অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২৩ নিয়ে লেখক-প্রকাশকদের মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা বিরাজ করছে। ব্যস্ত সময় পার করছেন বই ছাপানো ও বাঁধাইয়ের সঙ্গে যুক্তরা। প্রকাশকরা শেষ মুহূর্তের দৌড়ঝাঁপ করছেন। এমন সময়ে জানা গেল, বছরের সবচেয়ে বড় আয়োজন ফেব্রুয়ারির অমর একুশে গ্রন্থমেলায় স্টল পাচ্ছে না প্রকাশনা সংস্থা আদর্শ।

বাংলাদেশে এখন যে ক'টি প্রতিষ্ঠান সুনামের সঙ্গে বই প্রকাশ করে আসছে, 'আদর্শ' তাদের একটি। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানটি প্রকাশনা চলিয়ে আসছে। এই সুদীর্ঘ সময়ে এখান থেকে প্রকাশ হয়েছে ছয়শর অধিক গ্রন্থ। এর সঙ্গে যুক্ত আছেন প্রায় তিনশ লেখক। এ ছাড়া প্রুফরিডার, সম্পাদনা সহকারী, বাঁধাইখানার শ্রমিক থেকে শুরু করে আরও বেশ কিছু লোকের কর্মসংস্থান করেছে এই প্রতিষ্ঠানটি। তাই স্বাভাবিকভাবেই এমন একটি প্রতিষ্ঠান যখন মেলায় অংশগ্রহণের জন্য এখনও স্টল বরাদ্দের বিষয়টির নিশ্চয়তা পায়নি, তখন এর সঙ্গে সংশ্নিষ্টদের মানসিক অবস্থা আমরা অনুমান করতে পারি।

বিগত কয়েক বছর ধরে আদর্শ মেলায় চারটি স্টল বরাদ্দ পেয়ে আসছিল। এবার প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে তাই বাংলা একাডেমির কাছে দাবি জানানো হয়েছিল, তাদের যেন প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেওয়া হয়। অধিক সংখ্যক বই এবং লেখক বিবেচনায় তারা এটি পেতেও পারে বলেই ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু অনেকটা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো জানা গেল- এইবার স্টলই পাচ্ছে না আদর্শ। কেন স্টল পাচ্ছে না, খোঁজ নিতে গেলে জানা গেল- আদর্শ প্রকাশিত তিনটি বই নিয়ে আপত্তি রয়েছে বাংলা একাডেমির। কোন তিনটি বই নিয়ে আপত্তি- এমন খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম বই তিনটি হচ্ছে- ফাহাম আবদুস সালামের 'বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে', জিয়া হাসানের 'উন্নয়ন বিভ্রম', ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের 'অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবনীয় কথামালা'। এই তিনটি বইকে বলা হচ্ছে 'ভিন্নমত' থাকায় প্রকাশনা সংস্থা হিসেবে আদর্শকে স্টল দেওয়া হচ্ছে না।

আমরা স্মরণ করতে পারি, বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল পাকিস্তানের তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর বিপক্ষে গিয়ে ভিন্নমতের কারণেই। এখন স্বাধীন দেশে স্বাধীনতার একান্ন বছর পরেও বই প্রকাশের জন্য একটি প্রকাশনা সংস্থার মেলায় অংশগ্রহণের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে 'ভিন্নমত'-এর দোহাই দিয়ে।

যে কোনো গ্রন্থের ভাষ্য নিয়ে যে কেউ আপত্তি তুলতে পারেন। তবে লেখার বদলে পাল্টা লেখা কিংবা যুক্তি দিয়ে তর্ক এগিয়ে যেতে পারে। সেটি না করে এসব বই প্রকাশের অভিযোগ এনে আদর্শকে বইমেলায় স্টল বরাদ্দ না দিলে কে জয়ী হবে?

বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে আয়োজিত এই মেলায় অংশ নিতে হলে আবেদনকারীকে হালনাগাদ ট্রেড লাইসেন্স, আয়কর সনদ, লেখকের সঙ্গে সম্পাদিত সর্বশেষ একটি চুক্তিপত্রের প্রথম ও শেষ পাতা, লেখককে প্রদত্ত সম্মানীর সাম্প্রতিক প্রমাণ এবং আর্কাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদপ্তরে গ্রন্থ জমা দেওয়ার রসিদ বা প্রত্যয়নপত্র, অক্টোবর ২০২২-এর মধ্যে প্রকাশিত কমপক্ষে ২০টি মানসম্মত বই একাডেমিতে জমা দিতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।

মজার বিষয় হচ্ছে, যে তিনটি বইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে আদর্শকে এবার আটকে দেওয়া হলো, সে তিনটি গত বছর বইমেলায় প্রকাশ হয়েছিল। এবং যথারীতি মেলায় প্রদর্শন ও বিক্রি হয়েছিল। তাহলে এই বছর হঠাৎ করে আপত্তি কেন জাগছে? তাহলে বইয়ের মান ও অন্যান্য কাগজ বা দলিল যাচাই শেষে স্টল বরাদ্দের ব্যাপারে বইমেলা পরিচালনা কমিটি গত বছর কি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছিল?

এবার আদর্শকে স্টল না দেওয়ার পেছনে এখনও যে ক'টি কারণ শোনা যাচ্ছে তার একটি হচ্ছে- উল্লিখিত তিনটি বইয়ের একটির লেখক ফাহাম আবদুস সালাম, যিনি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের জামাতা। এখন সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি যদি এই অজুহাত দেখিয়ে আদর্শকে মেলায় অংশগ্রহণের অধিকার বঞ্চিত করে, তা দেশের সামগ্রিক প্রাতিষ্ঠানিক দলীয়করণের বার্তাই ছড়িয়ে দেবে।

পক্ষে থাকলে সাধু আর বিপক্ষে থাকলে শয়তান- এই নীতি থেকে বের হয়ে খোলা চোখে তাকাতে হবে। আর এভাবে খোলা চোখে তাকানোর সক্ষমতা অর্জনের মধ্য দিয়েই দেশে ভিন্নমতকে মেনে নেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে উঠবে।

এহ্‌সান মাহমুদ: সহসম্পাদক, সমকাল