- বাজেট
- টাকা খরচে কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে
বাজেট বিশ্লেষণ : ব্যবসায়ীদের দৃষ্টিতে
টাকা খরচে কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, যা সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ বেশি। করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কতটুকু সম্ভব হবে তা সময়ই বলে দিতে পারবে। তবে এই বিশাল বাজেটের সংস্থান করতে হলে করের আওতা বাড়ানো এবং কর প্রদান প্রক্রিয়া সহজ করার কোনো বিকল্প নেই। ভ্যাট থেকে সরকারের আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ভ্যাট প্রদান, রিটার্ন পদ্ধতি ও রিফান্ড সম্পূর্ণ অনলাইন করা ও সহজতর করা প্রয়োজন। প্রস্তাবিত বাজেটে অনলাইনে আয়কর প্রদানের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা রাখা হয়েছে, যা একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
জিডিপির ৬ শতাংশের সমপরিমাণ ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কিছুটা শ্নথ করে তুলতে পারে। দুর্যোগকালে আর্থিক খাতকে শক্তিশালী রাখতে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সমন্বয়ে একটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন আর্থিক খাত পরামর্শক কমিটি গঠন করা যেতে পারে। বিকল্প অর্থ সংস্থানের জন্য পুঁজিবাজার, বন্ড মার্কেট ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে সহজ শর্তে অল্প সুদে ঋণ নেওয়ার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হবে। রপ্তানিমুখী শিল্প এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের উদ্যোক্তাদের বর্তমানে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে চলতি মূলধনের অভাব। সংকট মোকাবিলায় সরকার ইতোমধ্যে বিভিন্ন খাতের জন্য ১ লাখ কোটি টাকার ওপর প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। তবে প্রণোদনার সুফল নিশ্চিত করতে ঋণ প্রদান প্রক্রিয়াকে সহজতর করা প্রয়োজন। পাশাপাশি ঋণপ্রাপ্তি সহজতর করতে ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম চালু করা যায় এবং প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণপ্রবাহ বাড়ানো প্রয়োজন। এ ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে ব্যবহার করে যদি একটি বিশেষ তহবিল গঠন করে স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে রপ্তানিমুখী শিল্প ও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প চলতি মূলধনের খরা কাটিয়ে উঠতে পারবে। একই সঙ্গে ব্যাংকিং খাতের ওপরও চাপ কমে আসবে।
সরকার স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা, শিক্ষা ও কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়িয়েছে, যা প্রশংসনীয়। করোনার দুর্যোগ মোকাবিলায় অন্যান্য খাতের সঙ্গে এসব খাতে বরাদ্দের টাকা যেন স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও যথাযথ কর্মপরিকল্পনার সঙ্গে ব্যয় করতে পারে তার ওপর কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে সমন্বিত, সহজ ও কার্যকরী গণস্বাস্থ্যবান্ধব স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করাও প্রয়োজন।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয়- এমন কোম্পানির করপোরেট করের হার ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩২ দশমিক ৫ শতাংশে নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে করোনা প্রাদুর্ভাব পরবর্তী সময়ে স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে করপোরেট করের হার আরও কিছুটা যৌক্তিক হারে কমানো উচিত। রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্প, চামড়া, পাট ও পাটজাত দ্রব্য, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য ও ওষুধ শিল্পে ব্যবহূত কাঁচামাল আমদানিতে অগ্রিম আয়কর অব্যাহতি ও অগ্রিম কর প্রত্যাহার করলে রপ্তানিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
বিনিয়োগ আকর্ষণ অথবা বিনিয়োগ বৃদ্ধি এ মুহূর্তে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বৃহত্তর অর্থনীতির স্বার্থ বিবেচনায় অপ্রদর্শিত অর্থ ১০ শতাংশ কর দিয়ে আবাসন, ব্যাংক আমানত, সঞ্চয়পত্র ও পুঁজিবাজারে সহজ শর্তে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়ায় হয়তো অর্থনীতির মূল ধারায় কিছুটা বিনিয়োগ যোগ হতে পারে, যদিও নৈতিকভাবে অনেকের কাছেই এটা সমর্থনযোগ্য নয়। তবে এ ক্ষেত্রে সৎ ব্যবসায়ীরা যারা নিয়মিত কর, ভ্যাট ও শুল্ক্ক দেন তারা যেন কোনোভাবে বৈষম্যের স্বীকার না হন সেদিকটাও নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া অপ্রদর্শিত অর্থ আগামী অর্থবছরের প্রথম তিন মাস পর্যন্ত বিনিয়োগের সুযোগ রাখা যেতে পারে। কেননা সারা বছর এ সুবিধা দেওয়া হলে সাধারণ বিনিয়োগকারী ও অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগকারীদের মাঝে এক ধরনের আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের সৃষ্টি হতে পারে। উপরন্তু অর্থনীতিতেও অপ্রদর্শিত অর্থ বৃদ্ধির শঙ্কা থেকে যায়।
খাদ্য নিরাপত্তা, শিল্পের কাঁচামাল, ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্প ও গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে কৃষি খাতের বিকল্প নেই। প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষি খাতে ১৬ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা বরাদ্দসহ ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ভর্তুকির সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক বলে মনে করছি। তবে প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষকের উন্নয়নে ভর্তুকির স্বচ্ছ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
এ মুহূর্তে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির চেয়ে বিদ্যমান কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বেসরকারি খাতই কর্মসংস্থানের বৃহত্তর উৎস। তাই যে কোনো মূল্যে শিল্প, কল-কারখানাকে করোনার নেতিবাচক প্রভাব থেকে রক্ষা করতে হবে। রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ, বাজার বহুমুখীকরণ, নতুন নতুন রপ্তানি পণ্যের উদ্ভাবন, ওষুধ শিল্পে ইনোভেশন, কৃষি খাতের আধুনিকায়নে গবেষণার বিকল্প নেই। বিশ্বের উন্নত দেশে উন্নত গবেষণা কার্যক্রমের জন্য অর্থনীতিতে তারা সুফল পাচ্ছে। করোনা-পরবর্তী সময়ে পরিবর্তিত বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে দেশীয় অর্থনৈতিক শিল্প ও ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে কীভাবে সমন্বয় করা যায় তার জন্য প্রয়োজনীয় খাতভিত্তিক গবেষণা জরুরি, যা আমাদের দ্রুত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সহায়তা করবে। এ লক্ষ্যে ব্যবসার ক্ষেত্রে গবেষণাকে উৎসাহিত করতে কোম্পানির আয়ের ৫ শতাংশ পর্যন্ত গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে বিনিয়োগ করা হলে এ ধরনের বিনিয়োগকে কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া যেতে পারে।
এবারের বাজেট নিঃসন্দেহে বাংলাদেশে এ যাবৎকালের সর্ববৃহৎ ও ভিন্ন প্রেক্ষাপটে প্রণীত একটি বাজেট। পাশাপাশি অনেক প্রত্যাশা, জীবন-জীবিকার মধ্যে সমন্বয় ও করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে একটি সমন্বিত প্রয়াস। প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাও বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষার। তবে এ ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রাজস্ব আদায় করতে পারা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। যদি উচ্চ লক্ষ্যমাত্রার রাজস্ব আদায় করা সম্ভব না হয় তবে প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধির হার ও বাজেট বাস্তবায়ন উভয়ই ব্যাহত হতে পারে। তবে প্রবৃদ্ধির বিষয়ে আপাতদৃষ্টিতে বেশি চিন্তা না করে কীভাবে অর্থনীতিকে তার পূর্বের স্থিতিশীল রূপে ফেরানো যায় তার ওপর বেশি মনোযোগী হতে হবে। পাশাপাশি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য চাই সঠিক কর্মপরিকল্পনা, কর্মকৌশল, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সরকারের সব বিভাগের মধ্যে কার্যকর সমন্বয়, প্রয়োজনীয় রাজস্ব ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় নীতির সমন্বয় সাধন, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব, দক্ষ ব্যবস্থাপনা, সরকারি ব্যয়ের যৌক্তিকীকরণ, জনস্বাস্থ্য এবং সার্বিকভাবে ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা।
লেখক : সভাপতি, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি
বিষয় : বাজেট বিশ্লেষণ
মন্তব্য করুন