ঢাকা মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪

মুখে স্কচটেপ, সুপারগ্লু দিয়ে হাতজোড়া

মুখে স্কচটেপ, সুপারগ্লু দিয়ে হাতজোড়া

যাতে কোনো শব্দ করতে না পারেন তাই মুখে স্কচটেপ, হাতে লাগানো হলো সুপারগ্লু। গৃহকর্মী তানিয়ার ওপর এমন বর্বরতা ঘটে রাজধানীর বনানীতে -সংগৃহীত

সাহাদাত হোসেন পরশ

প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০২২ | ১৩:৫৫

স্কচটেপে বাঁধা মুখ। ছেঁটে দেওয়া হয়েছে মাথার চুল। ভ্রুও কাটা। শরীরজুড়ে নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন। মুখমণ্ডলে মারধরের কালচে দাগ। বনানীর অভিজাত এলাকার একটি বাসায় এমন পরিস্থিতির শিকার হয় ১৭ বছরের তরুণী তানিয়া বেগম। কোনোভাবে ওই 'বন্দিশালা' থেকে তার মুক্তি মিলছিল না। মঙ্গলবার নির্যাতনের সময় চিৎকার- চেঁচামেচির আওয়াজ যখন আসছিল; সেটি পাশের বাড়ির এক বাসিন্দার নজরে আসে। জাতীয় জরুরি সেবা '৯৯৯'-এ কল করেন তিনি। এর পর বেলা সোয়া ২টার দিকে বনানী থানা পুলিশের একটি টিম ২৩ নম্বর সড়কের ৮৪ নম্বর বাড়ির সাততলার ফ্ল্যাট থেকে তাকে উদ্ধার করে। এর পর নেওয়া হয় হাসপাতালে। তবে গতকাল পর্যন্ত  এ ঘটনায় মামলা না হওয়ায় ধামাচাপা পড়ে যায় ঘটনাটি। অমানবিক ঘটনা ঘটিয়েও পার পেয়ে যাচ্ছেন অভিযুক্ত গৃহকর্ত্রী সামিনা আলম।

গতকাল বনানীর ওই বাসায় গেলে নিরাপত্তাকর্মীরা সাততলার ফ্ল্যাটে ঢোকার অনুমতি দেয়নি। গৃহকর্মীর ওপর নির্যাতনের ব্যাপারে জানতে চাইলে নিরাপত্তাকর্মীরা বলে, 'মাফ করেন। এসব নিয়ে কথা বলতে পারব না। ছোট চাকরি করি। নিরাপত্তাকর্মীদের টেবিলে কয়েকটি রেজিস্টার চোখে পড়ে। এর মধ্যে একটির ওপরে লেখা ছিল 'দুর্ঘটনাজনিত'। ফ্ল্যাটে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে সেখানে লিখে রাখে নিরাপত্তারক্ষীরা। বুধবারের ঘটনা নোট আকারে সেখানে লেখা রয়েছে- 'হাফিজ ও ফারুকের ডিউটি চলাকালীন ২টা ২০ মিনিটের দিকে বনানী থানা থেকে চারজন পুলিশ সদস্য আসেন। তাঁরা জানান, ৯৯৯ থেকে কল পেয়ে তাঁরা জানতে পারেন, এ-৭ নম্বর ফ্ল্যাটে গৃহকর্মীকে নির্যাতন করা হয়েছে। এর পর পুলিশ সদস্যরা ওই ফ্ল্যাটে যান। ৪টা ২০ মিনিটে তাঁরা গৃহকর্মী ও তাঁর দুই বোন, স্যার-ম্যাডামকে পুলিশ গাড়িতে তুলে নিয়ে গেছে। সকল ফ্ল্যাট মালিককে ঘটনা অবহিত করা হয়েছে।' অভিযুক্ত সামিনা আলম
নির্যাতনের শিকার গৃহকর্মীর বড় বোন নাসিমা বেগম জানান, তাঁদের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার কলমাকান্দায়। কয়েক বছর ধরেই ঢাকায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন। ঢাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করেন গুলশানের কালাচাঁদপুরে। ছোট বোন তানিয়া গ্রামের একটি মাদ্রাসায় পড়ত। মাঝেমাঝে ঢাকায় নাসিমার বাসায় বেড়াতে আসত। মাসখানেক আগে অভিমান করে গ্রামের বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় তানিয়া। খোঁজাখুঁজির পর তার সন্ধান মিলছিল না। এরই মধ্যে এক দিন তানিয়া তার মাকে ফোন করে জানায়, 'চাকরি পেয়েছে। তাকে নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা না করতে।' তখন তার মা বলেছিলেন চাকরি বাদ দিয়ে দ্রুত বাসায় ফিরতে। তবে কোন এলাকায় তার বসবাস, সেটা জানায়নি তানিয়া।

নাসিমা আরও জানান, বোনের খোঁজ পেতে মা-বাবা পাগলের মতো হয়ে যাচ্ছিলেন। ফোনও ধরছিল না তানিয়া। উপায়ান্তর না দেখে পাঁচ দিন আগে তানিয়ার মোবাইল নম্বরে একটি ভয়েস মেসেজ পাঠান নাসিমা। সেখানে তিনি বলেন, 'বাবা খুব অসুস্থ। তাঁকে দেখতে সবাই গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে।' ওই মেসেজ পাঠানোর পর তানিয়ার নম্বরে ফোন করলে অপরিচিত একজন নারী ধরে অশ্রাব্য ভাষায় গালমন্দ করেন। এর পর বোনকে উদ্ধারে ১৭ এপ্রিল তাঁরা গুলশান থানায় একটি জিডি করেন। এরই মধ্যে বনানী থেকে অপরিচিত এক ব্যক্তি তানিয়ার বাবাকে ফোন করে জানান, বনানীর একটি ফ্ল্যাটের বাসিন্দা তিনি। একটি চিরকুট তিনি পেয়েছেন। সেখানে ওই নম্বরটি দেওয়া ছিল। মেয়েটি তাকে উদ্ধারের আকুতি জানিয়েছে। নইলে তাকে মেরে ফেলা হবে বলেও চিরকুটে উল্লেখ ছিল।

নাসিমা জানান, বোনকে উদ্ধারের পর চেহারা চেনা যাচ্ছিল না। পুরো শরীরে আঘাতের চিহ্ন। কখনও নির্যাতনের শিকার হয়ে অচেতন হয়ে পড়ত সে। জোর করে নেশাজাতীয় দ্রব্য খাওয়ানোর চেষ্টা করা হতো। ইয়াবা আর আইস এমন শব্দ তার বোন ওই ফ্ল্যাটে শুনতে পেত। নির্যাতন করে মোবাইলে ছবি তুলে রাখতেন ওই গৃহকর্ত্রী। এও বলতেন, চুল কেটে ফেলে তানিয়াকে সাততলা থেকে ফেলে দিলেও লোকজন ভাববে, তার মস্তিস্ক বিকৃত হয়েছিল। মারধর করার সময় চিৎকার করলে তালুতে সুপারগ্লু মেখে দুই হাত একসঙ্গে করে দিত। মুখ স্কচটেপ দিয়ে পেঁচিয়ে রাখা হতো। তানিয়ার মোবাইলেও কিছু ছবি রয়েছে, যা দেখলে গা শিউরে ওঠে। বোনের মান-ইজ্জতের কথা চিন্তা করে মামলা করিনি। থানায় নেওয়ার পর ওই নারীর ব্যবসায়ী স্বামী বারবার মাফ চাচ্ছিলেন। এ ঘটনা নিয়ে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই- এটা পুলিশের কাছে দিয়েছি। দু'পক্ষ মিটমাট হয়েছে। গরিব মানুষ; মামলা করলে চালাব কীভাবে? খাওয়ার টাকা জোগাড়ের চিন্তা করতেই দিন পার হয়। এখনও বোনের চিকিৎসা চলছে। বাসায় আনার পর তানিয়ার মোবাইলে একটি মেসেজ পাঠান নির্যাতনের ঘটনায় অভিযুক্ত ওই নারী। তিনি বলেন, 'তোকে ১ লাখ টাকা দিয়েছি। সেটা তো পেয়েছিস।' নাসিমা জানান, পুলিশ তাদের ৫৭ হাজার টাকা দিয়েছে।

এ ঘটনার ব্যাপারে জানতে নির্যাতনের শিকার কিশোরীর ভাই মো. শফিকুরের সঙ্গে দুই দফা কথা হয়। তিনি বলেন, 'পুলিশ শুরু থেকে বলছিল, ওরা বড়লোক। মামলা করে কী পাবেন? বরং সমঝোতা করে ফেলেন।' এর পরই শফিকুর তাঁর কথা ঘুরিয়ে বলেন, 'আমরাই মামলা করতে চাইনি। মামলা করলেও শেষ পর্যন্ত চালাতে পারব না।'
এ ব্যাপারে বনানী থানার ওসি নূরে আজম মিয়া বলেন, 'যেভাবে মেয়েটির ওপর নির্যাতন করা হয়েছে, সেটা বর্ণনা করাও কঠিন। মামলা করার জন্য অনেক বোঝানো হয়েছে। তবে ভুক্তভোগীর পরিবার কোনোভাবে রাজি হচ্ছিল না। পরিচিত কারও ফোন পেয়ে তারা মামলা করা থেকে সরে গেছে। এ ঘটনার বিচার করা যাচ্ছে না- এটা ভেবে আমাদের খারাপ লাগছে। তারা না চাইলে পুলিশ তো অতিউৎসাহী হয়ে মামলা নিতে পারে না।'

মামলা না করার জন্য ভুক্তভোগীর স্বজনকে পুলিশের পক্ষ থেকে বোঝানো হয়েছে কিনা- এমন প্রশ্নে ওসি বলেন, পুলিশ কেন মামলা না করতে বোঝাতে যাবে?
চাপ, প্রলোভন ও টাকা দিয়ে ভয়ংকর এ ঘটনা আড়াল করার অভিযোগের ব্যাপারে ওসির ভাষ্য, 'টাকা-পয়সা দেওয়ার ব্যাপারে আমরা কিছু জানি না।'
৯৯৯-এ কল পেয়ে বনানীর ওই ফ্ল্যাটে যান বনানী থানার উপপরিদর্শক এজাজুল হক। তিনি সমকালকে বলেন, ওই গৃহকর্ত্রীর ছোট্ট এক সন্তান রয়েছে। কোনো কারণে ওই সন্তান কাঁদলে তার জন্য গৃহকর্মীর ওপর অমানবিক নির্যাতন করা হতো। এর বাইরে অন্য কোনো অজুহাতে তাকে মারা হতো কিনা, জানা নেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বনানীর ওই ফ্ল্যাটের একজন নিরাপত্তারক্ষী সমকালকে জানায়, সাততলার ওই গৃহকর্ত্রী সামিনা কিছুদিন আগে স্বামী ও সন্তানকে নিয়ে ওই ফ্ল্যাটে ওঠেন। এর পরই গৃহকর্মী হিসেবে এক তরুণীকে নিয়ে আসা হয়েছিল।

whatsapp follow image

আরও পড়ুন

×