প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাম্প্রতিক এলডিসি সম্মেলন উপলক্ষে কাতারের রাজধানী দোহায় অবস্থানকালে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার পক্ষে সাংবাদিক নিক ক্লার্ক একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। সাক্ষাৎকারটি ইংরেজি থেকে ঈষৎ সংক্ষেপে ভাষান্তর করেছেন সাইফুর রহমান তপন

আলজাজিরা: আলজাজিরাকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমাদের অবশ্যই শুরু করা উচিত রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে; বিশেষ করে সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে। যার ফলে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা তাদের ঘর হারিয়েছে। প্রথম প্রশ্ন– এ বিষয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী? দ্বিতীয় প্রশ্ন, সেখানে আশ্রিত লক্ষ রোহিঙ্গাকে আপনি কীভাবে আশ্বস্ত করতে চান– তাদের জন্য কিছু করা হচ্ছে?

শেখ হাসিনা: ঘটনাটা যখন শুরু হলো, আমরা দেখলাম মানুষ নির্যাতিত হচ্ছে; ধর্ষিত হচ্ছে; খুন হচ্ছে। তখন আমাদের খুব খারাপ লাগল। আমাদের সীমান্ত খুলে দিলাম, যাতে তারা এখানে আসতে পারে। তাদের থাকা, চিকিৎসার ব্যবস্থা ইত্যাদি করলাম মানবিক কারণে। এর পাশাপাশি আমরা মিয়ানমারের সঙ্গেও আলোচনা শুরু করি। তাদের বলি– এরা তোমাদের নাগরিক। তোমাদের উচিত তাদের ফিরিয়ে নেওয়া। দুর্ভাগ্যবশত, তারা খুব ইতিবাচক কোনো সাড়া দেয়নি।

আলজাজিরা: আপনারা কি এখনও মিয়ানমারের নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন?

শেখ হাসিনা: হ্যাঁ। এর মধ্যে অবশ্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বহু সদস্য দেশ রোহিঙ্গাদের সহায়তার উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসে। তবে এরই মধ্যে পাঁচ বছর হয়ে গেল। আমি মনে করি, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়া উচিত।

আলজাজিরা: আপনি যে কারণে দোহায় এসেছেন– এলডিসি বা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সম্মেলনে; সেখানে আপনি বলেছেন, দান-অনুদান নয়, ন্যায্য পাওনা চাই। কী বোঝাচ্ছেন এটি দিয়ে?

শেখ হাসিনা: হ্যাঁ, আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্দেশে আমাদের অধিকারের কথা বলেছি। আমি বলেছি, আমরা আমাদের উন্নতির লক্ষ্যে কাজ করে চলেছি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত আমাদের সহযোগিতা করা। আমরা অনেকেই স্বল্পোন্নত অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসছি; আরও অনেকেই তা চায়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, উন্নত দেশগুলো এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উচিত তাদের পাশে দাঁড়ানো। আমি বলেছি, এ সহযোগিতা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর প্রাপ্য। এটি তাদের অধিকার।

আলজাজিরা: আমার ধারণা, বাংলাদেশ নিজেই ২০২৬ সালের মধ্যে কোনো এক সময়ে এলডিসি থেকে বেরিয়ে আসবে। বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে স্বাধীনতার পর থেকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। কভিডের আগের বছর দেশটি ৭ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যা চীনের একটু নিচে হলেও ভারতের বেশ ওপরে। ঢাকায় এখন মেট্রোরেল চলমান। আমার প্রশ্ন হলো, এসবের পেছনে চালিকাশক্তি কোনটা?

শেখ হাসিনা: আপনি জানেন, আমাদের সম্পদ খুব সীমিত। তবে আমাকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, আমাদের জনগণ খুব চমৎকার, ভীষণ সহিষ্ণু। তবে উন্নতির বিষয়টা নির্ভর করে, আপনি কোন নীতি অবলম্বন করছেন তার ওপর। আমরা একটা সঠিক পরিকল্পনা করতে পেরেছি। পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি, স্বল্পমেয়াদি এবং আশু পরিকল্পনা তৈরি করি।

আলজাজিরা: এবং এগুলোই ভালো ফল বয়ে এনেছে।

শেখ হাসিনা: হ্যাঁ। আমরা ধাপে ধাপে আমাদের অগ্রগতি সাধন করেছি।

আলজাজিরা: আচ্ছা, বাংলাদেশ এখনও বহুলাংশে তৈরি পোশাকের ওপর নির্ভরশীল। এই একক খাতের ওপর নির্ভরতা দেশটার নাজুকতাই তুলে ধরে। এ থেকে বেরিয়ে এসে দেশের অর্থনীতির ভিত আরও মজবুত করার জন্য অভ্যন্তরীণভাবে কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন?

শেখ হাসিনা: প্রথমেই আমরা জোর দিয়েছি গবেষণার ওপর। এর মাধ্যমে আমরা খাদ্য উৎপাদন বাড়িয়েছি। আমাদের জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছি। তারপর শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ জনগণের মৌলিক প্রয়োজনগুলো মেটানোর লক্ষ্যে কাজ করার পাশাপাশি কাজের সুযোগ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি। এ জন্য বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করেছি। রাষ্ট্রায়ত্ত খাত আছে, তবে সব খাত বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। দেশি উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকেও উৎসাহ দিয়েছি। আমরা তরুণ প্রজন্মকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরির ঘোষণা দিয়েছিলাম। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে গুরুত্ব দিই। বর্তমানে দেশের প্রতিটি প্রান্তে ওয়াইফাই সংযোগ সহজলভ্য। সাবমেরিন কেবলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি সব স্থানে ব্রডব্যান্ড সংযোগ সহজপ্রাপ্য করা হয়েছে। আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদনে জোর দিই। তার ফল হিসেবে দেশের সর্বত্র এখন বিদ্যুৎ পাওয়া যায়।

আলজাজিরা: এখন কিন্তু বেশ লোডশেডিং হচ্ছে। আমরা বুঝতে পারছি, বাংলাদেশ বেশ উন্নতি করেছে। তবে প্রধানমন্ত্রী, হঠাৎ করেই অর্থনীতি সংকটে পড়েছে; ডলার সংকট তৈরি হয়েছে; জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় মেটাতে মানুষকে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় আমরা রাজপথেও মানুষের বিক্ষোভ দেখতে পাচ্ছি। প্রশ্ন হলো– এটি থামাবেন কীভাবে?

শেখ হাসিনা: দেখুন, আমাদের মুদ্রানীতি বেশ সময়ানুগ ও বাস্তবধর্মী। আগে যেমনটা বলেছি, আমরা প্রথমে মানুষকে শিক্ষিত করার চেষ্টা করেছি। তার সঙ্গে কাজের সুযোগ তৈরি করেছি। ফলে জনগণ নিজেই নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে নিতে পারছে। দ্বিতীয়ত, আমরা কানেকটিভিটিতে জোর দিয়েছি; ওয়াইফাই, স্যাটেলাইট স্থাপন ইত্যাদি। এ সবকিছুই কিন্তু কাজের সুযোগ তৈরি করছে।

আলজাজিরা: এগুলো তো দীর্ঘমেয়াদি বিষয়। আমি জানতে চাচ্ছি আশু সমস্যা মোকাবিলার উপায়।

শেখ হাসিনা: আমি আপনাকে বলছি, আমরা ধাপে ধাপে উন্নতি করছি। আমাদের তৈরি পোশাক হলো একটা খাত। এর পাশাপাশি রপ্তানি পণ্য বৃদ্ধির কাজও চলছে। রপ্তানির লক্ষ্যে খাদ্য উৎপাদন চলছে। আমাদের কোম্পানি আইনকে সংশোধন করে এক ব্যক্তিও যাতে লিমিটেড কোম্পানি গড়তে পারেন, সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্টার্টআপের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি; দেশের বিভিন্ন স্থানে ইনকিউবেশন সেন্টার, হাই-টেক পার্ক হচ্ছে। অর্থাৎ আমরা তথ্যপ্রযুক্তির ওপর জোর দিয়েছি। সামনের দিনে আমাদের লক্ষ্য হলো ডিজিটাল ডিভাইস রপ্তানি করা এবং এর মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি।

আলজাজিরা: অর্থাৎ সেখানে প্রচুর সুযোগ তৈরি হচ্ছে...

শেখ হাসিনা: আমাকে বক্তব্য শেষ করতে দিন, প্লিজ। আমাদের অর্থ ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মুদ্রানীতিও সাজানো হচ্ছে, যাতে মানুষকে বেশি কষ্ট সহ্য করতে না হয়।

আলজাজিরা: তার পরও কিন্তু অসন্তোষ আছে। আমি আরেকটা বিষয়ে যেতে চাই, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কথা বলতে চাই। এক সময় অধিকাংশ মানুষ মনে করত, বাংলাদেশ মানেই ঘূর্ণিঝড়, প্রলয়ংকরী বন্যা– এগুলো সত্যি। তবে এর উল্টো দিকও আছে। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোতেও দারুণ সক্ষমতা দেখিয়েছে। আপনি কি একটু বলবেন, সেখানে কী ধরনের কার্যক্রম চলছে?

শেখ হাসিনা: ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই আমাদের জনগণকে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয়– এটি সত্য। তবে আমরা জানি কীভাবে এসব মোকাবেলা করতে হয়। দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি থাকে। আমরা ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকায় ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করেছি। আমাদের চরগুলোরও উন্নয়ন সাধন করেছি। ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রগুলো বহুমুখী ব্যবহার-উপযোগী করে নির্মিত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের সময় আমরা লোকদের সেখানে নিয়ে আসি। অন্য সময় স্কুল ও অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হয় এগুলো। আমরা ৮৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবক তৈরি করেছি, যারা দুর্যোগকালে মানুষের সহায়তায় হাত বাড়িয়ে দেয়। বন্যার্তদের জন্যও আমরা আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করেছি। তাদের নানাভাবে সহায়তা জোগাই। বাংলাদেশ নদ-নদীর দেশ। এগুলোকে আমরা খননের মাধ্যমে বেশি পানি ধারণের উপযোগী করে তৈরি করছি। আমাদের সেচের কাজেও যা বেশ ভূমিকা রাখে।

আলজাজিরা: তৎসত্ত্বেও সমুদ্রতলের বৃদ্ধির কারণে অসংখ্য মানুষ উদ্বাস্তু হিসেবে মূল ভূমির দিকে আসতে পারে। এটি ঠেকাতে আপনি কী করছেন?

শেখ হাসিনা: যেসব উপকূলীয় এলাকা এমন শঙ্কার মধ্যে আছে, সেগুলোকে লক্ষ্য করে আমরা বিশেষ উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছি, যাতে মানুষকে অভিবাসী হতে না হয়। এর পাশাপাশি আমরা উপকূলজুড়ে কৃত্রিম ম্যানগ্রোভ বন, সবুজ বেষ্টনী ইত্যাদি সৃজন করছি প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে এলাকাগুলোকে রক্ষার জন্য।

আলজাজিরা: প্রধানমন্ত্রী, আমরা একটু নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে চাই, যা এ বছরের শেষদিকে অনুষ্ঠিত হতে পারে। পাশ্চাত্যে সংবাদমাধ্যমে আপনার বিষয়ে প্রায়ই দুটি শব্দ ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। এর একটা হলো, আমাকে ক্ষমা করবেন তা বলার জন্য– আপনি হলেন কর্তৃত্ববাদী। আপনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাই।

শেখ হাসিনা: কর্তৃত্ববাদী আমি?

আলজাজিরা: হ্যাঁ।

শেখ হাসিনা: পাশ্চাত্যে সংবাদমাধ্যম বা আপনার আলজাজিরা আমাকে যদি বলে কর্তৃত্ববাদী; আমার দেশ যখন সামরিক একনায়কদের দ্বারা শাসিত হচ্ছিল, সেটাকে তারা কী বলবে? তাদের কেউই জনগণের ভোটে নির্বাচিত ছিল না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমার বাবা জাতির পিতা, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়। শুধু তাঁকেই নয়; আমরা মা, আমার তিন ভাই, দুই ভ্রাতৃবধূ, আমার চাচাসহ মোট ১৮ জনকে তখন হত্যা করা হয়। এর মধ্য দিয়ে সামরিক শাসক সংবিধান ও সেনা আইন লঙ্ঘন করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। তাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছি। জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে এনেছি। শুধু তাই নয়; মানুষকে তার ক্ষমতা সম্পর্কে, জনগণের ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন করেছি।

আলজাজিরা: আমি বুঝতে পারছি আপনার কথা। কিন্তু জাতিসংঘের তৎকালীন মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট, যিনি কিছুদিন আগে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন– বিনা বিচারে হত্যা, গুম এবং এসব মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে জবাবদিহিবিষয়ক অভিযোগ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি এ বিষয়ে স্বাধীন তদন্তেরও আহ্বান জানিয়েছিলেন। আপনার সরকার কি সে রকম কোনো তদন্ত করেছে?

শেখ হাসিনা: অবশ্যই। যখনই কোনো ঘটনা ঘটেছে, তখনই আমরা এর বিরুদ্ধে তৎপর হয়েছি এবং দোষীদের আইনের আওতায় এনেছি।...

আলজাজিরা: কিন্তু হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, বাংলাদেশে মানবাধিকারের পক্ষের লোকদের বিরুদ্ধে ভীতি প্রদর্শন, হুমকি প্রদান অব্যাহত রয়েছে। গত জানুয়ারিতেই তারা এ রকম অভিযোগ করেছে?

শেখ হাসিনা: আমি জানি এগুলো। কিছু লোক আছে, যারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে এসব অভিযোগ তুলছে। নির্বাচিত হয়ে ২০০৯ সালে সরকার গঠন করার পর থেকে আমরা অব্যাহতভাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি। এ কারণেই আমরা বিপুল অগ্রগতি সাধন করতে পেরেছি– অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিকভাবে। দেখুন আমাদের দারিদ্র্যের হার ২০০৫-০৬ সালে ছিল ৪১ শতাংশ। আমরা এটাকে ২০ শতাংশে নামিয়ে এনেছি। আমাদের প্রবৃদ্ধি তখন ছিল খুবই কম, যা আমরা অনেক বাড়িয়েছি। কভিডের আগের বছর আমাদের প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশিমক ১ শতাংশ। এখন এটা পরিস্থিতির কারণে কমে গেছে। তার পরও তা ৭ শতাংশের কাছাকাছি...

আলজাজিরা: কিন্তু গুম হওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে কী বলবেন?

শেখ হাসিনা: আমি বলছি, আমি আপনাকে বলছি তারা কারা। আমাদের সাক্ষরতার হার ছিল ৪৫ শতাংশ। আমরা তা ৭৫ দশমিক ২ শতাংশে উন্নীত করেছি। আমার কথা হলো, আমরা যদি মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ এত অপকর্মে লিপ্ত থাকি, আমরা কী করে এসব উন্নতি সাধন করলাম?...

আলজাজিরা: এখন জনগণ কি সামনের নির্বাচনে ভোট দিতে পারবে?...

শেখ হাসিনা: আমি বলছি... আমাকে কথা শেষ করতে দিন। যারা এগুলো বলছে, তারা কে– আপনাকে তা জানতে হবে। আসলে তারা চায় না দেশটা নিরবচ্ছিন্ন অগ্রগতির পথে থাকুক; নিরবচ্ছিন্ন অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করুক। তারা সবসময় চায়, এখানে একটা অসাংবিধানিক সরকার থাকুক, যাতে তারা কিছু করার সুযোগ পায়।

আলজাজিরা: আমরা নির্বাচনের কথায় ফিরে যাই...

শেখ হাসিনা: না না...শুনুন...

আলজাজিরা: আমি অনুরোধ করছি, নির্বাচন নিয়ে কিছু বলুন...

শেখ হাসিনা: ঠিক আছে, আমাকে আমার অবস্থান তুলে ধরতে দিন। আমার পুরো পরিবারকে যখন খুন করা হলো; আমি দেশে ফিরতে পারিনি, আমার বোনও পারেনি। আমার কোনো আত্মীয়কেও ফিরতে দেওয়া হয়নি। আমাদেরকে উদ্বাস্তু হিসেবে অন্য দেশে বাস করতে হয়েছে। আমি যখন দেশে ফিরলাম, তখনও খুনিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারিনি। কারণ খুনিরা দায়মুক্তি পেয়েছিল। কেবল আমি যখন প্রধানমন্ত্রী হলাম, তখন ওই দায়মুক্তি আইন বাতিল করেছি...

আলজাজিরা: হ্যাঁ; আপনি নিজেই বলেছেন, আপনি অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন চান। সেখানে একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছিল, যেটি নির্বাচন তত্ত্বাবধান করত। ২০০৮ সালে এ ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচনে আপনি ক্ষমতায় এসেছিলেন; এর পর তা বাতিল করা হয়। এখন বিরোধী দলগুলো ওই ব্যবস্থাটির পুনর্বহাল চায়। আপনি কি ওই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাটির পুনর্বহাল অনুমোদন করবেন, যাতে সবাই দেখতে পায়– আগামী নির্বাচনটি অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে?

শেখ হাসিনা: এ নিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা বড় তিক্ত। আজকে যে দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়, তারাই ব্যবস্থাটির বিকৃতি ঘটিয়েছে; আমি নই। ২০০১ সালে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচিত হয়েছিল; তারা শুধু মানবাধিকারই লঙ্ঘন করেনি, মানুষ খুন করেছে। তারা দেশটাকে ধ্বংস করেছে। অর্থনীতি ধ্বংস করেছে। তখন পরপর পাঁচবার দেশ দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। আমি নিজেও তাদের হামলার শিকার হয়েছি। তারা আমাকে বহুবার হত্যা করার চেষ্টা করেছে। গ্রেনেড হামলা করেছে, যেখানে নারীনেত্রী আইভি রহমানসহ আমাদের ২২ জন খুন হন। আমি কোনো ন্যায়বিচার পাইনি তখন। এক ঘণ্টায় সারাদেশে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে তারা। তারা দেশটাকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছিল...

আলজাজিরা: আমি জানি... আগামী নির্বাচন অবাধ ও স্বচ্ছ হওয়ার বিষয়ে কি আপনি নিশ্চয়তা দেবেন? কারণ গত দুটি নির্বাচন কিন্তু তেমন হয়নি।

শেখ হাসিনা: গত দুটি নির্বাচন নিয়ে তারা প্রশ্ন তুললেও তা কিন্তু তারা প্রমাণ করতে পারেনি। নির্বাচন সুষ্ঠু ছিল। জনগণ আমার দলকে ভোট দিয়েছে। বিএনপি সে নির্বাচনে অংশ নেয়নি। কারণ তাদের নেতারা সবাই দুর্নীতি; অস্ত্র চোরাচালান আর গ্রেনেড হামলার দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত। এমনকি তাদের দলীয় গঠনতন্ত্রে লেখা আছে– যে কেউ দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি বা সন্ত্রাসবাদের দায়ে অভিযুক্ত হলে...

আলজাজিরা: আপনার বাবা জাতির পিতার কথা আপনিই বলেছেন, তিনি ১৯৭৫ সালে পরিবারের সদস্যসহ খুন হয়েছেন। আপনি মন থেকে বলবেন– আপনি কি মনে করেন, এই যে ১৯ বছর আপনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যেভাবে দেশ চালাচ্ছেন; তার সঙ্গে আপনার বাবার দৃষ্টিভঙ্গির সাযুজ্য আছে?

শেখ হাসিনা: হ্যাঁ, আমার বাবা আর বেঁচে নেই। তবে আমি তাঁর আদর্শ অনুসরণ করি। তিনি যে জনগণকে ভালোবাসতেন, আমি সেই জনগণের কল্যাণের জন্য কাজ করি। তিনি যেভাবে তাদের সেবা করতে চাইতেন, আমিও সেভাবে তাদের সেবা করছি। ২০০৯ থেকে ২০২৩– দেশে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আমি মনে করি, এর পেছনে আছে আমার বাবার আশীর্বাদ। বাবার আশীর্বাদ না থাকলে আমি দেশের এত উন্নতি করতে পারতাম না। অবশ্যই আমি যা করছি, তা বেহেস্ত থেকে তিনি দেখছেন। তিনি অন্তত এ বিষয়ে সন্তুষ্ট যে, তাঁর দরিদ্র জনগণকে আমি সহায়তা করছি।

আলজাজিরা: শেখ হাসিনা, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, আপনাকে ধন্যবাদ আলজাজিরার সঙ্গে কথা বলার জন্য।

শেখ হাসিনা: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।