বইমেলা নিয়ে বিচ্ছিন্ন ভাবনা

শাহীন মোমতাজ
শাহীন মোমতাজ
প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০০:১৬
আমাদের বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক ক্যালেন্ডারের প্রতি মাসের পাতায় পার্বণের রং লেগে থাকে। কোথাও না কোথাও উৎসব হয়েই চলেছে। একুশের বইমেলা সে রকমই এক অনন্য অভিজ্ঞতা। আমাদের জীবনে এই মেলা কতখানি কী তা বোধহয় নতুন করে বলার কিছু নেই।
মনে আছে, এক সময় শুধু বাংলা একাডেমির চত্বরজুড়ে খ্যাতনামা ও বনেদি প্রকাশকদের স্টল আর বহেড়াতলার লিটলম্যাগ চত্বর নিয়ে ছিল বইমেলার পরিধি। পরে সেটা বারোয়ারি মেলার রূপ পরিগ্রহ করেছিল, টিএসসি থেকে বাংলা একাডেমি চত্বরে প্রবেশের গেটের কাছে পৌঁছাতে কতটা হ্যাপা পোহাতে হতো বই অনুরাগীদের। রাস্তার মেলার সাংসারিক জিনিসপত্রে ঠাসা পথটুকু পার হতে হতেই হতোদ্যম হয়ে পড়তেন পাঠক। বইমেলা চত্বরে প্রবেশের আগেই বুঝি ঘটে যেত ‘পাঠকের মৃত্যু’। আর তারপর ছিল স্টলের সামনের সংকীর্ণ রাস্তাগুলোতে মানুষের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে চলাচল। প্রিয় বইটির কাছে পৌঁছাতে পারার কসরত যেন ছিল যুদ্ধজয়ের অন্য কোনো নাম। সে সময় ছিল আবৃত্তির অডিও অ্যালবাম আর কবিতা কার্ডের যুগ। দ্রোহ আর প্রেম-সংশ্লিষ্ট অনুভূতি প্রকাশের এই আয়োজন সেই সময়ের বসন্তে তারুণ্যকে নাড়া দিয়ে যেত।
এক সময় বইমেলাকে বইমেলাতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা শুরু হলো। নিষিদ্ধ হলো রাস্তার ওপরের পণ্য সমাবেশ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মেলার কলেবর বৃদ্ধি পেতে পেতে একাডেমি-সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত বিস্তৃত হলো। এই সব তথ্য তো জানা সবারই। এ-ও সবাই জানেন যে, বর্তমানে প্রকাশকের সংখ্যা, প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা, বিষয়বৈচিত্র্য সবই বেড়েছে। কিন্তু মানসম্পন্ন বই? আছে তো বটেই। পাঠককে সেসব খুঁজে নিতে সেই আগের মতোই দুঃখ পেতে হচ্ছে, এই যা। আগের মতোই অনর্থক ভিড় আর ধুলার যন্ত্রণা আমাদের অসুস্থ করে তুলছে। বাজার-চলতি, নিম্নমানের লেখা আর অযত্নে ছাপা হওয়া বইয়ের ভিড় ঠেলে প্রিয় আর গুরুত্বপূর্ণ বইটির কাছে পৌঁছানোর পথ আগের মতোই কণ্টকাকীর্ণ আর কষ্টকর হয়ে থাকছে। বই নিয়ে, লেখকদের নিয়ে গণমাধ্যমের যেসব সংবাদ-প্রতিনিধি মেলার মাঠে উপস্থিত থেকে নিয়মিত অনুষ্ঠান করছেন তারা কি সেই কষ্ট লাঘবের পরিবর্তে পাঠককে ভুলভুলাইয়াতে ছেড়ে দিচ্ছেন না? ভুলভুলাইয়া প্রসঙ্গে মনে পড়ল আরেকটা বিষয়। কাঙ্ক্ষিত স্টল খুঁজে পেতে পাঠকের যন্ত্রণাও মনে রাখতে হবে। মেলার স্টল বিন্যাস নিয়ে প্রতি বছর অভিযোগ থাকছে প্রকাশকদের। বইমেলা কিন্তু বইয়ের বাণিজ্য মেলাও বটে। প্রকাশকরা আসেন বই বিক্রি করে মুনাফা করতে। বিন্যাসের কারণে সেই বিক্রি ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার দায় মেলা আয়োজকেরই। যাক, বলছিলাম ভুলভুলাইয়ার কথা। অপরিকল্পিত বিন্যাসের এই গোলকধাঁধা পেরিয়ে তথ্যকেন্দ্র থেকে তথ্য নিয়ে এ-স্টল সে-স্টল জিজ্ঞেস করতে করতে পাঠককে পৌঁছাতে হয় গন্তব্যে। যারা নিয়মিত বইমেলায় আসেন তারা হয়তো দু-এক দিনে অভ্যস্ত হয়ে যান, বুঝে ফেলেন কোন স্টলের অবস্থান কোনদিকে। কিন্তু ঢাকার বাইরে থেকে যে পাঠক এক দুই দিন সময় নিয়ে বইমেলাতে আসেন পূর্ব-নির্বাচিত বই কিনতে (এ রকম পাঠকের সংখ্যা কিন্তু একেবারেই কম না), তাদের ভুগতে হয়। যেহেতু স্মার্টফোন এখন প্রায় সবাই ব্যবহার করছেন, আর যুগটাও যেহেতু ডিজিটালাইজেশনের, সেহেতু গুগল ম্যাপের লাইভ লোকেশন অপশন ব্যবহার করে মেলা চত্বরের ইন্টার্যাক্টিভ ম্যাপের একটা স্মার্ট অ্যাপ তৈরির কাজ কি একেবারেই অসম্ভব বাংলা একাডেমির পক্ষে? তথ্যকেন্দ্রে গিয়ে স্টলের নাম বলে দেখেছি দায়িত্বরত কর্মীরা পুরোনো কালের মতো একতাড়া কাগজ ঘেঁটে তার নম্বর আর লোকেশন বের করে পাঠক কিংবা ক্রেতাকে সাহায্য করতে গলদঘর্ম হচ্ছেন। এই অ্যাপের মাধ্যমে প্রতিদিন প্রকাশিত বইয়ের যাবতীয় তথ্যও প্রকাশ করা সম্ভব হবে, তথ্যকেন্দ্র থেকে সারাদিন একঘেয়ে সুরে মাইকিং করে যা আমাদের জানানো হয়ে থাকে।
এবার আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গে যাই। বাংলা ছাড়াও আমাদের দেশ আরও অনেকগুলো ভাষায় সমৃদ্ধ। বহুজাতিক এই দেশের বহুচর্চিত ভাষার মধ্যে রাজবংশী, উর্দু, আরাকানি, চাকমা, গারো, সান্তালি, কুরুখ, সাদরি রয়েছে। সেসব ভাষার শিল্পসাহিত্যের খোঁজ তো আমরা পাচ্ছি না বইমেলাতে। কর্মসূত্রে আমি বছর কয়েক নীলফামারীর সৈয়দপুরে ছিলাম। সেখানে উর্দুভাষীদের মধ্যে রাতব্যাপী শায়েরির মজলিস হতে দেখেছি। কত তরুণ কবি দু-চার লাইনের স্ফুলিঙ্গ নিয়ে হাজির হতো সেইসব মজলিসে। তাদের পরে আর খুঁজে পাইনি। রাজবংশী ভাষায় অবশ্য সমৃদ্ধ গান রয়েছে, ভাওয়াইয়া। দু-চারটা গল্পও পড়েছি। কিন্তু এই ভাষায় সিরিয়াস প্রবন্ধ-সাহিত্য রচনার কথা শুনতে পাইনি। অন্যান্য ভাষায় কারা কবিতার চর্চা করছেন, কারা উপন্যাস নিয়ে ভাবছেন, আমি বইমেলাকে ‘বাঙালির আবেগের, প্রাণের মেলা’– জাতীয় সংকীর্ণ পরিচয়বাদের বাইরে গিয়েই সেই তথ্য পেতে চাই। একটা বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন, ভাষা আন্দোলন কোনো নির্দিষ্ট ভাষার বিরুদ্ধে ছিল না, ছিল সেই ভাষার আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে। আমি সবসময়ই কামনা করি, বাংলা ভাষা যাতে সেই আধিপত্যবাদী অবস্থানে কখনোই না পৌঁছায়। সব ভাষার সমান মর্যাদা আর সেইসব ভাষার সাহিত্যের বিকাশ যাতে আমরা সব ভাষাভাষী মিলেই নিশ্চিত করতে পারি। একুশের বইমেলা শুধু বাঙালির আবেগের মেলা না হোক, বাংলাদেশের সব ভাষাভাষী মানুষের, সাহিত্যের মেলা হয়ে উঠুক।
লেখক: কবি