ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

চোখ ভিজে যায় জলে

যমজ শিশু দুটিও খুঁজে ফিরছিল বাবাকে

যমজ শিশু দুটিও খুঁজে ফিরছিল বাবাকে

আতাউর রহমান

প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ | ১৯:১৬

সাইরেন বাজিয়ে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স আসছিল একের পর এক। শত স্বজন হুমড়ি খেয়ে চোখ রাখেন কালো গ্লাসে, ছুটে যান লাশকাটা ঘরে। অঙ্গার হওয়া মানুষগুলোকে নিজের আপনজন ভেবে কেঁদে ওঠেন হাউমাউ করে, কেউ চোখ মোছেন নিভৃতে। এমনসব হৃদয়বিদারক দৃশ্যের মাঝেও আটকে যায় চোখ- ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গের সামনে ফুটফুটে দুই শিশু, মায়ের কোলে।

এর পরের গল্পটা বড়ই মর্মন্তুদ। যাতে শুধুই চোখ ভিজে যায় জলে।

যমজ শিশু কোলে মা মুক্তা আক্তার। ১১ মাস বয়সী আবদুল্লাহ ও মেহজাবীন। বুধবার রাতে চকবাজারে আগুন লাগার ঘণ্টা তিনেক পর থেকেই এ দু'জন স্বজনদের কোলে ছুটে বেড়িয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কখনও মিটফোর্ড। বাবার লাশ খুঁজে ফিরেছে তারা মর্গে। বাবা কাওসার আহমেদ 'আল মদিনা মেডিকেল ক্লিনিক' নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর ছাত্র এখনও। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত লাশটি খুঁজে পাওয়া যায়নি তার, মিলেছে বিকেলে, মর্গে- অঙ্গার এক দেহ।

ভিড় ঠেলে এগিয়ে যান কাওসারের স্বজনরা। তখনও আবদুল্লাহ আর মেহজাবীন মা মুক্তা আক্তারের কোলে। ফ্যালফ্যাল করে স্বামীর অঙ্গার হওয়া দেহের দিকে শুধু তাকিয়েই রইলেন। একটু পর, একটু ধীরে, অজান্তেই গড়িয়ে পড়ল জল। মুক্তার চোখে মুক্তার মতো জল। সঙ্গে শত জিজ্ঞাসা- বড় হলে কী বোঝাবেন অবুঝ দুই সন্তানকে? ভালোবাসার মানুষটি ছাড়া বাঁচবেনইবা কীভাবে! কেমনে চলবে সংসার! এমন মৃত্যুর দায় কার? স্বামীহারা এই নারীর চোখ আর মুখাবয়বে বেরিয়ে আসে আরও কত প্রশ্ন। উত্তর নেই কোনো, আপাতত ওই চোখের জল।

মর্গের সামনে হাউমাউ করেই কাঁদছিলেন কাউসারের মা, বাবা আর দুই ভাই। কান্নাজুড়ে দেয় আবদুল্লাহ আর মেহজাবীনও। এই কান্না ছুঁয়ে যায় মর্গের সামনে শত স্বজনের চোখেও। ছোট্ট বয়সে বাবা হারানো সন্তান দুটির শোক পরিণত হয় সবার শোকে।

স্বজনরা বলছিলেন, কাওসার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ শেষবর্ষের ছাত্র ছিলেন। খুবই মেধাবী এই তরুণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় হয়েছিলেন ১৭তম। পুড়ে যাওয়া ভবনগুলোর একটিতে 'আল মদিনা মেডিকেল হল ক্লিনিক' নামে একটি প্রতিষ্ঠান চালাতেন। পাশেই একটি ডেন্টাল ক্লিনিক। সেখানেই আগুনে আটকা পড়ে দগ্ধ হয়ে মারা যান তিনি।

কাওসারের ছোট ভাই ইলিয়াস হোসেন, পেশায় দাঁতের চিকিৎসক। তিনি বলছিলেন, 'আগুনের সময় ক্লিনিকে কাওসারের সঙ্গে তিন দাঁতের চিকিৎসক ও একজন রোগী ছিল। ক্লিনিকের গেট বন্ধ থাকায় কেউ বের হতে পারেননি।'

অপর এক স্বজন বলছিলেন, মুক্তাকে পছন্দ করেই বিয়ে করেছিলেন কাওসার। চকবাজার এলাকায় তাদের বাসা। এক আগুনে তছনছ হয়ে গেল পুরো পরিবারটি। তাদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার হোমনায়। কাওসারের বাবার নাম খলিলুর রহমান।

কাওসারের মা বিলাপ করে বলছিলেন, 'আমার আর কিছুই রইল না। চার ছেলে ইলিয়াস, ইয়ামিন ও ফয়সালের মধ্যে কাওসার পরিশ্রমী ও মেধাবী ছিল। মাদ্রাসা থেকে পাস করে নিজের যোগ্যতায় ভর্তি হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর মধ্যেই শেয়ারে শুরু করে ক্লিনিকের ব্যবসা। সেই ক্লিনিকেই পুড়ে মরল সে। ওর দুইটা বাচ্চা রয়েছে। কত স্বপ্ন ছিল ওদের নিয়ে। সবকিছুই শেষ হয়ে গেল!'

সন্ধ্যায় ইলিয়াসের ফোন। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, 'ভাইয়ের লাশ নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি। ওর সন্তান দুটোর জন্য দোয়া করবেন।'

আরও পড়ুন

×