সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি প্রান্তের ফটকে দীর্ঘ লাইন। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর অমর একুশে বইমেলা প্রাঙ্গণে ঢুকতেই জনস্রোতে দাঁড়ানোর জায়গা পাওয়া মুশকিল হয়ে গেল। মাত্র দুপুর গড়িয়েছে। স্টলে স্টলে তখনই দর্শক-পাঠকের ভিড়। শেষ সময়ে পছন্দের বই কিনতে ব্যস্ত তাঁরা। সন্ধ্যার পর থেকে এক-দু'জন করে বের হতে শুরু করেন। অধিকাংশের হাতে ছিল বইয়ের ব্যাগ।

গত বৃহস্পতিবার বইমেলায় বোমা হামলার হুমকি দিয়ে ?বাংলা একাডেমির মহাপরিচালককে চিঠি দেয় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম। তবে এর পরদিন শুক্রবার উড়োচিঠির কোনো প্রভাব চোখে পড়েনি বইমেলায়। বরং সকাল থেকেই টিএসসি, রমনা কালীমন্দির ও ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের ফটকে দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। বেলা ১১টায় মেলার দুয়ার খোলার সঙ্গে সঙ্গে দর্শক-ক্রেতার যে দীর্ঘ লাইন শুরু হয়, তা রাতে মেলা শেষ পর্যন্ত ছিল।

আজিমপুর থেকে মেলায় এসেছিলেন ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী সুস্মিতা ও কঙ্কন। স্টলে গিয়ে তালিকা ধরে বই সংগ্রহ করছিলেন দুই বান্ধবী। তাঁরা বলেন, এর আগেও তিন দিন মেলায় এসেছেন। তখন দু'জন দুটি বই কিনেছিলেন। সেই সঙ্গে স্টল থেকে বইয়ের তালিকা নিয়ে গিয়েছিলেন। গতকাল মেলা সে রকম না ঘুরে তালিকা ধরে বই কিনেছেন।

ঐতিহ্য প্রকাশনীর ব্যবস্থাপক আমজাদ হোসেন কাজল বলেন, করোনা শুরুর আগের বইমেলার মতো বিক্রি না হলেও এবার বেচাকেনা খারাপ হয়নি। তবে এ বছর যে হারে মেলায় দর্শনার্থী আসছেন, সে হারে বিক্রি নেই। শেষ শুক্রবারে অনেক পাঠক বই কিনেছেন।

অনন্যা প্রকাশনীর প্যাভিলিয়নে কথা হয় কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের সঙ্গে। তিনি বলেন, শুরুতে বইমেলায় যে আশা দেখা গিয়েছিল; শেষে পাঠকের সে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। করোনাকালের পর বইমেলায় অনেক মানুষ এসেছে ঠিক, কিন্তু বই তেমন বিক্রি হয়নি। এটা ভালো লক্ষণ নয়। এমন চলতে থাকলে একটা সময় বইমেলা বেড়ানো ও সেলফি তোলার কেন্দ্র হয়ে উঠবে। তবে বই কেনার প্রতি শিশুদের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।

গতকাল সকালে বইমেলায় আসেন জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমেদ। তিনি বলেন, বোমা হামলার হুমকি দিয়ে পাঠানো উড়োচিঠির প্রভাব মেলায় পড়েনি। বরং সকালে যখন টিএসসি প্রান্ত দিয়ে মেলায় ঢুকি, তখন দীর্ঘ লাইন ছিল। অনেকে দল বেঁধে পরিবার ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে এসেছেন। মেলা শেষে ফেরার পথে অনেকের হাতে বইয়ের ব্যাগ দেখা গেছে।

অনন্যা প্রকাশনী থেকে এসেছে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বই 'আমার রাজনীতির রোজনামচা'। বিকেলে প্রকাশনীর প্যাভিলিয়নে বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন তিনি। এ সময় বলেন, আমার ৪৪ বছরের রাজনৈতিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিক, বাঁক বদল, বক্তৃতা এই বইয়ে স্থান পেয়েছে। আত্মজীবনী লেখার প্রাথমিক কাজ এ বইটি।

বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্রের সামনে এ বছর প্রকাশিত ৩০টি ব্রেইল বইয়ের প্রকাশনা উৎসব করেছে স্পর্শ ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশন বইমেলায় ১২ বছর ধরে অংশগ্রহণ করেছে। প্রতিষ্ঠার ১৫ বছরে প্রকাশ করেছে ১৩১টি ব্রেইল বই। গতকাল ৩০টি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কথাসাহিত্যিক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, অমর একুশে বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ডা. কে এম মুজাহিদুল ইসলাম, সিসিমপুরের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শাহ আলম প্রমুখ। অনুষ্ঠান সমন্বয় করেন স্পর্শ ফাউন্ডেশনের প্রধান উদ্যোক্তা নাজিয়া জাবীন।

গতকাল বইমেলার ২৪তম দিনে নতুন বই এসেছে ২৩৯টি। এদিন বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত মেলায় ছিল শিশুপ্রহর। সকাল সাড়ে ১০টায় শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি ও সংগীত প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা; সভাপতিত্ব করেন নাট্যজন ফেরদৌসী মজুমদার। অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি ও সংগীত প্রতিযোগিতার আহ্বায়ক কাজী রুমানা আহমেদ সোমা, সায়েরা হাবীব, ফারহানা খানমসহ সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাবৃন্দ।

শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা: ক-শাখায় ওয়াকিয়া নূর (প্রথম), আফফান আল হাসনাইন (দ্বিতীয়), রুজাইনাহ মারিফা (তৃতীয়); খ-শাখায় প্রত্যয় পাল রাজ (প্রথম), তাসনিয়াহ সিদ্দিক (দ্বিতীয়), শাফিন উদ্দিন আহম্মেদ (তৃতীয়); গ-শাখায় অর্নিলা ভৌমিক (প্রথম) আল মুমিনুর (দ্বিতীয়), জায়ীফা তাসনীম (তৃতীয়) স্থান লাভ করে।

শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতা: ক-শাখায় আরোহী বর্ণমালা (প্রথম), অংকিতা সাহা রুদ্র (দ্বিতীয়) এবং জুমানা হোসেন (তৃতীয়); খ-শাখায় সমৃদ্ধি সূচনা স্বর্গ (প্রথম), আনিশা আমিন (দ্বিতীয়) এবং অদ্রিতা ভদ্র (তৃতীয়) এবং গ-শাখায় আদিবা সুলতানা (প্রথম), তাজকিয়া তাহরীম শাশা (দ্বিতীয়) এবং সিমরিন শাহিন রূপকথা (তৃতীয়) স্থান লাভ করে।

শিশু-কিশোর সংগীত প্রতিযোগিতা: ক-শাখায় নীলান্তী নীলাম্বরী তিতির (প্রথম), অন্বেষা মজুমদার (দ্বিতীয়) এবং সার্থক সাহা (তৃতীয়); খ-শাখায় রোদোসী নূর সিদ্দিকী (প্রথম), তানজিম বিন তাজ প্রত্যয় (দ্বিতীয়) এবং মৈত্রেয়ী ঘোষ (তৃতীয়) স্থান লাভ করে।

বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে ছিল 'আধুনিকতা, উত্তর-আধুনিকতা ও পরবর্তীকালের সাহিত্যতত্ত্ব' শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মাসুদুজ্জামান। আলোচনায় অংশ নেন নিরঞ্জন অধিকারী, এজাজ ইউসুফী, বিপ্লব মোস্তাফিজ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন রাশিদ আসকারী। 'লেখক বলছি' অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন আশরাফ জুয়েল, রণজিৎ সরকার, মেহেদী হাসান শোয়েব ও কানিজ পারিজাত।