- ক্যাম্পাস
- ঢাকার বায়ুদূষণ: কারণ ও প্রতিকার
ঢাকার বায়ুদূষণ: কারণ ও প্রতিকার

বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, শব্দদূষণ মিলিয়ে রাজধানী ঢাকা শহরের প্রাণ এখন ওষ্ঠাগত। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঢাকার অবস্থান পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর তালিকার ওপরের দিকে। তবে এর মধ্যেও বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে ঢাকা অন্য সব কিছুকে ছাড়িয়ে গেছে। মোগল আমলের ঢাকা শহর ছিল বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে। নামে বুড়ি হলেও এটি তখন প্রমত্তা নদী। নির্মল নীল জলের প্রবাহ ছিল মনোহরণ। পূর্ববাংলার অন্যতম প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্রও ছিল। ঢাকার মসলিন ছিল জগদ্বিখ্যাত।
মোগল বাংলার রাজধানী, ৪০০ বছরের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী ঢাকা এখন মেগাসিটি। ৮৩৪ বর্গমাইল মেট্রোপলিটন এরিয়ায় প্রায় দুই কোটি মানুষের বাস। প্রতি বর্গমাইলে জনঘনত্ব ১ লাখ ২০ হাজারেরও বেশি।
মোগল শাসনের শেষদিকে বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদে সরিয়ে নেন নবাব মুর্শিদকুলি খান। এটা ১৭০০ সালের কথা। এরপর ব্রিটিশ আমলে ১৯০৫ সালে বাংলা দু'ভাগ করে পূর্ব বাংলা ও আসাম মিলে নতুন প্রদেশ গঠন করে নতুন এই প্রদেশের রাজধানী করা হয় ঢাকাকে। কিন্তু হিন্দু জমিদারদের প্রবল আপত্তির মুখে ১৯১১ সালে তা রদ করলে রাজধানী হিসেবে ঢাকার স্থায়িত্বকাল হয় মাত্র ছ'বছর। ভারত বিভক্তির মাধ্যমে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে ১৯৪৭ সালে ঢাকা আবার পূর্ব বাংলার রাজধানী হয়। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর রাতারাতি একটি প্রাদেশিক রাজধানী থেকে তা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের রাজধানীতে উন্নীত হয়।
ব্রিটিশ যুগে বঙ্গভঙ্গের ফলে সৃষ্ট নতুন রাজধানী শহর ঢাকাকে গড়ে তোলা হয় মোগল ও ব্রিটিশ স্থাপত্যকলার মিশ্রণে। মোগলদের মতো মনোরম ছায়াঢাকা শহর হিসেবে গড়ে তুলতে ব্রিটিশ সরকার প্রাউড লককে নিয়োগ করেন। তারই তত্ত্বাবধানে নির্বাচিত বৃক্ষশোভিত রমনা পার্কসহ আধুনিক ঢাকার যাত্রা শুরু।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব বাংলার রাজধানী হিসেবে ঢাকাকে গড়ে তুলতে ষাটের দশকে একটি মহাপরিকল্পনা গৃহীত হয়। মূলত বর্তমান ঢাকা শহর তারই বর্ধিত রূপ। শেরেবাংলা নগর নাম দিয়ে প্রখ্যাত স্থপতি লুই কানের পরিকল্পনায় গড়ে তোলা শুরু হয় পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানী শহর ঢাকা।
ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমল থেকে শহর ঢাকা আধুনিক সুযোগ-সুবিধার আওতায় আসতে শুরু করে। স্বাধীনতার পরও সে ধারা অব্যাহত থাকে। ১৯৪৭ সাল থেকে ঢাকায় জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। কিন্তু ১৯৭২ থেকে এই শহরে জনসংখ্যা এক লাফে আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। ১৯৫১ সালে যে শহরের লোকসংখ্যা ছিল মাত্র ৩ লাখ ৩৬ হাজার, এক লাফে ১৯৭৪ সালে তা বেড়ে হয় ১৬ লাখ ৮০ হাজার। বর্তমানে এই শহরের জনসংখ্যা দুই কোটি ছাড়িয়ে গেছে।
গত শতকের ষাটের দশক থেকেই এই শহরে জনসংখ্যার চাপ অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেতে থাকে। তবু তৎকালীন পরিকল্পনার সুবিধায় ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত বসবাসের জন্য বেশ আকর্ষণীয় একটি শহর ছিল ঢাকা। কিন্তু বর্তমানে এটি নানা সমস্যায় জর্জরিত। স্বাধীনতার পর ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষামূলক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেগুলোর কিছু ফলপ্রসূ হলেও অধিকাংশই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। গত অর্ধ শতকে একটি শতবার্ষিকী নগর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের বিপরীতে অতিকেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু, নগর পরিকল্পনাহীনতা এই শহরে জনসংখ্যার প্রবল চাপ সৃষ্টির প্রধান কারণ। ১৯৮০ দশকের শেষ দিকে ঢাকায় বিপুলসংখ্যক গার্মেন্ট কারখানা গড়ে তুলে এই শহরকে বিপুল মানুষের চাপে পিষ্ট করার সদর রাস্তা খুলে দেয় সরকার। ফলে ভয়ানকভাবে বেড়ে যায় জনসংখ্যার চাপ, সৃষ্টি হয় নিয়ন্ত্রণহীন পরিবেশদূষণ।
বিগত কয়েক বছর ঢাকা শহরের বাতাসের মান অত্যন্ত খারাপ। বিভিন্ন সূচকে তা খুবই অস্বাস্থ্যকর হিসেবে চিহ্নিত। গত ডিসেম্বরে ঢাকা ছিল পৃথিবীর দূষিত বাতাসের শহর তালিকায় শীর্ষ পাঁচের মধ্যে। কোনো কোনো দিন তা ছিল সবার শীর্ষে। জনস্বাস্থ্যের জন্য সেটি চরম হুমকির সৃষ্টি করে। আর এ বছরের জানুয়ারি-মার্চে বেশ কয়েকবার বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বাতাসের শহরে পরিণত হয় ঢাকা।
ঢাকা শহরের ভয়াবহ দূষণের প্রধান উৎস ধোঁয়া, ধুলা ও বর্জ্য। ঢাকার নিকটবর্তী ইটভাটা, তেল পোড়ানো বিপুল সংখ্যক যানবাহন, বিভিন্ন শিল্পকারখানা ও রান্নার ধোঁয়ায় ঢাকার বাতাস দূষিত হয়।
ধুলার প্রধান উৎস বিভিন্ন ভবন নির্মাণ, সড়ক উন্নয়নের জন্য রাখা উন্মুক্ত বালু ও অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী। ঢাকার রাস্তাঘাটে সারা বছর খোঁড়াখুঁড়ি লেগেই থাকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঢাকার বাতাসে ধুলার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ মেট্রোরেল, ফ্লাইওভারসহ বিভিন্ন মেগা উন্নয়ন প্রকল্পের উন্মুক্ত নির্মাণ সামগ্রী।
আধুনিক বিশ্বে সাধারণত কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা একটি নির্দিষ্ট ও স্বল্প এরিয়ায় ভাগ করে বাস্তবায়ন করা হয়। কিন্তু ঢাকা তথা সমগ্র বাংলাদেশে এ চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। এখানে একই সময়ে বিস্তৃত এলাকাজুড়ে নির্মাণ কাজ চলে। ফলে একদিকে জনদুর্ভোগ বাড়ে, অন্যদিকে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়।
ঢাকার চারপাশের ইটভাটাগুলো দূষণের প্রধান উৎস বলে গণ্য করা হয়। উন্নত ও আধুনিক বিশ্বের মতো ইটের বিকল্প দ্রব্যের ব্যবহার বাতাসে ধোঁয়ার পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারে।
বায়ুদূষণের আরেকটি বড় কারণ যানবাহনের কালো ধোঁয়া। জনবহুল এই শহরে কোনো চক্রাকার ট্রেন সার্ভিস নেই। যদিও দেশের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে সীমিত রেল যোগাযোগ আছে। ঢাকায় এখনও মেট্রোরেল সার্ভিস চালু হয়নি। ফলে মানুষের চলাচলের প্রধানতম বাহন হলো বাস ও ব্যক্তিগত গাড়ি। তবে ঢাকার জনপরিবহন হিসেবে বাসের অপ্রতুলতা ও অনুন্নত মান, সুযোগ-সুবিধার অভাব এবং বিশৃঙ্খলার ফলে ধনীক শ্রেণির মানুষ ব্যক্তিগত গাড়িকেই প্রাধান্য দেয়। ফলে ঢাকায় বিপুল পরিমাণ ব্যক্তিগত গাড়ি চলে। কর্তৃপক্ষের যথাযথ নজরদারির অভাবে পুরোনো ও মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়িই বেশি চলাচল করে। সেগুলো থেকে উৎপন্ন ধোঁয়া দূষিত করে ঢাকা শহরকে।
আমরা জানি, ঢাকায় পর্যাপ্ত গাছপালা ও জলাধার নেই। একটি শহরের অন্তত ২০ ভাগ বৃক্ষাচ্ছাদিত থাকা প্রয়োজন। কিন্তু ঢাকায় তা মাত্র ৩/৪ ভাগ। ফলে বিপুল পরিমাণ নির্গত কার্বন গ্যাস অক্সিজেনে পরিণত হতে পারে না। আবার পর্যাপ্ত গাছপালা না থাকায় ঢাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণও কম। ফলে সারা বছরই এসব ধূলিকণা এক স্থান থেকে আরেক স্থানে উড়ে বেড়ায়। বিশেষত শুল্ক মৌসুম শীতে ঢাকার বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। পর্যাপ্ত জলাধারের অভাবে বালু, অতিসূক্ষ্ণ বস্তুকণা পানিতে থিতু হতে পারে না।
ঢাকার বায়ুদূষণের আরেকটি প্রধান কারণ অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। বর্জ্যের প্রধান উৎস তিনটি; শিল্প, গার্হস্থ্য ও হাসপাতাল। প্রতিদিন সৃষ্টি হওয়া বিপুল পরিমাণ বর্জ্য সেদিনই সরিয়ে না ফেলে তা একটি মধ্যবর্তী স্থানে স্তূপ করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে! আরও ৩/৪ দিন পর তা চূড়ান্তভাবে শহরের বাইরে নেওয়া হয়। আমাদের দেশে বর্জ্য রিসাইক্লিংয়ের ব্যবস্থা নেই। ফলে বিভিন্ন বর্জ্য পচে এক উৎকট দুর্গন্ধ ছড়ায়, জীবাণু জন্ম নেয় ও ছড়ায় এবং মানুষ ও পশুপাখি নানা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়।
বিশ্বের অন্যান্য উন্নত শহরের মতো ঢাকা শহরের রাস্তাগুলোকে প্রতি রাতে/সকালে ধুয়ে দেওয়া হয় না। ফলে অনবরত রাস্তায় এসব ধূলিকণা উড়ে বেড়ায় এবং বাতাস দূষিত করে।
ব্যক্তিগতভাবে আমার চীনের বেইজিং, সাংহাই, চ্যাংশা, সুইডেনের স্টকহোম ঘোরার সৌভাগ্য হয়েছে। প্রতিটি শহরই সূর্যোদয়ের আগে রাস্তা ধুয়ে পরিস্কার করে ফেলা হয়। আমি বেশ কিছু সময় বসবাস করেছি সুইডেনের ছোট্ট শহর কার্লস্ট্যাডে। বর্তমানে পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে। প্রতিটি শহরের পৌর কর্তৃপক্ষ প্রতি দিনের বর্জ্য রাতের মধ্যেই সরিয়ে ফেলে। ডাস্টবিনগুলো জীবাণুমুক্ত করে পরবর্তী দিন নতুন করে বর্জ্য ফেলার জন্য প্রস্তুত করে তোলে।
আমাদের উচিত এখনই রাষ্ট্রীয়ভাবে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে সচেতনতা অবলম্বন করা। যানবাহন সংশ্নিষ্ট দূষণ কমাতে ট্রাম চালু, ইলেকট্রিক গাড়ির রেজিস্ট্রেশনের অনুমোদন প্রদান ও গাড়ির ওপর স্বল্প ট্যাক্স আরোপের মাধ্যমে সেগুলো ব্যবহারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা সময়ের দাবি। ইউরোপের উন্নত শহরগুলোতে ট্রাম খুবই জনপ্রিয় যানবাহন।
সিটি করপোরেশন যদি যথাসময়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারে ও রাত পোহাবার আগেই রাস্তা ধুয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে তাহলে ঢাকার বায়ুদূষণ কমানো সম্ভব। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশও রয়েছে। সিটি করপোরেশনের উচিত তা দ্রুত বাস্তবায়নে উদ্যোগী হওয়া।
লেখক: পর্তুগাল প্রবাসী
kaisulkhan@yahoo.com
মন্তব্য করুন