যাপক হয়েছে। 

আমাদের জাতীয় জীবনে অভিঘাত তৈরির দিক থেকে বইমেলার সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে কেবল ছায়ানট। 
বর্ধমান হাউসের বটতলায় এক টুকরো চটের ওপর যে যাত্রা শুরু করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা, তা এখন ছড়িয়ে পড়েছে কয়েক হাজার গুণ বড় হয়ে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে বইমেলা বিস্তৃত হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সুবিশাল পরিসরে।

জানা গেছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তৈরি হতে যাচ্ছে বিশেষ সাংস্কৃতিক বলয়। ফলে আগামী বছর থেকে উদ্যানে মেলার আয়োজন হয়তো হবে না। 
তাহলে কোথায় যাবে বইমেলা? সুদূর পূর্বাচলে? নাকি ঝাঁ চকচকে কোনো সুরম্য সম্মেলন কেন্দ্রে? মেলার আয়োজকরা তা নিয়ে নিশ্চয়ই ভাবছেন। মেলার অংশীজন হিসেবে আমার ভাবনাটিও এখানে জানিয়ে রাখা যায়। 

মেলাকে পূর্বাচলে নেওয়াটা হবে অবিমৃশ্যকারিতা। বইমেলা বাণিজ্য মেলার মতো শুধুই বেসাতির কোনো ইভেন্ট নয়। অন্তত যতদিন বাংলা একাডেমি মেলার আয়োজক হিসেবে আছে, ততদিন। যদি কখনেও বাংলা একাডেমিকে বাদ দিয়ে শুধু পুস্তক প্রকাশক ও ব্যবসায়ীরা গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন, সেটি হবে ভিন্ন বাস্তবতা (বাংলার একাডেমির কাজ মেলার আয়োজন করা কিনা, সে প্রশ্নও গুরুত্বপূর্ণ বৈকি!)।
শহীদ মিনার, বাংলা একাডেমি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, স্বাধীনতা স্তম্ভ, টিএসসি, মধুর ক্যান্টিন, চারুকলা, ছবির হাট, শাহবাগ, জাতীয় জাদুঘর, আজীজ মার্কেট, কাঁটাবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, রমনা পার্ক এবং শিল্পকলা একাডেমির সমন্বিত অবস্থান ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ইতোমধ্যে এ অঞ্চলটুকু ঢাকায় তথা বাংলাদেশে সংস্কৃতির হৃৎপিণ্ডে পরিণত হয়েছে। এই সমবেত এলাকাকে আমি ডাকতে চাই সাংস্কৃতিক মুক্তাঞ্চল।

এই মুক্তাঞ্চলের সীমানার মধ্যেই বাংলাদেশের অভ্যুদয় পর্বের ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ– ইতিহাসের সারৎসার ধরা আছে। 
একুশের বইমেলাও এই সমবেত সাংস্কৃতিক মুক্তাঞ্চলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই মেলাকে দূরে কোথাও না নিয়ে যাওয়াই সমীচীন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠ হতে পারে বইমেলার জন্য উপযুক্ত বিকল্প স্থান। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে সানন্দে মেলা সেখানে স্থানান্তর হতে পারে। এর বাইরে আবাহনী মাঠকেও দ্বিতীয় বিকল্প হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু পূর্বাচলের মতো দূরবর্তী জায়গা বিবেচনায় না নেওয়াই বাঞ্ছনীয়।

বাংলা একাডেমির বহেরা তলায় লিটলম্যাগ চত্বরে ধুলো খেতে খেতে আমাদের নবযৌবন চালশেতে গড়িয়েছে। গেট খোলার লগ্নে মেলায় ঢোকা। রাতে স্টলের ঝাঁপ দেওয়ার সময়ও ফেরার তাড়া নেই। গুলতানি মারাই কাজ। গপ্পো করে সংসার ভাসিয়ে দেওয়াই সেসব দিনের ইবাদত। বিকেল-সন্ধ্যা মেলায় কাটিয়েও মেলা ভাঙার সময় ‘তবু যেন বের হতে চাই না’ মনে, ধীর পদক্ষেপে এক পা-দু পা করে টিএসসির দিকে এগোতে এগোতে দশবার থামা। টিএসসিতে এসে আবার আরেক প্রস্থ চা! 

বইমেলা থেকে আজীজ, আজীজ থেকে বইমেলা! এ তো দুই কদম! বই আসছে! বই যাচ্ছে! শাহবাগ-নীলক্ষেত-টিএসসি আত্তীকৃত হয়ে যাচ্ছে বইমেলায়।
আজীজে দিনে একবার ঢুঁ না মারলে চলতই না। আজীজের চায়ের দোকানগুলোই ছিল ঢাকায় সাহিত্য করতে আসা যে কোনো নবাগতর প্রথম পাঠশালা। আজীজের সংস্কৃতি এখন কেবলই স্মৃতি। নেই সেই আটপৌরে চেহারার বাংলা একাডেমিও। মেলাও একাডেমি প্রাঙ্গণ ছেড়ে সোহরাওয়ার্দী হয়ে এখন অন্যত্র যাই যাই করছে। তবু এখনও বইমেলা বেসাতির বেশি কিছু। বইমেলা এখনও আমাদের মুক্তাঞ্চল।
২০২৪-এর বইমেলা শুরু হয়ে গেছে। বাতাসেও বদলের ঘ্রাণ। বিদায়ী মাঘের গায়ে লেগে যাচ্ছে ফাল্গুনের উষ্ণ শ্বাস। বসন্তের পরশে প্রকৃতির প্রাণে লাগবে শিমুল-পলাশের রং। ৮ ফাল্গুনে বিসর্জনের স্মৃতির স্মরণে আমরা প্রভাতফেরিতে হবো সমবেত।

ফেব্রুয়ারি গড়াবে মার্চে। আমরা করব স্বাধীনতা উৎসবের আয়োজন। এইভাবে শহীদ মিনার, বইমেলা, স্বাধীনতা স্তম্ভ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বইমেলা ঋতুবদলের মতো অলক্ষ্যে আমাদের একটি থেকে আরেকটিতে টেনে নিয়ে যাবে। এভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বাহিত হবে ইতিহাস, ঐতিহ্য, স্মৃতি ও স্বপ্নের সারৎসার। 

 

আরও পড়ুন

×