- রাজধানী
- প্লাস্টিক পোস্টারের ড্রেনযাত্রা
প্লাস্টিক পোস্টারের ড্রেনযাত্রা

প্লাস্টিক পোস্টারের কুফল হাতেনাতেই মিলছে। মঙ্গলবার গেণ্ডারিয়ার আর এম দাশ রোডের ছবি- প্রতিবেদক
লক্ষ্মীবাজারে বাহাদুর শাহ পার্কের বাঁয়ে সড়ক ধরে এগোলে নর্থব্রুক হল রোড। বাংলাবাজার পর্যন্ত পুরো সড়কে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে প্লাস্টিকে মোড়ানো পোস্টার। কিছু পোস্টার মিশেছে গৃহস্থালি বর্জ্যের সঙ্গে। তবে বেশিরভাগই গিয়ে পড়েছে ড্রেনে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ব্যবহূত লেমিনেটেড পোস্টার নিয়ে পরিবেশবাদীদের যে উদ্বেগ ছিল, তারই প্রতিফলন ঘটছে এখন ড্রেনগুলোতে। গতকাল মঙ্গলবার এই দৃশ্য দেখা গেছে পুরান ঢাকার বিস্তৃত এলাকাজুড়ে।
সিটি নির্বাচনে ব্যবহূত প্লাস্টিকে মোড়ানো পোস্টারগুলো দ্রুত অপসারণে অনেক প্রস্তুতির কথা শোনা গিয়েছিল। কিন্তু বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিকের ড্রেনযাত্রা ঠেকানো যায়নি। ভোটের তিন দিন পরও কোনো কোনো এলাকায় পোস্টার ঝুলতে দেখা গেছে। তবে উদ্বেগ ছড়াচ্ছে অনেক এলাকার ড্রেনভর্তি প্লাস্টিক পোস্টার।
গত রোববার বনানীর নির্বাচনী কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে উত্তরের নবনির্বাচিত মেয়র আতিকুল ইসলাম তিন দিনের মধ্যে সব পোস্টার সরিয়ে ফেলার ঘোষণা দেন। পোস্টার না পোড়ানোর আহ্বান জানিয়ে ওই সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, এটা করবেন না। রিসাইকেল করা হবে। পলিথিন ও কাগজ আলাদা করা হবে। একই দিন গ্রিন রোডের কার্যালয়ে দক্ষিণ সিটির নবনির্বাচিত মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস সোমবারের মধ্যে পোস্টারসহ সব ধরনের প্রচারসামগ্রী অপসারণের জন্য সব কাউন্সিলর ও নেতাকর্মীর প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, লেমিনেটেড পোস্টারের প্লাস্টিক বর্জ্য ধ্বংসে এখন যে উপায় আছে, সেটাই ব্যবহার করা হবে।
গতকাল সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, নর্থব্রুক হল রোডে মাত্র আড়াইশ' মিটারের মধ্যে উন্মুক্ত ড্রেনে ১২টি স্থানে বিপুল পরিমাণ লেমিনেটেড পোস্টার। স্থানীয়রা জানান, ভোট শেষ হওয়ার পর যে যেমন খুশি পোস্টার ছিঁড়েছে। বেশিরভাগ পোস্টার সড়কে ছড়িয়ে পড়ে। সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নকর্মীরা এদিকে আসেননি। ফলে একপর্যায়ে পোস্টারগুলো ড্রেনেই গেছে।
সদরঘাটের দিকে এগোতেই দেখা যায়, রাস্তার পাশে বর্জ্যের স্তূপ। এতে যতটা না গৃহস্থালি বর্জ্য, তার কয়েকগুণ পোস্টার। একই দৃশ্য দেখা গেছে বাংলাবাজার, লক্ষ্মীবাজার ও আহ্ছানউল্লা রোডের একাধিক স্থানে। সেদিক থেকে সরে গেণ্ডারিয়া ও সূত্রাপুরের দিকে গেলেও অভিন্ন চিত্র চোখে পড়ে। সড়কের পাশে বর্জ্যের স্তূপেই মিশে গেছে প্লাস্টিকে মোড়ানো পোস্টার। এসব এলাকায়ও অনেক পোস্টারের ঠিকানা হয়েছে ড্রেন।
নারিন্দা এলাকা ঘুরে টিপু সুলতান রোডে ঢুকে দেখা গেছে ধোলাইখাল সংযোগ সড়কের মুখে বর্জ্যের স্তূপ। যথারীতি এখানেও প্লাস্টিকে মোড়ানো পোস্টার। রথখোলা মোড়ের দিকে যেতেই ডান পাশে উন্মুক্ত ড্রেনে দেখা যায় অনেক পোস্টার। এমনিতেই কুচকুচে কালো পানির সঙ্গে ময়লা-আবর্জনায় এখানকার ড্রেন বদ্ধ, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সদ্য সমাপ্ত সিটি নির্বাচনের পোস্টার। সামনের বর্ষায় এর ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন এ এলাকার একাধিক ব্যবসায়ী।
রথখোলা মোড় থেকে ডানে গেলে নবাবপুর রোড। বর্জ্যের স্তূপ এবং ড্রেনে প্লাস্টিকের পোস্টার এখানেও। বংশালের দিকেও একই চিত্র। এখানে সড়কের চেয়ে বেশি পোস্টার ঝুলে আছে ওপরে। সিটি করপোরেশনের কর্মীদের পা পড়েনি গতকাল দুপুর পর্যন্ত। মালিটোলা, তাঁতীবাজার, বাবুবাজার হয়ে ইসলামবাগ যাওয়া পর্যন্ত রাস্তার মোড়ে মোড়ে দেখা গেছে একই দৃশ্য।
ঢাকার দুই সিটিতে ভোট হয়েছে গত ১ ফেব্রুয়ারি। নিয়ম অনুযায়ী পরদিন থেকেই শহরের সব পোস্টার অপসারণের কথা। সে ধরনের প্রস্তুতির কথাও জানিয়েছিল সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। প্লাস্টিকে মোড়ানো পোস্টারগুলো দ্রুত সময়ে যথাযথভাবে অপসারণ নিশ্চিতের নির্দেশনা ছিল হাইকোর্টেরও।
গতকাল এ বিষয়ে কথা বলার জন্য যোগাযোগ করা হলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমডোর মো. জাহিদ হোসেন ফোন রিসিভ করেননি। তবে তিনি ভোটের আগে সমকালকে জানিয়েছিলেন, ভোট শেষ হওয়ার পরদিন থেকেই পোস্টার অপসারণ করা হবে। বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিকের পরিণতি নিয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করেছিলেন।
তবে ভোটের প্লাস্টিক মোড়ানো পোস্টার নিয়ে ভিন্ন কোনো পরিকল্পনা না থাকার কথা জানিয়েছেন ডিএসসিসির আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা-২ এস এম আনছারুজ্জামান। অপসারিত পোস্টারগুলো সাধারণ বর্জ্যের মতোই মাতুয়াইলের ভাগাড়ে ফেলার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে তিনি সমকালকে বলেন, ইতোমধ্যে পোস্টার অপসারণের কাজ শুরু হয়েছে। তবে এই পোস্টার তো ড্রেনে যাওয়ার কথা নয়, গৃহস্থালি বর্জ্যের সঙ্গেও মেশার কথা নয়।
বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার জরিপ অনুযায়ী, এবার দুই সিটি নির্বাচনে দুই কোটির বেশি পোস্টার ছাপা হয়েছে। এর ৭০ শতাংশের বেশি লেমিনেটেড। গবেষণা মতে, প্রতিটি পোস্টারে ব্যবহূত প্লাস্টিকের গড় ওজন ১৩ দশমিক ৪৭ গ্রাম। কোনো কোনো সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, আড়াইশ' টনের বেশি প্লাস্টিক ব্যবহার হয়েছে এবারের ভোটে। তবে এর পরিমাণ যে ১০০ টনের কম নয়, সেটি একবাক্যে বলেছেন সবাই। এ কাজে ব্যবহূত 'ওয়ান টাইম' প্লাস্টিক দীর্ঘদিন পচে না, আবার পুনরায় ব্যবহারযোগ্যও নয়। ফলে প্রচার শেষে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিকের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা দুশ্চিন্তা দেখা দেয়।
ডিএসসিসির কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, 'ওয়ান টাইম' হলেও ভোটের প্লাস্টিকগুলো রিসাইকেলের জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেই। সাধারণ বর্জ্যের মতোই এগুলো ভাগাড়ে ফেলা হবে।
এ প্রক্রিয়ায় প্লাস্টিক বর্জ্য অপসারণের ভয়ঙ্কর পরিণতির ইঙ্গিত দিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নির্বাহী সভাপতি ড. আব্দুল মতিন বলেন, বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য প্রথমে ড্রেনে যাচ্ছে। ময়লা পানির প্যাকেটের রূপ নিয়ে এর ভেতরে আবর্জনা জমাট বাঁধবে। সেখান থেকে ছড়াবে পোকামাকড়, মশা-মাছি। এতে ডেঙ্গুসহ নানা রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়বে শহরে। আবার বর্ষায় জলাবদ্ধতারও সৃষ্টি হবে।
তিনি বলেন, একপর্যায়ে এই পলিথিন নদীতে পড়বে। এর পরিণতি আরও ভয়াবহ। ভোটে ব্যবহূত বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য শহরে নানারকম দূষণের উৎসে পরিণত হলো। এখনও সময় আছে এগুলো যথাযথ উপায়ে অপসারণের। সেদিকে মনোযোগ দিতে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।
মন্তব্য করুন