
বই হাতে নিয়ে একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছিলেন মোহিনী আক্তার। 'দৃষ্টিজয়ী' এ তরুণী অক্ষর ছুঁয়ে প্রতিটি শব্দ বোঝার চেষ্টা করছিলেন। তাঁর আশপাশে আরও কয়েকজন একইভাবে বই পড়ছিলেন। অমর একুশে বইমেলার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে স্পর্শ ব্রেইল ফাউন্ডেশনের স্টলের সামনে কথা হয় মোহিনীর সঙ্গে। রাজধানীর বদরুন্নেসা মহিলা কলেজের এ ছাত্রী বলেন, বই পড়তে ভালো লাগে। কিন্তু সব প্রিয় লেখকের বই পড়ার সুযোগ আমরা পাই না। কিছু প্রকাশনী যদি প্রতি বছর অন্তত একটি ব্রেইল বই আনে, তাহলে পড়ার আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়।
গতকাল রোববার মেলার ১৯তম দিনে বাংলা একাডেমির ড. মুহম্মদ এনামুল হক ভবনের সামনে স্পর্শ ব্রেইল ফাউন্ডেশনের স্টলে ভিড় দেখা গেল বেশ। দৃষ্টিজয়ী পাঠকদের জন্য বইমেলায় এই একটিই স্টল। সেখানে সাজানো হুমায়ূন আহমেদের 'সূর্যের দিন', মুহম্মদ জাফর ইকবালের 'আমার বন্ধু রাশেদ', কাইজার চৌধুরীর 'শোভনের একাত্তর' উপন্যাস। প্রিয় লেখকদের ব্রেইল বইগুলো উল্টে দেখছিলেন কয়েকজন। সেখানে কথা হয় আরেক দৃষ্টিজয়ী কলেজছাত্র তরিকুল ইসলাম নাজিমের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ২০১৭ সালে আমি ব্রেইলের এই প্রকাশনার খবর পাই। তার পর থেকে নিয়মিত আসা শুরু। আমি এখন ব্রেইল প্রকাশনার স্বেচ্ছাসেবক। বইমেলায় নতুন বই এলেই খবর পাই। অনেক ভালো বই চাইলেও পড়তে পারি না। অডিও বুক আছে। কিন্তু বইয়ের অক্ষরগুলো ছুঁয়ে দেখে পড়ার যে আনন্দ, তা কি অন্য কিছুতে পাওয়া যায়?
স্পর্শ ব্রেইল ফাউন্ডেশনের স্টলে বড় হরফে লেখা- মানুষ মূলত দৃষ্টিহীন বলে অন্ধ নয়, মানুষ প্রজ্ঞাহীন বলেই অন্ধ। জানা গেল, যাঁরা চোখে দেখতে পান না, তাঁদের বলা হয় 'দৃষ্টিজয়ী'। তাঁদের বই পড়ার পরিসর বিস্তৃত ও সহজ করার পরিকল্পনা নিয়ে ২০০৮ সালে যাত্রা শুরু করে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন স্পর্শ ব্রেইল ফাউন্ডেশন। ২০০৯ সালে 'স্পর্শ ব্রেইল কর্নার' প্রতিষ্ঠার পরের বছর বইমেলায় অংশগ্রহণের পর কিছুটা সাড়া মেলে। ওই বছর তারা প্রথম একটি ছড়ার বই ব্রেইল পদ্ধতিতে প্রকাশ করে। বাংলায় দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য প্রকাশিত প্রথম ব্রেইল বই 'ছড়ার তালে মনটা দোলে'। বইটির লেখক ও প্রকাশক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন স্পর্শ ব্রেইল কর্নারের প্রতিষ্ঠাতা নাজিয়া জাবীন। এর পরই তাঁর গল্পগ্রন্থ 'বিনির সাথে পুতুল বিয়ে' ব্রেইলে রূপান্তর করেন। ২০১২ সালে স্পর্শ ব্রেইল ফাউন্ডেশন বইমেলায় স্টল নেয়। স্টল দেখে ব্রেইল বই প্রকাশ বিষয়ে প্রথম এগিয়ে আসেন প্রকাশনা সংস্থা সাহিত্য প্রকাশের কর্ণধার মফিদুল হক। ১৫ বছরের পথচলায় স্পর্শ ফাউন্ডেশন এ পর্যন্ত ১৩১টি গল্প, কবিতা ও উপন্যাস ব্রেইলে রূপান্তর করেছে।
নাজিয়া জাবীন বলেন, এ দেশে দৃষ্টিহীন মানুষ একেবারে কম নন। তাঁরা শুধু পাঠ্যবইয়ের মধ্যে আটকে থাকতে চান না। তাঁরা হুমায়ূন আহমেদ পড়তে চান, জাফর ইকবাল পড়তে চান। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তাঁদের মনের জানালা খুলে দেওয়ার জন্য এই চাহিদা মেটানোর নূ্যনতম উদ্যোগ নেই। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারিভাবে পাঠ্যবইগুলো ব্রেইল করে সরবরাহ করা হলেও অন্য বই প্রকাশ হয় না। অথচ সাহিত্য পাঠে তাঁদের অপরিসীম আগ্রহ। সিসিমপুরের মতো প্রতিষ্ঠান এবার বইমেলায় তাদের ১০টি বই দিচ্ছে। যে শিশুর মাত্র অক্ষরজ্ঞান হলো, সে সিসিমপুরে ওই বইগুলো হাতে নিয়ে হারিয়ে যায় কল্পনার রাজ্যে।
তিনি জানান, এবার ৩০টি বই প্রকাশ করেছে স্পর্শ। ৮০ জন দৃষ্টিহীন তরুণ স্পর্শের স্টলে নিবন্ধন করেছেন। আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি নতুন ব্রেইল বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের পর বইগুলো বিনামূল্যে তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। বইগুলোর মধ্যে রয়েছে- বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'চাঁদের পাহাড়', বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের 'সুলতানার স্বপ্ন', লুৎফর রহমান রিটনের 'ভূতের ডিমের অমলেট', মুহম্মদ জাফর ইকবালের 'যারা বায়োবট', আনজীর লিটনের 'বাবা বাড়ি ফেরেনি'।
জাতীয় গণগ্রন্থাগার, শিশু একাডেমি পাঠাগারসহ বিভিন্ন জায়গায় ব্রেইল কর্নার করা হয়েছে জানিয়ে নাজিয়া বলেন, ব্রেইল বই প্রকাশে প্রতিটি পৃষ্ঠায় খরচ হয় ৮ থেকে ১০ টাকা। সাধারণ বইয়ের একটি পাতা ব্রেইল বইয়ে হয়ে যায় তিন পাতা। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্রেইল বই প্রকাশের উদ্যোগ নিলেও বইমেলার সহআয়োজক বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির নেতাদের এতে আগ্রহ নেই।
এ বিষয়ে সমিতির উপদেষ্টা ও আগামী প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ওসমান গণি বলেন, একবার ব্রেইল বই প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলাম, কিন্তু সেটি ভেস্তে গেছে। এখন সরকার কিছু সহযোগিতা করলে ব্রেইল বই প্রকাশ করতে পারি।
এদিকে অমর একুশে বইমেলার ১৯ দিনে মোট নতুন বই এসেছে দুই হাজার ১৮১টি। বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে ছিল গোবিন্দচন্দ্র দেব ও ভাষাসংগ্রামী গাজীউল হক শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন গাজী আজিজুর রহমান ও আমিনুর রহমান সুলতান। আলোচনায় অংশ নেন খান মাহবুব, হাসান অরিন্দম, শিহাব শাহরিয়ার, পাপড়ি রহমান ও রাজীব কুমার সরকার। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন আবু মো. দেলোয়ার হোসেন।
'লেখক বলছি' অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কামরুল হাসান, ফজলুর রহমান, জেবউননেছা ও শিবুকান্তি দাশ। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করেন নূরুন্নাহার শিরীন, সরকার মাসুদ, কাজী আসাদুজ্জামান, কাজী আনারকলি, হাসান শরীফ ও আসাদ কাজল।
মন্তব্য করুন