জনারণ্যে মাতৃভাষার আবেগ, উচ্ছ্বাস
একুশে বইমেলা

কোলাজ
যোবায়ের আহমদ
প্রকাশ: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০৫:৪৬
ইফতি ও ইকরামের এক গালে আঁকা ‘অ আ ক খ’ বর্ণমালা, আরেক গালে লাল-সবুজের ছোট্ট পতাকা। তাদের দুই হাতে সামলিয়ে ভিড় ঢেলে অমর একুশে বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রাঙ্গণের মূল ফটক পেরিয়ে গেলেন স্কুলশিক্ষক বাবা ইয়াসিন হোসেন।
দুই শিশুসন্তান নিয়ে মেলায় ঢুকতে তাঁকে অনেক বেগ পেতে হলো। তাই একটু ফাঁকা জায়গা দেখে জিরিয়ে নিচ্ছিলেন। এ সময় কথা হয় তাঁর সঙ্গে। ইয়াসিন বলেন, মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে সরকারি ছুটি থাকায় বইমেলায় অনেক ভিড়। তারপরও একুশে ফেব্রুয়ারি মেলায় আসার মধ্যে অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে। বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরে তাদের পছন্দ অনুযায়ী বই কিনে দেব; নিজেও কয়েকটি কিনব।
গতকাল বুধবার বইমেলায় মানুষের ঢল নামে। বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, রমনা কালীমন্দির ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন-সংলগ্ন ফটকে ছিল ক্রেতা-দর্শনার্থীর দীর্ঘ সারি। প্রতিবছরের মতো এবারও একুশের দিনটিতে সকাল থেকে এমন চিত্র দেখা যায় বইমেলা ঘিরে। প্রভাতফেরি ও শহীদ মিনারে ভাষাশহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর এদিন সবারই যেন গন্তব্য হয়ে উঠেছিল বইমেলা।
সকাল ৮টায় মেলার ফটক খোলার পর থেকে সব শ্রেণির মানুষের ঢেউ আছড়ে পড়ে মেলার উভয় প্রাঙ্গণে। মেলায় আসা প্রত্যেকের পোশাক থেকে শুরু করে শরীরী ভাষায়ও প্রকাশ পেয়েছে মাতৃভাষার প্রতি আবেগ। নারী-পুরুষের রংবেরঙের পোশাকে বইমেলায় অন্যরকম আবহ তৈরি হয়।
প্রকাশক ও বিক্রয়কর্মীরা জানান, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে সরকারি ছুটি থাকায় বিপুল ক্রেতা-দর্শনার্থীর উপস্থিতিতে মুখর হয়ে ওঠে বইমেলা। তবে বিক্রি খুবই কম। একুশে ফেব্রুয়ারি ও ভাষা আন্দোলন সম্পর্কিত বইয়ের তুলনামূলক বিক্রি বেড়েছে বলেও জানিয়েছেন তারা।
আহমেদ হাসান নামে এক দর্শনার্থী বলেন, মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ছুটি থাকায় পরিবার নিয়ে বইমেলায় ঘুরতে এসেছি। ঘুরতে ভালো লাগছে। পছন্দ হলে বই কিনব।
ইশিতা দাস নামে একজন বলেন, সকালে বন্ধুদের নিয়ে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলাম। পরে সেখান থেকে বইমেলায় ঘুরতে এসেছি। অনেক স্টল ঘুরে দেখেছি। তবে এখনও কোনো বই কেনা হয়নি।
মেলা প্রাঙ্গণে কথা হয় সফটওয়্যার প্রকৌশলী মো. রোমান সরকারের সঙ্গে। ডিজিটাল মার্কেটিং ও ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে অনলাইন থেকে আয় করার বিভিন্ন কৌশল নিয়ে এবারের মেলায় প্রকাশ হয়েছে তাঁর বই ‘ডিজিটাল মার্কেটিং পথচলা’। রোমান সরকার বলেন, মেলায় জনস্রোত, আবেগ ও একুশের রং মিলেমিশে যেন একাকার হয়ে গেছে। নিজের বই সম্পর্কে তিনি বলেন, এই বইয়ে অনেক উদাহরণ এবং কেসস্টাডি রয়েছে, যা পাঠকদের ডিজিটাল মার্কেটিং ধারণাগুলোকে বাস্তব-বিশ্বের প্রয়োগে বুঝতে সহায়তা করবে। বইটি সহজবোধ্য এবং তথ্যবহুল; যা পাঠককে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মূল বিষয়গুলো দ্রুত শিখতে সাহায্য করবে। ছায়া পাবলিকেশন্সের স্টলে বইটি পাওয়া যাবে।
কথাপ্রকাশের করপোরেট সেলস এক্সিকিউটিভ ফারহানা হক বলেন, মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে লোক সমাগম অনেক বেশি। তবে মেলায় যারা আসেন, বিশেষ করে আমাদের প্যাভিলিয়নে দেখছি, বই খুলে ছবি তুলে চলে যাচ্ছেন, কিনছেন খুবই কম। আমাদের এখানে শিশুতোষ বই একটু বেশি বিক্রি হচ্ছে।
ঐতিহ্য প্রকাশনীর বিক্রয়কর্মী মেহেদী হাসান জানান, বিক্রি আগের দিনগুলোর মতোই আছে। দর্শনার্থী বেড়েছে, ক্রেতা না। আমাদের প্রকাশনীর কয়েকজন লেখক এসেছেন। তাদের বইগুলো ভালো বিক্রি হচ্ছে।
অমর একুশে বইমেলার ২১তম দিনে গতকাল বুধবার নতুন বই আসে ২৩৪টি। মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বাংলা একাডেমি বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। সকাল ৮টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর। সেখানে প্রায় ১৩৫ কবি কবিতা আবৃত্তি করেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কবি শামীম আজাদ।
বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় অমর একুশে বক্তৃতা-২০২৪। এতে স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) ড. সরকার আমিন। অমর একুশে বক্তব্য দেন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক। সমাপনী বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির সচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ড. মো. হাসান কবীর। একুশে বক্তৃতানুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বাংলা একাডেমির পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) ড. মো. শাহাদাৎ হোসেন।
‘লেখক বলছি’ অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু, শিশুসাহিত্যিক ওয়াসিফ এ খোদা, কথাসাহিত্যিক মাসউদ আহমাদ এবং শিশুসাহিত্যিক ইমরান পরশ।
বই-সংলাপ ও রিকশাচিত্র প্রদর্শন মঞ্চের আয়োজন
এই মঞ্চে বিকেল ৫টায় ‘প্রথম কবিতার বই: অনুভূতির দলিল’ প্রতিপাদ্যে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন আশনা হাবিব ভাবনা, স্নিগ্ধা বাউল, সঞ্জয় ঘোষ, রিপন আহসান রিতু, মীর রবি, মাশরুরা লাকী ও মিনহাজুল হক। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন কবি ফারহান ইশরাক ও কথাসাহিত্যিক খালিদ মারুফ।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদা, হাসানুজ্জামান কল্লোল, আমিনুর রহমান সুলতান, হাসানাত লোকমান, বদরুল হায়দার, ফারহানা রহমান, সঞ্জীব পুরোহিত, নূর-এ-জান্নাত, শিমুল পারভীন ও আরেফিন রব।
আবৃত্তি পরিবেশন করেন আশরাফুল আলম, রূপা চক্রবর্তী এবং আহ্কামউল্লাহ। এ ছাড়া ছিল ফকির সিরাজের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী’ এবং মানজারুল ইসলাম সুইটের পরিচালনায় ‘সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী’র পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়, কল্যাণী ঘোষ, শিবু রায়, মহাদেব ঘোষ, মিথুন জব্বার, বাবু জব্বার, আব্দুল হালিম খান, স্বর্ণময়ী মণ্ডল এবং জান্নাত-এ-ফেরদৌসী।