ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

আর কত লাশ চাই

কেউ সরায়নি কেমিক্যাল গুদাম

আর কত লাশ চাই

ইন্দ্রজিৎ সরকার ও মিরাজ শামস

প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ | ১৯:৩৩

চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংসস্তূপের পাশে দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যখন রাসায়নিকের গুদাম সরানোর বিষয়ে 'শক্ত অবস্থান' নেওয়ার কথা জানিয়ে ব্রিফ করছিলেন; পাশ থেকেই লোকজন তখন মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন ৯ বছর আগের নিমতলী ট্র্যাজেডির কথা। স্থানীয়রা বলছিলেন, ঘটনা ঘটলেই শুরু হয় তোড়জোড়; দেওয়া হয় প্রতিশ্রুতি। কিছুদিন যেতে না যেতেই তা ভুলে যায় সবাই। যেমনটা ভুলে গেছে নিমতলী ট্র্যাজেডির পর দেওয়া সব ওয়াদা।

২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিকের গুদামে লাগা আগুনে ১২৪ জন নিহত হন। এর পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটি অগ্নিকা প্রতিরোধে যেসব সুপারিশ করেছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ঢাকার আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিকের কারখানা ও গুদাম সরিয়ে নেওয়া। এ জন্য ছিল ১৭টি সুপারিশ। কিছু বাস্তবায়ন হলেও ভয়ঙ্কর রাসায়নিকের গুদাম, প্লাস্টিকের কারখানা আজও সরেনি। সেই দুর্ঘটনা থেকে কোনো শিক্ষা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। গত বুধবার রাতে চকবাজারের আগুন চোখে আঙুল দিয়ে তা বুঝিয়ে দিল।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন দাবি করেন, তারা বিভিন্ন সময়েই রাসায়নিকের গুদাম সরানোর অভিযান চালিয়েছেন। বিশেষ করে ২০১৭ সালের মার্চে ব্যাপক অভিযান চালানো হয়। অবশ্য পরে তা থেমে যায়। এ বিষয়ে মেয়র বলেন, সিটি করপোরেশনের আন্তরিকতার কোনো অভাব ছিল না। তবে শিল্প মন্ত্রণালয় এবং ব্যবসায়ীদের বড় সংগঠনগুলোর অনুরোধে তারা অভিযান এগিয়ে নিতে পারেননি। কারণ তারা শিল্পনগরী করার জন্য সময় চেয়েছিলেন। গত বুধবারের ঘটনার পর অবশ্য মেয়র আবারও অভিযানে নামা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন।

চকবাজারে অগ্নিকাে র স্থানে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক ও দাহ্য পদার্থের চিহ্ন। ফায়ার সার্ভিস ও উদ্ধারকর্মীরা বলছেন, ভবনগুলোতে পারফিউম, প্লাস্টিক ও বিভিন্ন রাসায়নিক পণ্য থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে এবং তা নেভাতেও সময় লেগেছে। বুধবারের ঘটনার পর চকবাজার ছাড়াও পুরান ঢাকার নিমতলী, আগামাসিহ লেন, বংশাল, নাজিরাবাজার, মিটফোর্ড, আরমানিটোলা, বেগমবাজার, নাজিমুদ্দিন রোডসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে প্লাস্টিকের কারখানা ও রাসায়নিক ব্যবহার করে পণ্য উৎপাদনের বিভিন্ন কারখানা ও গুদাম দেখা গেছে।

২০১০ সালের ঘটনার পর তদন্ত কমিটির সুপারিশে রাজধানীর রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ জন্য 'বিসিক কেমিক্যাল পল্লী' প্রকল্পও হাতে নেয় সরকার। যদিও আট বছর পর ২০১৮ সালের অক্টোবরে তা একনেকের অনুমোদন পায়। ২০১ কোটি ৮১ লাখ টাকায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। যদিও চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি এ প্রকল্পের পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে এখনও জমি অধিগ্রহণসহ প্রকল্প এলাকায় কোনো কাজ শুরু করতে পারেনি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান।

গতকাল শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন জানান, পুরান ঢাকার কেমিক্যাল ও প্লাস্টিক কারখানাগুলো পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ জায়গায় স্থানান্তরের লক্ষ্যে এরই মধ্যে দুটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কেমিক্যাল কারখানা স্থানান্তরে কেরানীগঞ্জে 'বিসিক কেমিক্যাল পল্লী প্রকল্প' বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন। ৫০ একর জমির ওপর গড়ে তোলা হবে এই পল্লী। এতে ৯৩৬টি প্লট থাকবে। প্রকল্পটি ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়ন হবে। এর প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ২০১ কোটি ৮১ লাখ টাকা। এ ছাড়া প্লাস্টিক শিল্পের উন্নয়নে মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদীখান উপজেলার বরবর্তা মৌজায় 'বিসিক প্লাস্টিক শিল্পনগরী প্রকল্প' বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ৫০ একর জমির ওপর স্থাপিত এ নগরীতে ৩৬০টি প্লট থাকবে। দ্রুত প্রকল্প দুটি বাস্তবায়ন করা হবে।

এদিকে, বিসিকের দীর্ঘসূত্রতার কারণে বারবার দুর্ঘটনা ঘটছে বলে দোষারোপ করেন ব্যবসায়ীরা। তারা পুরান ঢাকার দাহ্য পদার্থের কারখানা ও গোডাউন দ্রুত স্থানান্তরের দাবি জানিয়ে বলেন, এমন দুর্ঘটনার আর যেন পুনাবৃত্তি না হয়। গতকাল চকবাজারের চুড়িহাট্টায় দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা। এফবিসিসিআই সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, সিনিয়র সহসভাপতি শেখ ফজলে ফাহিমসহ সংগঠনের পরিচালকরা ঘটনাস্থল ঘুরে দেখেন। এর আগে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ওসামা তাসীরসহ সংগঠনের ব্যবসায়ীরাও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

এফবিসিসিআই সভাপতি সমকালকে বলেন, নিমতলীর ঘটনার পর তিন মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি হয়েছিল। ওই কমিটি বহুবার বৈঠক করেছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো সমাধান হয়নি। সম্প্রতি উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকে দাহ্য পদার্থের গোডাউন ও কারখানা ঢাকার বাইরে স্থানান্তর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। তিনি বলেন, ঘন বসতিপূর্ণ এই এলাকা কেমিক্যাল ও প্লাস্টিক পণ্য রাখার জায়গা নয়। এগুলো স্থানান্তরের দীর্ঘসূত্রতার কারণে বারবার জানমালের ক্ষতি হচ্ছে। তিনি দ্রুত পরিকল্পিত শিল্প পার্কে এগুলো স্থানান্তরের দাবি জানান। এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পাশে এফবিসিসিআই থাকবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।

প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুকারক ও রফতানিকারক সমিতির সভাপতি জসিম উদ্দিন সমকালকে বলেন, অপরিকল্পিতভাবে শুরু হওয়া এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আবাসিক এলাকায় চলছে। নিমতলীর ঘটনার পর দাহ্য পদার্থের গোডাউন, কারখানা ও বড় দোকান স্থানান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাস্তবায়ন হয়নি। এটি পুরান ঢাকার মানুষের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। এগুলো স্থানান্তর হলে এখন আর এত বড় দুঘটনার শিকার হতে হতো না। তিনি বলেন, প্লাস্টিক অ্যাসোসিয়েশন এসব দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পেতে বেজার সঙ্গে আলোচনা করেছে। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে একটি প্লাস্টিক অর্থনৈতিক অঞ্চল করার প্রস্তাব দিয়েছেন তারা। সেটি বাস্তবায়ন হলে পুরোপুরিভাবে প্লস্টিক কারখানা ও গোডাউন সেখানে স্থানান্তর করা সম্ভব হবে।

ঢাকা চেম্বারের সাবেক পরিচালক ও পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী নেতা আবদুস সালাম সমকালকে বলেন, কেমিক্যাল ও প্লাস্টিক কারখানা অনেকবার সরানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এগুলো স্থানান্তরের জন্য সাত বছর আগে বিসিকের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। কিন্তু বিসিক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। শুধু শিল্প পার্কের আশা দিয়ে বছরের পর বছর পার করেছে।

আরও পড়ুন

×