ঢাকা রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫

শব্দই নির্ধারণ করছে কবিতার গন্তব্য

শব্দই নির্ধারণ করছে কবিতার গন্তব্য

তামাদি নাসিফ আমিন

মেহেদী হাসান

প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ০১:১৭ | আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ০৮:৪৪

মনের ভাব প্রকাশিতে
ভাষার উদয় এ জগতে,
মনাতীত-অধরে চিনতে
ভাষাবাক্য নাহি পাবে।
    –লালন ফকির

কবি নাসিফ আমিন জীবনের নানা পথ মাড়িয়ে এখনও আছেন অথিতু দশায়। কিন্তু জীবদ্দশার একটা পর্যায়, যে পর্যায়ে তিনি সামান্য কবিপরিচয় ধারণ করেছিলেন, তার সঙ্গে তিনি একটা দফারফা করতে চান। সে জায়গা থেকেই ‘তামাদি’ প্রকাশ। নামকরণের অর্থ খুঁড়তে গিয়ে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে রচিত এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো জনসম্মুখে তুলে ধরার কাল বহু আগেই গত হয়েছে; এমনকি নিজেরও অধিকারে নেই আর তারা। তারপরও খানিকটা অনধিকার চর্চা করেই এই প্রকাশ উদ্যোগ। উদ্দেশ্য: পুরোনো কবিতার সঙ্গে সম্পর্ক ঘোচানো, তাদের সঙ্গে একপ্রকার বিযুক্ততা তৈরি করা, জীবনকে আরেক ধাপ এগিয়ে বা পিছিয়ে নেওয়া, নতুন কিছুতে মশগুল হওয়া। 

ইতালির কবি গিয়োভান্নি পাসকোলি বলেছিলেন, ‘কবির ভাষা সবসময় মৃত ভাষা।’ কথাটার নানা রকম অর্থ হতে পারে। একটা অর্থ হতে পারে এই রকম: যে ভাষা মানুষের মুখে আর সচল নাই, তা নিয়েই কবির কাজ; তাকে নতুনভাবে প্রাণবান করে তোলাই কবির কাজ। আরেক ধরনের অর্থও হতে পারে: যেইসব মুহূর্ত আমাদের জীবনে মৃত হয়ে গেছে, কিন্তু আমাদের হৃদয় যারে অমরত্ব দান করেছে, তাদের নিয়েই কবির কাজ। পাসকোলির এই বক্তব্য মাথায় রেখে নাসিফ আমিনের দুয়েক কাব্যের কিয়দংশ পাঠ করা যাক। ‘শব্দ সর্বনাশী’ কবিতায় কবি লিখছেন: 

অনুচ্চারে মরে যায় শব্দ –
এমন এক লব্ধ ধারণার পাশে
দিনমান বসে থেকে
যদিও বলি না কিছু, হৃদয়ের নিবিড় শ্রোতাকে
তবু সে জানে, প্রাণে কেন শূন্যতার সমঝোতা
বরদাশত করে না নিস্তব্ধতাকে।

একই কবিতার শেষে তিনি লিখছেন:

মৃত শব্দের শিয়রে আমিও
লোবান জ্বালিয়ে উচ্চারণ করি ভুলে;
ব্যাকুল সেই শব্দ সর্বনাশী
আরও একবার আমিও উচ্চারণ করি – ‘ভালোবাসি’

একটা বহুল প্রচলিত শব্দকে কবি মৃত ঘোষণা করলেন এবং মৃত শব্দের শিয়রে দাঁড়িয়ে তারে করলেন পুনরোচ্চারণ। ভালোবাসার অভিজ্ঞতা, যারে আমরা সপ্রাণ ঘটনা আকারে সাব্যস্ত করি, যারে আমরা প্রাত্যহিক জীবনে প্রতিনিয়ত ঘটে যাচ্ছে বলে মনে করি, তারেই আদতে মৃত ঘোষণা করছেন কবি। এবং সেই মৃত শব্দকে উচ্চারণের মাধ্যমেই তাকে করছেন নবজীবন দান, রক্ষা করছেন গোরস্তানের নিখিল নিস্তব্ধতা থেকে।

অন্য এক কবিতায় তিনি লিখছেন:

আমরা দেখতে একদিন
মৃত্যুর মতো সুন্দর হব; সাবলীল হব।
সহজ চোখে নৈঃশব্দ্যকে দেখব,
সুশ্রাব্য কোনো হৃদয়ের ওপর
কান পেতে হয়ে যাব স্থির।

একই কবিতার শেষাংশ:

একদিন আমরা প্রাণের মতো প্রখর এক বদমাশকে
পদদলিত করে এগিয়ে যাব মৃত্যুর দিকে
একদিন আমরা দেখতে মৃত্যুর মতোই সুন্দর হব।

‘আরও দূরে যেতে হয়’ কবিতায় তিনি লিখছেন:

এখানে নয় 
সুনসান কোনো শূন্যতার সাথে
আহত বাতাসের বুক ভারী করে
কুহকের মতো – এ রকম পাশাপাশিও নয়
স্মৃতির ভেতর শুধু এক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে
আরও দূরে যেতে হয়, আরও দূরে যেতে হয়।

‘তামাদি’ কাব্যগ্রন্থের ফ্ল্যাপে লেখক ও গবেষক তাহমিদাল জামি লিখেছেন, ‘বুদ্ধিবাদ নয়, নাসিফের কবিতার ঝোঁক হৃদয়বাদের দিকে।’ সম্ভবত যে কোনো প্রকৃত ক্ষেত্রেই এই বক্তব্য খাঁটি। কবির সঙ্গে শব্দ বা ভাষার সম্পর্ক অভিধানপ্রণেতা বা ব্যাকরণবিদের মতো নয়। শব্দ একজন কবির হৃদয়ে যে ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে, তা সম্ভবত আর কোনো মানুষের হৃদয়ে করে না। নাসিফ আমিনের কবিতায় দেখা যায় অনেক সময় শব্দই তার কবিতার গন্তব্য নির্ধারণ করছে। এক শব্দ সৃষ্টি করে আরেক শব্দ।
দার্শনিক প্লেটোর সঙ্গে কবিতার যে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল, তা হয়েছিল মূলত সত্যের প্রশ্নে। প্লেটো মনে করতেন, কবিরা, সে কালের হিসেবে সব সাহিত্যসৃষ্টিকারী, মানুষের যাবতীয় আবেগ-অনুভূতিকে সাধারণীকরণের মাধ্যমে একপ্রকার রেটরিক পয়দা করেন, যেখানে আদতে সত্যের কোনো উপস্থিতি থাকে না। প্লেটো আরও মনে করতেন, কবিদের সত্যানুসন্ধানের ব্যাপারে আগ্রহ কম, তাদের আগ্রহ হলো মানুষের আবেগ-অনুভূতি নিয়ে খেলা করা। কবি বা কবিতার ব্যাপারে প্লেটোর এই ধারণার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে আস্ত একটা গ্রন্থই রচনা করে ফেললেন তাঁরই শিষ্য অ্যারিস্টটল, যা আমরা ‘পোয়েটিকস’ বা ‘কাব্যতত্ত্ব’ নামে পাই। অ্যারিস্টটল বললেন, কবিরা সত্যের অনুসন্ধান করে না– এইটা ভুল কথা; বরং সমগ্রের যে সত্য তারই যোগফল আকারে আমরা কবিতাকে পাই।

কবি নাসিফ আমিনের কবিতা প্লেটোর বক্তব্যের অনুগামী নাকি অ্যারিস্টটলের বক্তব্যের অনুগামী, সে বিচারের ভার পাঠকের, অর্থাৎ আরও আরও কবির। আপাতভাবে দেখা যায়, কবি ভাষা নিয়ে খেলতে পছন্দ করেন, শব্দের পিঠে শব্দকে উঠিয়ে একপ্রকার বিমূর্ততা সৃষ্টি করেন। দার্শনিকরা দেখিয়েছেন, শব্দ বা ভাষায় প্রবেশ মানেই একপ্রকার বিমূর্ততার দিকে যাত্রা, বস্তু বা মুহূর্তের সঙ্গে বিচ্ছেদ রচনা। সেই বিমূর্ততার আগুনে প্রতিনিয়ত ঘি ঢেলে যান কবিগণ, সৃষ্টি করেন আরও আরও বিমূর্ততা। প্রশ্ন হলো কেন এই বিমূর্ততার সৃষ্টি? কার সঙ্গে আসলে কথা বলেন তারা? কে তাদের শ্রোতা?

তামাদি ।। নাসিফ আমিন ।। কবিতা ।। প্রকাশক : বৈতরণী ।। প্রচ্ছদ : রিফাত আরা মিম ।। পৃষ্ঠা : ১৬০ ।। মূল্য : ৪২০ টাকা
মেহেদী হাসান, কবি ও গবেষক

আরও পড়ুন

×