পাঠকের আগ্রহ বেড়েছে গবেষণা-প্রবন্ধের বইয়ে
.
লতিফুল ইসলাম
প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০০:৩১
প্রতিবছর একুশে বইমেলায় প্রচুর গল্প, উপন্যাস আর কবিতার নতুন বই আসে। সে তুলনায় গবেষণাধর্মী বা বিষয়ভিত্তিক বইয়ের সংখ্যা যেন একটু কম ছিল। কিন্তু সময়ের আবর্তে গবেষণাধর্মী ও বিষয়ভিত্তিক বইয়ের চাহিদাও দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে আত্মজীবনী, সাক্ষাৎকার, দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, সাহিত্য-সংস্কৃতিবিষয়ক প্রবন্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রকাশিত বই সংগ্রহ করছেন অনেকে।
গতকাল সোমবার মেলায় আসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী রিফাদ সাঈদ জানান, তাঁর আগ্রহের জায়গা মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনীতির বই। জার্নিম্যান বুকস থেকে আলমগীর সাত্তারের ‘কিলো ফ্লাইট’, আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেনের ‘মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস’, বদরুদ্দীন উমরের ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’, বদিউল আলম মজুমদারের ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রাজনীতি’ বইগুলো সংগ্রহ করেছেন। সংস্কৃতি আর রাজনীতির প্রকৃত ইতিহাস জানতে আরও কিছু বই সংগ্রহ করবেন তিনি।
কথা হয় বাংলাদেশ কৃষক সমিতি ও ঐক্য ন্যাপ সভাপতি এস এম এ সবুরের সঙ্গে। মেলায় ঘুরে প্রবীণ এ রাজনীতিবিদ সংগ্রহ করেছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘সাতচল্লিশের দেশভাগ : গান্ধী ও জিন্নাহ’, তালুকদার মনিরুজ্জামানের ‘বামপন্থী রাজনীতি ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়’, ‘১৯৭১ সালের শিলিগুড়ি সম্মেলন: প্রবাসী সরকারের সাথে জনপ্রতিনিধিদের সভা’। এম এ সবুর বলেন, ‘বয়স বাড়ার সঙ্গে পাঠের ধরনও পাল্টে যায়। বদলে যাওয়া পাঠাভ্যাসে যুক্ত হয়েছে অজানাকে জানার আকাঙ্ক্ষা। এতে জ্ঞানের গভীরতা বৃদ্ধির সমান্তরালে নিজেকে সমৃদ্ধ মনে হয়।’ কথাসাহিত্যিক ইমতিয়ার শামীম বলেন, ‘আগে শুধু গল্প, কবিতা, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনিতে পাঠক সীমাবদ্ধ ছিল। এখন তা না। এর বাইরেও অনেক নতুন নতুন ক্ষেত্র রয়েছে, যেগুলোকে কেন্দ্র করে নিত্যনতুন পাঠক সৃষ্টি হচ্ছে। সেই অনুযায়ী তৈরি হচ্ছে লেখকও।
সময় প্রকাশনীর প্যাভিলিয়নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘বইমেলায় গবেষণার বই খুবই কম আসে। গল্প, উপন্যাস, কবিতা সহজেই লেখা যায়। কিন্তু গবেষণার কাজ করতে সময় ও শ্রম দিতে হবে। আমাদের আরও গবেষক সৃষ্টি হওয়া দরকার। তবে গবেষক রাতারাতি তৈরি হবে না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখন বিসিএস চাকরিকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। গবেষক সৃষ্টি হচ্ছে না। গবেষক সৃষ্টিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্যোগ নিতে হবে।’
কথাপ্রকাশের বিপণন কর্মকর্তা ইউনুছ আলী বলেন, ‘মেলায় গবেষণাধর্মী মননশীল বই খুব কম পাওয়া যায়। অধিকাংশ প্রকাশনী এ ধরনের বই বের করে না। তবে এ ধারার বইয়ের রয়েছে পৃথক পাঠক। প্রতিবছর তারা মেলায় তালিকা ধরে বই সংগ্রহ করেন। তাদের মতো গ্রন্থানুরাগীদের জন্যই আমরা এমন ধারার বই ছাপানোর সাহস করি।’
আগামী প্রকাশনীর ওসমান গনি বলেন, ‘চিন্তাশীল পাঠকই আসেন মননশীল বা প্রবন্ধের বইগুলো কিনতে। তাদের কথা চিন্তা করেই আমাদের প্রকাশনা থেকে নিয়মিত প্রবন্ধের বই প্রকাশ করছি। কোনো কোনো প্রবন্ধের বইয়ের চাহিদা গল্প ও উপন্যাসের বইয়ের চেয়েও বেশি।’
জানা গেছে, এবার একুশে বইমেলার গত বারো দিনে মোট ১০২৮টি নতুন বই এসেছে। এর মধ্যে গবেষণা গ্রন্থ এসেছে ২৪টি, জীবনী ৪৪টি, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ১৯টি, বিজ্ঞান ১৬টি, ভ্রমণ ২৩টি, ইতিহাস ১৬টি, রাজনীতি ৯টি, চিকিৎসা ১০টি, বঙ্গবন্ধুবিষয়ক ৭টি বই। এবার মেলায় পাঠকের চাহিদাসম্পন্ন গবেষণাধর্মী কিছু গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের মধ্যে রয়েছে কথাপ্রকাশ থেকে যতীন সরকারের ‘সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রত্যাশা’, জাহীদ রেজা নূরের ‘৬ দফা থেকে স্বাধিকার’ ও সনৎকুমার সাহার ‘ন্যায়-অন্যায়’। পাঠক সমাবেশ থেকে বেরিয়েছে স্বকৃত নোমানের ‘বাংলায় ইসলাম: সহজিয়া ও রক্ষণশীল ধারা’। মাওলা ব্রাদার্স প্রকাশ করেছে কাবেদুল ইসলামের ‘গণপরিষদ বিতর্কের আলোকে বাংলাদেশের সংবিধান’। সময় প্রকাশন থেকে এসেছে মুনতাসীর মামুনের ‘কী চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু’ ও নূহ-উল-আলম লেনিনের ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ইতিহাসের রূপরেখা’। আগামী প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছে ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন রচিত ‘শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধু’ ও আবদুল্লাহ আল আমিনের লেখা ‘লালন ফকির এক নিঃসঙ্গ সাধক’। ইউপিএল থেকে বেরিয়েছে এম ইদ্রিস আলীর লেখা ‘বঞ্চনা ও প্রান্তিকতার ইতিবৃত্ত : ইসরায়েলের আরব জনগোষ্ঠী’।
এদিকে গতকাল বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘জন্মশতবার্ষিকী শ্রদ্ধাঞ্জলি : হেনা দাস’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জোবাইদা নাসরীন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ঝর্না রহমান এবং ফওজিয়া মোসলেম। সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক শিরীণ আখতার। ‘লেখক বলছি’ অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কথাসাহিত্যিক সালমা বাণী, কবি ফারহানা রহমান, গবেষক মিলটন কুমার দেব এবং কথাসাহিত্যিক ইকবাল খন্দকার।