একটি পরিকল্পিত মাদক মামলার কাহিনি

বকুল আহমেদ
প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০২২ | ১৩:৪৩
সেদিন ১৫ আগস্ট। ঘড়ির কাঁটা রাত ৮টার ঘরে। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর শহীদ ফারুক সড়কে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) আভিযানিক দল। ৩৯ বছর বয়সী আব্দুল্লাহ আল তানভীর আরিফকে ঘিরে হঠাৎ তল্লাশি। বলা হলো- পকেটে মিলেছে ২০০ পিস ইয়াবা। এবার ডিএনসি সদস্যদের সঙ্গে দেনদরবার। মামলায় ইয়াবার সংখ্যা দেখানো হবে কম! বিনিময়ে তাঁদের হাতে দিতে হবে এক লাখ টাকা। ঘুষের অঙ্কের সমাধান না মেলায় আরিফকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ডিএনসি গেন্ডারিয়ায় ঢাকা বিভাগীয় গোয়েন্দা কার্যালয়ে। আরিফকে সেখানে নিয়ে বেধড়ক পিটুনি। গায়েব করা হয় তাঁর একটি দামি মোবাইল ফোনসেট। শেষমেশ মামলার পর ২০০ পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার দেখিয়ে আরিফকে পাঠানো হয় ঢাকার আদালতে। তিনি এখন আছেন কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। সমকালের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্য।
সমকাল তথ্য যাচাই করে জানতে পেরেছে, মামলার এজাহারে রয়েছে গোঁজামিল। গ্রেপ্তারের ঘটনাস্থল নিয়ে রয়েছে লুকোচুরি। এজাহারে বলা হয়েছে- যাত্রাবাড়ীর ৬৯, শহীদ ফারুক সড়কের 'ভাই ভাই ফ্রুটস স্টোর' নামের দোকানের সামনে থেকে আরিফকে ধরা হয়েছে। আদতে তাঁকে আটক করা হয় ওই দোকান থেকে অন্তত ৩০০ গজ দূরের ১০৬ নম্বর হোল্ডিংয়ের পাশ থেকে। শুধু ফল দোকানের মালিক ও কর্মচারীকে সাক্ষী বানানোর জন্য এজাহারে ওই ঠিকানা জুড়ে দেওয়া হয়। ফল ব্যবসায়ী দিলু খান ও তাঁর কর্মচারী রুবেলকে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা হয়েছে। এজাহারে দিলু খানের নামও লেখা হয়েছে 'লিলু খান'।
আরিফকে আটক করা হয় ১৫ আগস্ট, অথচ মামলা হয়েছে পরদিন। দাবি করা ঘুষের টাকা পাওয়ার আশায় মামলা করতে সময়ক্ষেপণ করা হয়েছিল। টাকার জন্য রাতে গেন্ডারিয়া কার্যালয়ে আরিফের ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। ঘুষ না পেয়ে ১৬ আগস্ট ডিএনসির ঢাকা বিভাগীয় গোয়েন্দা কার্যালয়ের পরিদর্শক মাসুদুর রহমান বাদী হয়ে যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা করেন। আরিফের কাছ থেকে আভিযানিক দলটি একটি স্মার্ট ফোন ও একটি বাটন ফোন জব্দ করলেও জব্দ তালিকায় বাটন ফোনটি দেখানো হয়েছে।
ওই দিন রাতে অভিযানে অংশ নেন ডিএনসির ঢাকা গোয়েন্দা বিভাগের সহকারী পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মুহাম্মদ রিফাত হোসেন, উপপরিদর্শক ইকবাল আহম্মদ দীপু, পরিদর্শক মাসুদুর রহমান, সহকারী উপপরিদর্শক মো. আতাউল হক, সিপাহি সোহেল রানা, মোহাম্মদ আবু হানিফ ও গাড়িচালক আব্দুর রহিম।
আরিফের পরিবারের দাবি, ফাঁসানো হয়েছে তাঁকে। শহীদ ফারুক সড়কের ১০২/১ নম্বর ভবনের তৃতীয় তলায় 'লাইন আপ আইটি ইনস্টিটিউট' নামে একটি প্রতিষ্ঠান চালান আরিফ। সেখানে কম্পিউটার শেখানো হয়।
আরিফের ভাই আব্দুল্লাহ আল শরিফ জানান, ১৫ আগস্ট রাতে আরিফের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পাশের সড়ক থেকে তাঁকে আটক করেন ডিএনসির সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা। এক পর্যায়ে আরিফের ফোন থেকে তাঁকে কল করে টাকা দাবি করেন আভিযানিক দলের সদস্য সোহেল রানা। টাকা নিয়ে ডিএনসির গেন্ডারিয়া কার্যালয়ে যেতে বলা হয়।
শরিফ বলেন, 'গেন্ডারিয়া অফিসে যাওয়ার পর আমাকে বলা হয়- কক্সবাজার থেকে দুই হাজার পিস ইয়াবা এনে দেওয়ার কথা বলে আরিফ তাঁদের এক সোর্সের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা নিয়েছে। ওই টাকা পরিশোধ করলে ছেড়ে দেওয়া হবে। এত টাকা দিতে পারব না জানানোর পর একজন বলেন, এক লাখ টাকা দিলে মামলায় কম ইয়াবা দেখাবেন তাঁরা।'
এর পর টাকা জোগাড়ের জন্য শরিফ বাসায় ফেরেন। পরবর্তী সময়ে এক লাখ টাকা দাবি করার কথোপকথন তিনি কৌশলে মোবাইল ফোনে রেকর্ড করেন। পরদিন সকালে ডিএনসির ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক জাফরুল্যাহ কাজলের কাছে টাকা দাবি, ফোন আত্মসাৎ ও আরিফকে মারধরের বিষয়ে অভিযোগ করেন। একই সঙ্গে টাকা দাবির সেই রেকর্ড শোনান।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জাফরুল্যাহ কাজল সমকালকে বলেন, 'আমি রেকর্ডটি শুনেছি। তবে অভিযান যেহেতু গোয়েন্দা বিভাগের দল চালিয়েছে, তাই ঢাকা বিভাগীয় গোয়েন্দা কার্যালয়ের উপপরিচালক রবিউল ইসলামকে ডেকে বিষয়টি জানিয়েছিরাম। পরে রবিউল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানান।'
জানা যায়, গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক কাজী আল আমিন গত ২২ আগস্ট অভিযোগের বিষয়টি তদন্তের দায়িত্ব দেন উপপরিচালক রবিউল ইসলামকে। তদন্তে ঘুষ দাবি, মোবাইল ফোনসেট গায়েব ও আরিফকে নির্যাতনের প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছেন তিনি। গত ১৩ সেপ্টেম্বর ডিএনসির প্রধান কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিপাহি সোহেল রানা আসামির মোবাইল ফোনসেট গায়েব এবং আসামির ভাইয়ের সঙ্গে ফোনে অবৈধ টাকা লেনদেনের বিষয়ে আলোচনার অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। নির্যাতনের চিহ্ন পাওয়া গেছে আসামির শরীরে।
উপপরিচালক রবিউল ইসলাম বলেন, মোবাইল ফোনের রেকর্ডে টাকা দাবির যে কথোপকথন, সেটি সিপাহি সোহেল রানার কণ্ঠের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়। মোবাইল ফোনসেট গায়েব এবং আসামিকে মারধরের অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। তিনি বলেন, সোহেলকে এরই মধ্যে আভিযানিক কার্যক্রম থেকে সরিয়ে দাপ্তরিক কাজ করানো হচ্ছে।
পরিদর্শক মাসুদুর রহমানের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- দায়িত্বে চরম অবহেলা ও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। সোহেল বাদে আভিযানিক দলের অন্য সদস্যরা পার পেয়ে যাচ্ছেন কিনা- এমন প্রশ্ন উঠলে ডিএনসি প্রধান কার্যালয় থেকে ঘটনার পুনঃ তদন্তের জন্য অন্য এক কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
আসামি ধরতে দেখেননি সাক্ষীরা :আভিযানিক দলটি এজাহারে সাক্ষীও বানিয়েছেন ভুয়া। যাত্রাবাড়ী মোড় থেকে শহীদ ফারুক সড়কে প্রবেশ মুখের ফল ব্যবসায়ী দিলু খান ও তার কর্মচারী রুবেলকে জোর করে সাক্ষী বানানো হয়েছে। গত ২৩ সেপ্টেম্বর দুপুরে যাত্রাবাড়ীতে কথা হয় ফল ব্যবসায়ী দিলু খানের সঙ্গে। মিথ্যা সাক্ষীর নাম ভুল লেখাটা ইচ্ছা করে, নাকি ভুলে লিখেছেন মামলার বাদী- তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন।
দিলু খান বলেন, 'কর্মচারী রুবেলসহ আমি দোকানে বসে ছিলাম। দুই লোক এসে বলল, আমরা ইয়াবাসহ একটা আসামি ধরেছি। জিজ্ঞাসা করি- আসামি কই। হাত ইশারা করে দূরের একটি গাড়ি দেখিয়ে বলল- ওই যে গাড়ির মধ্যে আসামি বসে আছে। আপনি সাক্ষী দেবেন- আপনার দোকানের সামনে থেকে আসামি ধরা হয়েছে। তার কাছ থেকে ইয়াবা পাওয়া গেছে। জিজ্ঞাসা করি, আমি তো কিছুই দেখি নাই। না দেখে মিথ্যা বলব কেন। তাদের একজন বলল- আপনার কোনো ঝামেলা নেই। এরপর সাক্ষী করল আমাকে।' দিলু খান তাঁদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, একজন মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষী দিলে পরবর্তী সময়ে যদি ওই ব্যক্তি জামিনে বেরিয়ে তাঁকে খুন করে ফেলে, তখন কী হবে। জবাবে তাঁরা অভয় দিয়েছিলেন তাঁকে। তাঁর দোকানের কর্মচারী রুবেল জানান, একইভাবে মিথ্যা সাক্ষী বানানো হয়েছে তাঁকেও। তাঁরা গাড়ির কাছে গিয়ে আসামি দেখেননি।
ঘটনাস্থল ভিন্ন ও মিথ্যা সাক্ষী করার বিষয়টি অস্বীকার করে পরিদর্শক মাসুদুর রহমান সমকালকে বলেন, 'সাক্ষীদের সামনে আরিফকে ইয়াবাসহ ধরা হয়েছে।' টাকা দাবি, মারধর ও মোবাইল ফোনসেট গায়েবের বিষয়ে কিছু জানেন না বলে দাবি করেন তিনি।