ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ষাটোর্ধ্ব সফিকুল ইসলামের মাথার কাছে বসে হাতপাখার বাতাস করছেন মেয়ে আরমিন আক্তার। তীব্র গরমে গত মঙ্গলবার ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তিনি ভর্তি হয়েছেন। কক্ষের বাইরে কিছুটা গরম কম থাকায় বারান্দায় বিছানা নিয়েছেন। তীব্র গরমে সেখানেও ত্রাহি অবস্থা। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরলেও সে বাতাসও উত্তাপ ছড়াচ্ছে। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই বিদ্যুৎ থাকছে না। থাকলেও লো-ভোল্টেজ। তাই হাতপাখার বাতাসে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছেন রোগীর স্বজনরা। ময়মনসিংহ সদর থেকে ২১ কিলোমিটার দূরের ফুলবাড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি একরকম ধুঁকছে। জেনারেটর দিয়ে বিকল্প ব্যবস্থায় অপারেশন থিয়েটার চালু থাকলেও অস্ত্রোপচার কমিয়ে আনতে হয়েছে। বুধবার দুপুর ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত ফুলবাড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অবস্থান করে দেখা গেছে মানুষের নানা কষ্টের চিত্র।

তীব্র গরমে হাসপাতালের বহির্বিভাগে রোগীর উপস্থিতি খুব কম। তবে হাসপাতালে ভর্তি রোগী এখনও অনেক। উপজেলাটিতে দেড় মাস ধরে বিদ্যুৎহীনতা ও লো-ভোল্টেজ সমস্যা চলছে। আন্তঃবিভাগে ভর্তি থাকা রোগীদের ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, গরমে অস্থির অবস্থা তাঁদের। অনেকে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছেন। অথচ মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে। ফুলবাড়িয়া গ্রামের রিফাত মিয়া তাঁর ভাতিজি হুজাইফাকে (৩) নিয়ে মঙ্গলবার ভর্তি হয়েছেন। তীব্র গরমে শিশুটির কষ্ট হওয়ায় মাথার কাছে দাঁড়িয়ে বাতাস করছিলেন রিফাত। তিনি বলেন, ফ্যান ঘুরলেও তাতে কোনো কাজ হয় না।

গত বছরের ১৭ অক্টোবর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে প্রথম অস্ত্রোপচার চালু করা হয়। সিজারের মাধ্যমে অস্ত্রোপচার চালু হলেও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে হার্নিয়া, হাইড্রোসিল, লাইপোমা, ছোট টিউমার অপারেশন, অ্যাপেন্ডিসাইটিসহ বেশ কিছু রোগের অস্ত্রোপচার করা হয়। গত কয়েক মাসে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে ১২টি সিজার, ১০টি হার্নিয়াসহ অন্তত ৮০টি অস্ত্রোপচার হয়েছে বলে জানায় কর্তৃপক্ষ।

ফুলবাড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রবেশের মুহূর্তে সড়কে দেখা হয় জুবেদা খাতুন নামের এক নারীর সঙ্গে। ভ্যানগাড়িতে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। উপজেলাটির চৌদার উত্তরপাড়া এলাকার শরীফের স্ত্রী জুবেদা। অ্যাপেন্ডিসাইটের ব্যথা নিয়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে গেলে দ্রুত তাকে ময়মনসিংহে পাঠানো হয়। সেখানে মেডিকম নামে একটি প্রাইভেট হাসপাতালে গত ১ জুন ১২ হাজার টাকা চুক্তিতে অস্ত্রোপচার করা হয়। বুধবার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ড্রেসিং করতে আসেন জুবেদা। তিনি বলেন, হাসপাতালে যে অস্ত্রোপচার হয়, তা কেউ বলেনি। হাসপাতালে যেতেই ময়মনসিংহ পাঠানো হয়েছিল তাঁকে।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সার্জারি বিভাগে কাজ করেন এমন একজন চিকিৎসক সমকালকে বলেন, প্রচুর লোডশেডিং হচ্ছে। এমনও অবস্থা হয়েছে, মোবাইল ফোনের টর্চের আলোতে অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। পরে নিজেরা টর্চলাইটের ব্যবস্থা করেছেন। বিদ্যুৎ না থাকলে জেনারেটর ব্যবহার করা হয়। সেটিও অপ্রতুল। জেনারেটর দিয়ে অপারেশন থিয়েটারে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র (এসি) কাজ করে না। বিদ্যুতের কারণে জরুরি বিভাগে সেবা দিতে বেশি সমস্যা হচ্ছে। শ্বাসকষ্ট রোগী এলে বিদ্যুতের কারণে নেবুলাইজ করা যায় না। তিনি আরও বলেন, বিদ্যুতের কারণে অনেক সময় অস্ত্রোপচার করতে হবে এমন রোগীদের শিডিউল পেছাতে হচ্ছে। গত ৩ জুন তিনটি অস্ত্রোপচার করার শিডিউল থাকলেও দুটি অস্ত্রোপচার করা যায়। গত মঙ্গলবার একটি অস্ত্রোপচার করলেও গতকাল বুধবার কোনো অস্ত্রোপচার করা হয়নি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতির গুণগত মানও যথেষ্ট নয় বলে যোগ করেন তিনি।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জুনিয়র মেকানিক ফরহাদ হোসেন জেনারেটরটির কতটুকু সক্ষমতা, তাও বলতে পারেননি। তিনি বলেন, ঘণ্টায় দেড় লিটার জ্বালানির প্রয়োজন হয় জেনারেটর চালু রাখতে। বিশেষ প্রয়োজনে এটি চালু করা হয়। তিনি বলেন, অন্তত দেড় মাস বিদ্যুতের প্রচণ্ড রকমের লো-ভোল্টেজ চলছে। এতে এক্স-রে মেশিন পর্যন্ত চালু করা যায় না। গত মঙ্গলবার দুটি ও গতকাল বুধবার মাত্র একটি এক্স-রে করতে পেরেছেন বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক্স-রে টেকনিশিয়ান গোলাম কিবরিয়া। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ক্যাশিয়ার মো. আইয়ুব আলী বলেন, দেড় মাস ধরে লোডশেডিং ও লো-ভোল্টেজের সমস্যা চলছে। ভোল্টেজ কম থাকায় কম্পিউটার থেকে প্রিন্ট পর্যন্ত করা যায় না।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সার্জারি বিভাগে অস্ত্রোপচারের কাজ করেন মেডিকেল অফিসার ডা. মেছবাহুল ইসলাম। তিনি সমকালকে বলেন, রোগী না থাকায় বুধবার অস্ত্রোপচার করা হয়নি। বিদ্যুৎ বিভ্রাট আছে বেশ। জেনারেটর যে রকমভাবে দরকার, সে রকমভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। অপ্রতুলতার মধ্যেও অস্ত্রোপচার চালু রাখা হয়েছে।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. বিধান চন্দ্র দেবনাথ বলেন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মোটর চালু করলেও ২৫০ ভোল্ট বিদ্যুৎ দরকার। কিন্তু পাওয়া যায় ১৭০ ভোল্ট। এতে মোটর চালু করতে না পারলে রোগীদের পানির জন্য চরম কষ্ট করতে হয়। টিউবওয়েল থেকে খাবার পানির চাহিদা কিছুটা মেটানো হয়। মাঝেমধ্যে এক-দুই দিন পর্যন্ত মোটর চালু করা যায় না। জেনারেটর দিয়ে অপারেশন থিয়েটারটি চালু রাখা হয়েছে।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) স্থানীয় আবাসিক প্রকৌশলী প্রশান্ত কুমার ধর বলেন, উপজেলার ৩৯ হাজার গ্রাহকের জন্য ৫ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা। এখানে এক থেকে দুই ঘণ্টা লোডশেডিং থাকে। লো-ভোল্টেজের সমস্যা সম্পর্কে বলেন, একটি সাব-স্টেশন নির্মাণের কাজ চলমান। সেটির কাজ শেষ হলেও এমন অবস্থা থাকবে না।

তবে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির সামনের মুদি দোকানি আবদুল আজিজ বলেন, গত মঙ্গলবার রাতে অন্তত পাঁচবার বিদ্যুৎ গেছে। লো-ভোল্টেজের কারণে দোকানের ফ্রিজটি পর্যন্ত চালু করা যায় না। তীব্র গরমে ঠান্ডা জাতীয় পানীয় চাহিদা থাকলেও ফ্রিজ কাজ না করায় সেগুলো বিক্রি করছেন না।