জনপ্রিয় লেখকহীন মেলা

ফাইল ছবি
দ্রোহী তারা
প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ০১:২১ | আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ০৮:৪৫
আগে বইমেলায় পাঠকের কৌতূহল ও আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকতেন লেখকরা। জনপ্রিয় লেখকরা মেলায় আসতেন, লাইন ধরে তাদের অটোগ্রাফ নেওয়া ছিল অনেকটা ঈদের আনন্দের মতো। এর পাশাপাশি কয়েক বছর ধরে লেখকদের সঙ্গে ছবি তোলাও একটা বাড়তি যোগ ছিল। এবারের বইমেলায় এর ছিটেফোঁটাও নেই।
গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে প্রথম বইমেলা নিয়ে পাঠকদের মাঝে একটা বাড়তি আকর্ষণ কাজ করছিল। কিন্তু গতকাল মঙ্গলবার মেলার ২৫তম দিনে এসে প্রকাশক ও পাঠকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খ্যাতিমান অধিকাংশ লেখক এবার মেলায় আসেননি। তাদের আড্ডা নেই। এ কারণে সুনসান লিটলম্যাগ চত্বর। সব মিলিয়ে এবারের বইমেলা রংহীন হয়ে থাকল।
গতকাল মেলায় আসা পাঠক আব্দুর রহমান বলেন, ‘৮০-৯০ দশকের বইমেলার সেই জৌলুস নেই। পরিবার নিয়ে মেলায় আসা, তালিকা ধরে বই কেনা এবং অটোগ্রাফ-সংবলিত বইগুলো আলাদাভাবে এলাকার সবাইকে দেখানো একটা গর্বের ব্যাপার ছিল।’
স্মৃতিচারণ করে ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশের বিপণন ব্যবস্থাপক মো. আতাউর হোসেন সবুজ বলেন, ‘২১ ফেব্রুয়ারি প্রভাতফেরি শেষে দোকান খোলার আগে পাঠকরা জানিয়ে দিত, তাদের পছন্দনীয় বইয়ের নাম। বই বিক্রির কথা কী বলব, যদি কোনো লেখক চলে আসতেন, তাহলে তো বই বিক্রির ধুম পড়ে যেত। লেখকরা মেলার মাঠে ঘুরতেন, আড্ডা দিতেন, শুভ্যানুধ্যায়ীদের সঙ্গে কথা বলতেন। আলাদা একটা পরিবেশ ছিল তখন।’
তিনি জানান, সেলিনা হোসেন, হুমায়ূন আহমেদ (প্রয়াত), হুমায়ুন আজাদ (প্রয়াত), ইমদাদুল হক মিলন ও আনিসুল হকরা এলে মেলায় সাড়া পড়ে যেত। কিন্তু বর্তমানের বইমেলা নিয়ে তিনি আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘বর্তমানে দেশের সার্বিক পরিস্থিতির কারণে কেউ মেলায় আসতে চায় না।’
এবারের বইমেলা নিয়ে হতাশার যেন শেষ নেই প্রকাশকদের। একদিকে শাহবাগে প্রায় প্রতিদিন আন্দোলন হচ্ছে, অন্যদিকে মেলা লেখকশূন্য। তার ওপর গোদের ওপর বিষফোড়া বই কেনার বদলে ছবি তুলে চলে যাচ্ছে দর্শনার্থীরা। সব মিলিয়ে হতাশাময় বইমেলা পার করছেন প্রকাশকরা।
সময় প্রকাশনের বিক্রয় প্রতিনিধি রাতুল বলেন, ‘লেখক এলে স্টলে বই বিক্রি বাড়ে। মূলত লেখকদের দেখলে পাঠকরা, এমনকি দর্শনার্থীরাও বই কিনে নিয়ে যায়। মুহাম্মদ জাফর ইকবালের বই বিক্রি কম হলেও তার পাঠকরা এসে বই নিয়ে যাচ্ছে।’
অন্যপ্রকাশের তৌহিদ ইসলাম প্রান্ত বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে পাঠক ও দর্শনার্থীরা জানে তাদের পছন্দনীয় লেখকরা কোথায় ও কী অবস্থায় আছে। সুতরাং তারা সেটা মেনে নিয়েই স্টলে এসে বই কিনে নিচ্ছে।
মেলায় লেখক আসার অন্য একটি দিক তুলে ধরেন তাম্রলিপির বিক্রয়কর্মী নাফিউর। তিনি বলেন, ‘লেখকরা স্টলে এলে তো এখনকার পাঠকরা বেশির ভাগ চায় শুধু ছবি তুলতে, ভিডিও করতে, অটোগ্রাফ নিতে। আবার ছবি সুন্দর না হলে সময় নিয়ে আবারও ছবি তোলার অপেক্ষা করে। সে ক্ষেত্রে দেখা যায় মূল পাঠক, যারা লেখকের সঙ্গে দেখা করে বই ক্রয় করতে এসেছে, তারা পিছিয়ে পড়ে। তবে লেখকরা সব সময় চান, পাঠক হোক দর্শনার্থী হোক, সবাই যেন বই কেনে।’
অমর একুশে বইমেলা ২০২৫-এর লেখক শূন্যতা বিষয়ে আহমাদ মোস্তফা কামাল বলেন, ‘স্টলে বসা নির্দিষ্টসংখ্যক লেখকের চোখে পড়ছে না এবার মেলায়। নিরাপত্তাজনিত কারণ এর মধ্যে অন্যতম।’ এ ছাড়া অনেক কবি-লেখক আসছেন। কিন্তু তারা নির্দিষ্ট স্টলে বসেন না। মেলাজুড়ে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন স্টলে যান।
গতকাল জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ নার্সিং কলেজের ১০০ শিক্ষার্থী নিয়ে মেলায় আসেন শিক্ষকরা। শিক্ষিকা সামিয়া জামান রীতি বলেন, ‘অনলাইনের যুগে তরুণরা কাগজের বই থেকে সরে এসেছে। কিছুটা হলেও সেই জায়গাটা জাগ্রত করতে শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসা। একটা আন্তরিক সম্পর্কের সূত্র ওদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাই।’
গতকাল মেলায় নতুন বই আসে ১০১টি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ইমতিয়ার শামীমের শঙ্খগহন সলপকাল (কথাপ্রকাশ), আয়েশা আখতার ডালিয়ার সাঁওতাল জনজাতি বিদ্রোহ ও বেদনা (কবিতার রাজপথ), মোজাম্মেল হকের পথে প্রান্তরে (ধ্রুবতারা) এবং মন্টু চৌধুরীর স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার ২০২৪ (বাবুই)।
বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘গণঅভ্যুত্থান, গ্রাফিতি এবং অপরাপর ভিস্যুয়াল কালচার’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মুনেম ওয়াসিফ। আলোচনায় অংশ নেন তাসলিমা আখতার এবং কামার আহমাদ সাইমন। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। লেখক বলছি মঞ্চে আলোচনা করেন শওকত হোসেন এবং শামীমা চৌধুরী। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করেন মতিন বৈরাগী, শহীদুল্লাহ ফরায়জী, সুহিতা সুলতানা ও শওকত হোসেন প্রমুখ।
সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী রোজী আক্তার শেফালী, অন্তর সরকার, মনীন্দ্র দাস, ফকির আবুল হাশেম প্রমুখ।
গুণীজন স্মৃতি পুরস্কার ২০২৫
গত বছর বিষয় ও গুণমানসম্মত সর্বাধিক বই প্রকাশের জন্য কথাপ্রকাশকে চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার ২০২৫ মনোনীত করা হয়েছে। গুণমান ও শৈল্পিক বিচারে সেরা বইয়ের জন্য পাঠক সমাবেশ (প্লেটো : জীবন ও দর্শন-আমিনুল ইসলাম ভুইয়া), ঐতিহ্য (ভাষাশহিদ আবুল বরকত: নেপথ্য কথা- বদরুদ্দোজা হারুন) এবং কথাপ্রকাশকে (গোরস্তানের পদ্য: স্মৃতি ও জীবনস্বপ্ন- সিরাজ সালেকীন) মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০২৫ মনোনীত করা হয়। গুণমান বিচারে সর্বাধিক সংখ্যক শিশুতোষ বই প্রকাশের জন্য কাকাতুয়াকে রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার ২০২৫ মনোনীত করা হয়েছে। নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে মাকতাবাতুল ইসলাম (১ ইউনিট); গ্রন্থিক প্রকাশন (২-৪ ইউনিট) ও বাতিঘরকে (প্যাভেলিয়ন) কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০২৫ মনোনীত করা হয়।
- বিষয় :
- বইমেলা