ঢাকা মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

বইমেলায় আমার ‘বেআইনি’ কাণ্ড

বইমেলায় আমার ‘বেআইনি’ কাণ্ড

মাহবুব কবির

মাহবুব কবির

প্রকাশ: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০১:০৪ | আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০৬:৩৫

একুশে বইমেলার আঁচ গায়ে লেগেছিল সেই কৈশোরেই। মফস্বল থেকে ’৯১ সালে ঢাকায় আসার পর কোনোবার কি বইমেলায় যাইনি– মনে পড়ে না। মনে পড়ে, কবিতায় তাতানো সেই সময়ে– নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে প্রতিদিনই মেলায় যেতাম। তখন বইমেলাকে বড়ো আপন-আপন লাগত। এখন তো করপোরেট-করপোরেট...।  

শাহবাগের আজিজ মার্কেট, পিজি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, টিএসসি, চারুকলার আড্ডারু-তরুণ লেখকদের ছাড়া কি বইমেলা জমত? দেখতাম ফেব্রুয়ারিজুড়ে সব আড্ডা ভাঙা। সবাইকে পাওয়া যেত বইমেলায়। মেলাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আড্ডা জমত। শামসুল কবিরের (ইচক দুয়েন্দে, কচি) ‘পেঁচা’ স্টলের কথা মনে পড়ল। সেই সময়ে কচি ভাইয়ের কাছে আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়েছি। ‘পেঁচা’ স্টলে আসতেন বিষ্ণু বিশ্বাস, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, সরকার মাসুদ, মঈন চৌধুরী, আমানউল্লাহ, সুমন রহমান, আবদুস সালাম (প্রয়াত), জুয়েল মাজহার, আশিক আকবর, আয়শা ঝর্না– আরও অনেকে। পেঁচা স্টল থেকে সংগ্রহ করেছিলাম সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের অন্তউড়ি: আধুনিক বাংলা পদ্য-রূপান্তরে চর্যাপদ। বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের পেছনে বহেড়াতলার আড্ডার কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল, বহেড়াতলায় ঢোকার মুখে বদরুল হায়দারের ‘বৈশাখী’ স্টলের কথা। এই স্টলে অনেক রাত কাটিয়েছি। তখন স্টলে রাতযাপনে বাধা ছিল না। গভীর রাতেও সুনসান মেলার ভেতরে-বাইরে ঘুরে বেড়িয়েছি। কর্তৃপক্ষের এত কড়াকড়ি ছিল না, এত পুলিশ ছিল না। আমরা অনেক স্বাধীন-স্বাধীন ছিলাম।   

মেলায় লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক-লেখকরা তাদের কাগজ হাতে-হাতেই বিক্রি-বিলি করতেন। তখন বইমেলায় লিটল ম্যাগাজিনের জন্য স্টল ছিল না। লিটন ম্যাগাজিন যেন অস্পৃশ্য, যেন হিজড়া, যেন ট্রান্সজেন্ডার...। একদিন খোন্দকার আশরাফ হোসেনের (প্রয়াত) হাত থেকে ‘একবিংশ’ কিনি। তিনি দাউদ আল হাফিজসহ (প্রয়াত) কয়েকজনকে নিয়ে বর্ধমান হাউসের সিঁড়িতে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন। সঙ্গে ছিল সদ্য বাঁধাইখানা থেকে আনা এক প্যাকেট ‘একবিংশ’ নতুন সংখ্যা। একদিন তপন বড়ুয়াকে দেখি ঘাসের ওপর পত্রিকা বিছিয়ে ‘গাণ্ডীব’ নিয়ে বসে আছেন। সঙ্গে সেলিম মোরশেদ, শান্তনু চৌধুরী, আহমেদ নকীবসহ অনেকেই...। এভাবেই কাজল শাহনেওয়াজের হাতে পেয়েছি ‘রহস্য খোলার রেঞ্চ’। রিফাত চৌধুরীর কাছে পেয়েছি ‘ছাঁট কাগজের মলাট’। সরকার মাসুদের ব্যাগ থেকে বেরিয়ে এসেছে ‘নিভৃতিচর্চা’। আমার ব্যাগ থেকে বেরিয়ে গেছে ‘সোমেশ্বরী’। ‘কিছুধ্বনি’ কিংবা ‘প্রান্ত’ নিয়ে ব্রাত্য রাইসুর সরগরম উপস্থিতি। ঢাকার বাইরে থেকে ‘লিরিক’ নিয়ে এজাজ ইউসুফী, ‘ক্যাথারসিস’ নিয়ে চিনু কবির, ‘সমুজ্জ্বল সুবাতাস’ নিয়ে হাফিজ রশিদ খান হাজির। এভাবে আমরা মেলায় আমাদের লিটল ম্যাগাজিন, বইপত্র এ-হাত, সে-হাত করতাম। 

’৯৩-এর একুশে বইমেলায় ‘বেআইনি’ এক কাণ্ড করে ফেলি আমি। প্ররোচনায় ছিলেন ‘গাণ্ডীব’ প্রকাশক হোসেন হায়দার চৌধুরী (রনি), রিফাত চৌধুরী, বদরুল হায়দার, বাহার রহমান। রনি ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডের বাসা থেকে টেবিল আনালেন। বদরুল হায়দার দিলেন প্রচুর লিটল ম্যাগাজিন। বইমেলা শুরুর সপ্তাহখানেক পরে আমি মেলার তথ্য কেন্দ্রের পাশে ‘লিটল ম্যাগাজিন কেন্দ্র’ লিখে দোকান সাজিয়ে বসে গেলাম। আড়ালে-আবডালে নয়– একেবারে বর্ধমান হাউসের সামনের সিঁড়ির বাঁ পাশে। প্রথম দিনেই সাড়া পড়ে গেল। সবাই আসছেন। মেলায় লিটল ম্যাগাজিনের একমাত্র স্টল। ভালো বিক্রি। সবাই তাদের কাগজ বিক্রির জন্য আমার হাতে দিয়ে যাচ্ছেন। ব্রাত্য রাইসু নিয়ে এলেন এক গাঁট্টি ‘প্রান্ত’, নূরুল আলম আতিক নিয়ে এলেন ‘নৃ’ সিরিজের এক গাঁট্টি ‘তারকোভস্কির ডায়েরি’, ‘সুলতানের সাক্ষাৎকার’। সরকার আশরাফ দিয়ে গেলেন ‘নিসর্গ’, শোয়াইব জিবরান দিয়ে গেলেন ‘কিউপিড’, রাজা সহিদুল আসলাম দিয়ে গেলেন ‘চালচিত্র’, সরকার আমিন দিয়ে গেলেন ‘মঙ্গলসন্ধ্যা’। এভাবে শত শত লিটল ম্যাগাজিনে টেবিল উপচে উঠল। প্রচুর বিক্রি। তিন-চার দিন পরে বাংলা একাডেমির এক কর্মকর্তা এসে ‘বেআইনিভাবে’ স্টল বসিয়েছি বলে উষ্মা প্রকাশ করে গেলেন। তার পরের দিন এলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ হারুন-অর-রশিদ। সঙ্গে মুহম্মদ নূরুল হুদা (সে-সময়ে পরিচালক, বর্তমানে মহাপরিচালক) এবং অন্যরা। মেলায় অনিয়ম বন্ধে পরিদর্শনে বেরিয়ে মহাপরিচালক একটি ‘উটকো’ স্টল দেখে বিস্মিত। জিজ্ঞেস করলেন, অনুমতি না নিয়ে ‘বেআইনিভাবে’ এখানে স্টল বসিয়েছেন কেন? আমি বললাম, এ-সব লিটল ম্যাগাজিন। একুশে বইমেলায় লিটল ম্যাগাজিনের জন্য কোনো স্টল নেই কেন? হারুন স্যার বিষয়টি সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গিয়ে আমার দাবির পক্ষ নিয়েই কথা বলতে লাগলেন। হুদা ভাইও তাই। দুটি কাগজ কিনলেনও হারুন স্যার। এর মধ্যে একটি আমার সম্পাদিত কবিতাপত্র ‘সোমেশ্বরী’। তাৎক্ষণিক তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন– আলো-আঁধারি বহেড়াতলা লাইটিং করে দেওয়া হচ্ছে, বহেড়াতলার বেদিতে ম্যাট বিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কাল থেকে ওখানে বসবেন। পরদিন থেকে লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে আমি বৈধভাবে বহেড়াতলায়। ’৯৪ সালেও বহেড়াতলায় লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে আমি একাই বসেছি। ’৯৫ থেকে স্টল সংখ্যা বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে বহেড়াতলা হয়ে ওঠে ‘লিটল ম্যাগাজিন চত্বর’।

প্রায় ৫০ বছরের পথচলায় একুশে বইমেলা এখন বিশাল। ঐতিহাসিকভাবে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির শক্তি এই বইমেলা। সারাদেশেই এখন বইমেলা হচ্ছে। বইমেলা হচ্ছে জেলা শহরে, এমনকি উপজেলা শহরেও। আগে এমনটা ছিল না। বাংলা একাডেমির অমর একুশে বইমেলাই সবখানে এই আলো ছড়িয়ে দিয়েছে। স্বাধীনতার পরে আমাদের যা-কিছু অর্জন, তার মধ্যে সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা এই বইমেলা– অনন্য। ভিন্নমত প্রকাশে, মুক্তবুদ্ধি ও চিন্তার বিকাশে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
লেখক: কবি
 

আরও পড়ুন

×