ঢাকা শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪

প্রদর্শনী

মাক্‌ রিবুর ক্যামেরায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি

মাক্‌ রিবুর ক্যামেরায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি

বিশ্বখ্যাত আলোকচিত্রী মাক্‌ রিবুর 'বাংলাদেশ ১৯৭১ :শোক ও সকাল' শীর্ষক প্রদর্শনী চলছে রাজধানীর আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে। বুধবার তোলা -সমকাল

শাতিল আহমেদ

প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২২ | ১৩:৪৪

প্রাচীন একটি বটবৃক্ষতলে আশ্রয় নিয়েছে তিন সদস্যের শরণার্থী পরিবার। এক মধ্যবয়সী নারী বসে আছেন শিকড়ের ওপর। অপর একটি শিকড়ে শ্রান্ত শরীরে গভীর ঘুমে এক ব্যক্তি। তাঁদের পেছনে অপেক্ষাকৃত কম বয়সী আরও এক নারীকে দেখা যাচ্ছে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখেমুখে রাজ্যের অনিশ্চয়তা। পেছনে ফেলে আসা যুদ্ধের দুঃসহ স্মৃতির ঘোর যেন কাটেনি তাঁর।

এ পরিবারের ছবিটি বিশ্বখ্যাত ফরাসি আলোকচিত্রী মাক্‌ রিবুর ক্যামেরায় যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। কলকাতা শহর থেকে ১০০ মাইল দূরে কৃষ্ণনগর শরণার্থী শিবির থেকে স্থিরচিত্রটি ধারণ করা হয় ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের শেষদিকে। দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ তখন চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে চলছিল। যে শরণার্থী পরিবারের ছবি মাক্‌ রিবু তোলেন, তাঁরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রাণভয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন সীমান্ত লাগোয়া কৃষ্ণনগরে।
বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের খবরে আগ্রহী হয়ে ভারতে ছুটে আসেন মাক্‌ রিবু। তাঁর তোলা ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের সদরদপ্তর পেন্টাগনের সামনে সশস্ত্র বাহিনীর মুখোমুখি 'ফুল হাতে এক তরুণী' ছবিটি তখন শান্তির আন্তর্জাতিক প্রতীকে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষদিকে তোলা মাক্‌ রিবুর এমন অপ্রকাশিত কিছু ছবি নিয়ে রাজধানীর আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য ঢাকা'র লা গ্যালারিতে চলছে প্রদর্শনী। 'বাংলাদেশ ১৯৭১ :শোক ও সকাল' শীর্ষক প্রদর্শনীটি শুরু হয়েছে গত ১৫ অক্টোবর। পক্ষকালব্যাপী এ আয়োজন শেষ হবে ৩১ অক্টোবর। লা লেসামিও দ্য মাক্‌ রিবু ও গিমে মিউজিয়ামের সহায়তায় যৌথভাবে এর আয়োজক আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দ্য ঢাকা ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।

মাক্‌ রিবু ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের শুরুতে মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় এগিয়ে আসা ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে জামালপুর-শেরপুর হয়ে বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন। একে একে তাঁর ক্যামেরায় ধরা পড়ে ওই সময়ের নানা দৃশ্য। জামালপুর থেকে তোলা একটি ছবিতে দেখা যায়, আত্মসমর্পণের পর পাকিস্তানি সেনারা হাত উঁচিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সামনে দেখা যচ্ছে, কোনো অগ্নিদগ্ধ জনপদ থেকে উড়ছে ধোঁয়া। এ ছাড়া ভারতীয় বাহিনীর ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ি দেওয়ার প্রস্তুতি, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাবেশ, মিত্রবাহিনীর ঢাকায় প্রবেশ, তাঁদের স্বাগত জানিয়ে স্থানীয় জনতার উল্লাস ধারাবাহিকভাবে উঠে এসেছে প্রদর্শনীতে।

১৯২৩ সালে জন্ম নেওয়া মাক্‌ রিবু ৯৩ বছর বয়সে ২০১৬ সালে প্যারিসে মারা যান। নিজের ১৪তম জন্মদিনে বাবার দেওয়া ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলা শুরু হয় তাঁর। ১৯৪৪ সালে দখলদার জার্মান নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন তিনি। পরে পড়াশোনা করেন প্রকৌশল বিষয়ে। কর্মজীবন শুরুর তিন বছরের মধ্যেই আলোকচিত্রী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৫৩ সালে লাইফ ম্যাগাজিনে প্রকাশ হয় তাঁর প্রথম ছবি। প্যারিসের বিখ্যাত আইফেল টাওয়ারের ওপর কাজে ব্যস্ত এক রংমিস্ত্রির ছবিটি সাড়া ফেলে। পরে ম্যাগনাম ফটোতে যোগ দেন রিবু। এর পর কাজের সুবাদে ভ্রমণ শুরু করেন প্রাচ্যের দেশগুলোতে। ১৯৫৫ সালে সড়কপথে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আফগানিস্তান, পাকিস্তান হয়ে যান ভারতে। এক বছরের বেশি সময় সেখানে অবস্থানের পর ১৯৫৭ সালে কলকাতা থেকে যান চীনের বেইজিংয়ে। পরে বারবার দেশটি ভ্রমণে যান তিনি। ১৯৬০ সালে আলজেরিয়া ও সাব-সাহারান আফ্রিকার দেশগুলোর স্বাধীনতা আন্দোলনের ছবি তোলেন। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নেও সময় কাটান তিনি।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের ছবি তোলার মধ্যেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আগ্রহী হয়ে ওঠেন রিবু। জামালপুর-শেরপুর হয়ে ঢাকায় আসা পর্যন্ত বেশ কিছু ছবি তোলেন তিনি। ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সঙ্গে ঢাকায় প্রবেশকারী বিদেশি সাংবাদিকদের প্রথম দলে ছিলেন। সে সুবাদে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে ঢাকাবাসী কীভাবে বরণ করে নেয়, তার চিত্র ধরা পড়ে রিবুর ক্যামেরায়। যদিও এসব ছবির বেশিরভাগ এখনও অপ্রকাশিত। ১৯৫৩ থেকে '৭৭ সালের মধ্যে তোলা ১৯২টি ছবির মূল প্রিন্ট মাক্‌ রিবু ২০১১ সালে দান করেন প্যারিসের ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টে।


whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×