ঢাকা মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

অমর একুশে গ্রন্থমেলা

সৃজনশীল প্রকাশনায় নারীরা

সৃজনশীল প্রকাশনায় নারীরা

লতিফুল ইসলাম

প্রকাশ: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১৩:৪৮

প্রকাশনার মতো সৃজনশীল শিল্পে এখন বিচরণ করছেন দেশের অনেক নারী উদ্যোক্তা। নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে তারা এগিয়ে চলেছেন লক্ষ্যের দিকে। তাদের কেউ কেউ প্রকাশনা সংস্থার হাল ধরেছেন পারিবারিক সূত্রে। দক্ষতার সঙ্গে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। আবার কেউ কেউ রয়েছেন একেবারেই নতুন; অনেক স্বপ্ন নিয়ে এসেছেন এ ব্যবসায়। নানা সমস্যার মুখোমুখি হলেও গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যেতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তারা। এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় তাদের বেশ কয়েকজনের স্টল খুঁজে পেয়েছে সমকাল।
এ রকমই একজন সুবর্ণ প্রকাশনীর প্রকাশক শাহরিন হক। এক সময় তিনি চাকরি করতেন একটি কোম্পানিতে। কিন্তু বাবা আহমেদ মাহফুজুল হকের মৃত্যুর পর হাল ধরেন প্রকাশনীর। অবশ্য ছোটবেলা থেকেই প্রকাশনা-সংক্রান্ত কাজের সঙ্গে পরিচয় ছিল তার। কারণ বাসার নিচেই ছিল প্রেস ও বাইন্ডিং কারখানা। বইয়ের প্রুফও দেখতেন তিনি। ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত সুবর্ণ এ পর্যন্ত পাঁচশর মতো বই প্রকাশ করেছে।


শাহরিন হক জানান, তার দাদা ছিলেন মাওলা ব্রাদার্সের প্রকাশক। সেই সূত্রে অন্যান্য প্রকাশক ও লেখকের কাছ থেকেও তিনি সহযোগিতা পেয়েছেন। তিনি বলেন, 'লেখক ও প্রকাশকদের কোনো জেন্ডার হয় না। বাবার মৃত্যুর পর এ প্রকাশনী ঘিরে ডিজিটাল কার্যক্রম শুরু করেছি। যার মধ্যে দিয়ে সুবর্ণর উত্তরণ ঘটেছে। ফেসবুক ও বিভিন্ন ওয়েবসাইটেও আমাদের প্রকাশনীর বইয়ের তালিকা রয়েছে। বই বিক্রি হচ্ছে অনলাইনেও।
যুক্ত :প্রকাশক নিশাত জাহান রানা পরিচালনা করেন যুক্ত প্রকাশনী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পাট চুকিয়ে 'আগামী' পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে যাত্রা শুরু করেন তিনি। ২০০০ সাল থেকে শুরু করেন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান 'যুক্ত'র কাজ। এখান থেকে এ পর্যন্ত তিন শতাধিক বই প্রকাশ হয়েছে।
নিশাত জাহান রানা সমকালকে বলেন, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রকাশনা শিল্প পেশাদারি শিল্প হয়ে ওঠেনি। তাই নারী হিসেবে কাজ করা এখানে আরও কঠিন। এখানে প্রকাশনা শিল্প যে বিকশিত হচ্ছে না, এর একটি কারণ হলো শিক্ষাব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা। আমরা স্কুলে পাঠ্যবইয়ের বাইরে পড়তে শিখাই না। এ জন্য পাঠক তৈরি হচ্ছে না। ফলে লেখক এবং মানসম্মত বইও মিলছে না।

যুক্ত থেকে এবারের মেলায় এসেছে কবি শঙ্খ ঘোষের 'নির্বাচিত বক্তৃতামালা', সনৎকুমার সাহার 'চেনা-শোনা', নিশাত জাহান রানা সম্পাদিত স্মারকগ্রন্থ 'স্মৃতি ও সত্তায় আলী আনোয়ার', এস এম আব্রাহাম লিংকনের 'ভাওয়াইয়ার স্বরে বঙ্গবন্ধু' ইত্যাদি গ্রন্থ।
জলধি :শিক্ষকতা থেকে প্রকাশনার জগতে এসে লেখক নাহিদ আশরাফী গড়ে তুলেছেন 'জলধি' নামের প্রতিষ্ঠান। গত বছর থেকে 'জলধি' বইমেলায় অংশ নিচ্ছে। তিনি বলেন, সাহিত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শাখা সম্পাদনা। স্কুল-কলেজজীবন থেকেই তিনি সম্পাদনায় যুক্ত। এভাবে প্রকাশনা জগতের সংস্পর্শে আসেন তিনি। নতুন লেখকদের উদ্দীপ্ত করতে চান বলে জানালেন তিনি। ছোট কাগজ 'জলধি' সম্পাদনাও করেন তিনি। এ বছর 'জলধি' থেকে এসেছে কথাসাহিত্যিক পাপড়ি রহমানের 'করুণ ক্যাসিনো', কবি জাকির জাফরানের 'জ্যোৎস্না সম্‌ভ্রম দায়', মুম রহমানের 'দুর্গা ও দশজনা', জয়দীপ দে'র 'একাত্তরের কার্টুন' ইত্যাদি গ্রন্থ।
পেন্ডুলাম :নারী প্রকাশক হিসেবে পেন্ডুলাম প্রকাশনীর প্রকাশক রুম্মান তার্শফিকের শুরুটা সুখকর ছিল না। তিনি জানান, লেখকরা সহযোগিতা করলেও প্রথমদিকে প্রেসের প্রিন্টিং, বইয়ের প্রচ্ছদ এবং বাইন্ডিংয়ে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। প্রকাশনার শুরুতে বাংলাবাজারের প্রেস ব্যবহার করতেন। সমস্যার কারণে এখন কাঁটাবন থেকে বই ছাপানোর কাজ করছেন। এ প্রকাশক বলেন, সমস্যা ঠেলেই তিনি এগিয়ে চলছেন; হাল ছাড়েননি।


এ পর্যন্ত পেন্ডুলাম থেকে ৪৪টি বই প্রকাশিত হয়েছে। এ বছর আসা নতুন বইয়ের মধ্যে রয়েছে- রিফাত আনজুম পিয়ার 'তখন গল্পের তরে', হাসান মাহবুবের 'এসিড বৃক্ষের গান', মেহেদি হাসান অনূদিত ওরহান পামুকের 'লাল কেশবতী' ইত্যাদি।
প্রত্যয় :এস এ বি শাহানারা পারভীন প্রত্যয় প্রকাশনীর প্রকাশক। ২০০৬ সাল থেকে এ প্রকাশনী যাত্রা শুরু করেছে। তবে বইমেলায় তারা প্রথম অংশ নেন ২০১৯ সাল থেকে। শাহান আরা জাকির নামে লেখালেখি করেন তিনি। তার স্বামী জাকির হাসান চন্দনও লেখালেখি করেন। তিনি বলেন, প্রতি বছরই তাদের কয়েকটি বই প্রকাশ পায়। বিভিন্ন প্রকাশনীর কাছে পাণ্ডুলিপি নিয়ে দৌড়াদৌড়ির ঝামেলা এড়াতে তারা নিজেরাই প্রকাশনীর ব্যবসা শুরু করেন। অন্যদের কাছ থেকে সহযোগিতাও পেয়েছেন এতে।
অধ্যয়ন প্রকাশনী :তাসনুভা আদিবা এ প্রকাশনীর প্রকাশক। তার স্বামী তাম্রলিপি প্রকাশনীর প্রকাশক একেএম তারিকুল ইসলাম রনি। ২০০৯ সালে স্বামীর প্রকাশনীতে কাজ শুরু করেন তিনি। পরে নিজেই এ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বলেন, তরুণ লেখক ও পাঠকদের অনুপ্রেরণা দিতেই অধ্যয়নের যাত্রা শুরু। এ পর্যন্ত এ প্রকাশনী থেকে চার শতাধিক বই প্রকাশ পেয়েছে।


ঝুমঝুমি :লেখালেখির জগৎ থেকে প্রকাশনা জগতে এসেছেন ঝুমঝুমি প্রকাশনীর প্রকাশক শায়লা রহমান তিথি। ২০১৫ সালে 'ঝুমঝুমি' পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে তার প্রকাশনা জগতের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। এর পর ২০১৭ সাল থেকে বড় পরিসরে প্রকাশনার কাজ শুরু করেন এবং অমর একুশে গ্রন্থমেলায়ও অংশ নেন। তার প্রকাশনী থেকে এ পর্যন্ত ৪৪টি বই এসেছে।


শায়লা রহমান তিথি বলেন, মাসিক পত্রিকায় কাজ করার সময় থেকে লেখকদের সঙ্গে পরিচয় ঘটে তার। তাদের সহযোগিতায় বড় পরিসরে কাজে আসা। 'ঝুমঝুমি' তরুণ লেখকদের উৎসাহিত করে থাকে।
অভ্র প্রকাশ :২০১৩ সালে যাত্রা করে অভ্র প্রকাশ। এর প্রকাশক সমা খান জানালেন, এ পর্যন্ত তার প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে ২১২টি বই। তিনি বলেন, স্কুলজীবন থেকেই লেখালেখি শুরু করেছিলাম। তবে পারিবারিক বাধার কারণে প্রকাশ করতে পারিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর পরিবারের রক্ষণশীলতাকে অগ্রাহ্য করে এ জগতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছি। প্রকাশক হিসেবেই নিজেকে পরিচিত করতে চাই। এখনও প্রকাশনা ব্যবসায় লাভজনক অবস্থায় যেতে না পারলেও আমার লক্ষ্য 'অভ্র'কে একটি বড় জায়গায় নিয়ে যাওয়া।


এ ছাড়া বইমেলায় একাধিক প্রকাশনী রয়েছে যেগুলো পরিচালনা করছেন নারীরা। পিতা মহিউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুর পর গত বছর এ প্রকাশনীর হাল ধরেছেন তার মেয়ে মাহরুখ মহিউদ্দিন। তবে আগে থেকেই প্রকাশনা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। মেলায় রয়েছে জাগৃতি প্রকাশনী। জঙ্গিবাদীদের হাতে প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন নিহত হওয়ার পর এ প্রকাশনীর হাল ধরেছেন রাজিয়া রহমান জলি। রয়েছে প্রকাশক পাপিয়া জেরিনের 'বৈভব'সহ বিভিন্ন প্রকাশনীর স্টল।

আরও পড়ুন

×