চীনফেরত যাত্রীরা অবাধে দেশে প্রবেশ করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। চীনে মহামারির মতো করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর বাংলাদেশেও এই ভাইরাস নিয়ে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। চীনের সঙ্গে গভীর বাণিজ্যিক সম্পর্কের কারণে কয়েক হাজার মানুষ প্রতিদিন যাতায়াত করে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর তা কিছুটা কমে এসেছে। তবে এখনও চীন-বাংলাদেশের মধ্যে দিনে চারটি ফ্লাইট যাতায়াত করছে। এসব ফ্লাইটে সাতশ'র মতো যাত্রী বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই তারা দেশে প্রবেশ করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এক যাত্রীর এ-সংক্রান্ত একটি স্ট্যাটাস সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকলে ঝুঁকি আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ঘোষণা করেছিল, চীন থেকে আসা সবাইকে বিমানবন্দরে স্ট্ক্রিনিং করা হবে। তাদের কোয়ারেন্টাইন করে রাখা হবে। এরই অংশ হিসেবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে করে চীন থেকে নিয়ে আসা ৩১২ জনকে আশকোনো হজ ক্যাম্পে কোয়ারেন্টাইন করে রাখা হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, চীন থেকে আসা অন্য যাত্রীদের ক্ষেত্রে কোয়ারেন্টাইন তো দূরের কথা, পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করা হচ্ছে না।

গত ১ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১১টায় চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইন্সে প্রায় দেড়শ' যাত্রী পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই দেশে প্রবেশ করেছে। মুশফিকা সারা নামে এক যাত্রী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এ অভিযোগ করে একটি দীর্ঘ স্ট্যাটাস দিয়েছেন। স্ট্যাটাসে অভিযোগ করে তিনি বলেছেন, গত ১ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১১টায় চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইন্সের একটি বিমানে বাংলাদেশে ল্যান্ড করি। চীন থেকে ফেরার সময় সে দেশে দুই দফায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর আমি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নই বলে নিশ্চিত হতে পারি। কিন্তু হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামার পর দীর্ঘ দুই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ানোর পরও কোনো চেকআপ করা হয়নি।

বিমানবন্দরে ভোগান্তির চিত্র তুলে ধরে মুশফিকা সারা তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন, খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, দুপুর ২টায় চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইন্সে করে যে চীনা এবং বাংলাদেশি নাগরিকরা এসেছেন, তাদেরও চেকআপ সম্পন্ন হয়নি। রাত সাড়ে ১২টায় ওই নাগরিকরা ইমিগ্রেশন পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। কিন্তু আমিসহ চীনা নাগরিকরা প্রায় পাঁচ ঘণ্টা বিমানবন্দরে অপেক্ষার পরও কাউকে চেকআপ করা হয়নি। পরে জানা যায়, চেকআপ করার চিকিৎসক নেই। এতে উপস্থিত সবাই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। কারণ আগতদের স্বজনরা বিমানবন্দরের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন। একপর্যায়ে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। উপস্থিত যাত্রীদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখে তারা বিমান থেকে নামার সময় যে ফরমটি দেওয়া হয়েছিল, সেটিতে 'ওকে, চেক' লিখে ইমিগ্রেশন পার হওয়ার অনুমতি দেন।

মুশফিকার প্রশ্ন- চীন থেকে আসা যাত্রীদের মধ্যে যে কেউই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নন, সেটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই কীভাবে নিশ্চিত করল কর্তৃপক্ষ? এ বিষয়ে জানতে বিমানবন্দরের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. শাহরিয়ার সাজ্জাদকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ইমিগ্রেশন থেকে চীন থেকে আসা যাত্রীদের বিমানবন্দরের কোয়ারেন্টাইনে নিয়ে যেতে বলা হয়। অন্যথায় তারা ইমিগ্রেশন করবে না বলে জানান। পরে সেনাবাহিনীর চার চিকিৎসক সব যাত্রীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তাদের ইমিগ্রেশন করা হয়।

বিমানবন্দর হেলথ ডেস্কে চিকিৎসক না থাকার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যে পরিমাণ চিকিৎসক প্রয়োজন, তা এখানে নেই। মাত্র চার চিকিৎসক দিয়ে এই ডেস্ক চলছে। ২৪ ঘণ্টার জন্য নূ্যনতম ১৩ চিকিৎসক প্রয়োজন।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি দ্রুত চিকিৎসক পদায়নের আশ্বাস দিয়েছেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর করোনাভাইরাস নেগেটিভ পাওয়া গেলেও চীন থেকে আসা যাত্রীদের কোয়ারেন্টাইন করে রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। তা মানা হচ্ছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে এ কর্মকর্তা বলেন, চীন থেকে চারটি ফ্লাইটে কমপক্ষে সাতশ' যাত্রী আসেন। তাদের সবাইকে কোয়ারেন্টাইন করে রাখতে গেলে হাজার হাজার মানুষকে কোয়ারেন্টাইন করতে হতো, যা বাস্তবে সম্ভব নয়। এ কারণে আগতদের বাসাবাড়িতে নূ্যনতম ১৪ দিন পৃথক থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ সমকালকে বলেন, চীনের উহান থেকে করোনাভাইরাসটি ছড়িয়েছে। চীনও ওই রাজ্যটিও লক করে রেখেছে। এ কারণে উহান থেকে আসা ৩১২ জনকে কোয়ারেন্টাইন করে রাখা হয়েছে। চীনের অন্যান্য রাজ্য থেকে আসা ব্যক্তিদের স্ট্ক্রিনিং করে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।

চীন থেকে আসা ব্যক্তিদের শুধু স্ট্ক্রিনিং করে দেশে প্রবেশের কারণে ঝুঁকি বাড়ছে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে মহাপরিচালক বলেন, এখন পর্যন্ত স্ট্ক্রিনিং করে করোনাভাইরাস পজিটিভ কাউকে পাওয়া যায়নি। চীন থেকে আগতদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বাসাবাড়িতে ১৪ দিন পৃথকভাবে থাকার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ফলে ঝুঁকির কোনো কারণ নেই।

৩৯ জনের কেউ আক্রান্ত নন :গতকাল মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাতিদ সেব্রিনা ফ্লোরা জানিয়েছেন, চীন থেকে আসা ৩৯ জনের নমুনা পরীক্ষা করে কারও শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া যায়নি। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (পিসিআর) পরীক্ষা করে তারা ভাইরাসটির বিষয়ে নিশ্চিত হচ্ছেন। এরপর ওই নমুনা পুনরায় পরীক্ষার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে পাঠানো হচ্ছে। দেশে আইইডিসিআরে কেবল পিসিআর পরীক্ষা করার সুযোগ রয়েছে। তাই কারও মধ্যে সংক্রমণের সন্দেহ দেখা গেলে আইইডিসিআরে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

চীনের উহান রাজ্যে গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত করা হয়। গতকাল পর্যন্ত ৪২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়েছে। এই ভাইরাস অন্যান্য দেশে ছড়াতে থাকায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বাস্থ্যগত বিষয়ে বৈশ্বিক জরুরি অবস্থা জারি করেছে। বাংলাদেশ সরকারও এরই মধ্যে ৩১২ জনকে চীনের উহান রাজ্য থেকে ফিরিয়ে এনে ঢাকার আশকোনা হজ ক্যাম্পে পর্যবেক্ষণে রেখেছে। এ ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করার পর উপসর্গ প্রকাশ পেতে এক থেকে ১৪ দিন সময় লাগতে পারে। সে কারণে উহানফেরতদের ১৪ দিন ক্যাম্পে রেখে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।

এই ৩১২ জনের মধ্যে দু'জনকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে রাখা হয়েছে জানিয়ে পরিচালক বলেন, দু'জনের মধ্যে একজনের জ্বর। আরেকজনের মাথাব্যথা থাকায় তাকেও হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। যদিও করোনাভাইরাসের লক্ষণ বা উপসর্গের মধ্যে পড়ে না, তার পরও সতর্কতার অংশ হিসেবে তাদের এখানে রাখা হয়েছে। দু'জনই ভালো আছেন। তাদের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা চলছে। এ ছাড়া গত শনিবার দেশে ফেরা ওই বাংলাদেশিদের মধ্যে তিন পরিবারের আটজন আছেন সিএমএইচে।

আইইডিসিআরের পরিচালক বলেন, বাংলাদেশে অবস্থান করা চীনের নাগরিকদের বিষয়ে তথ্য জানাতে গত ২৯ জানুয়ারি জেলা প্রশাসকদের কাছে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছিল। তাতে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে প্রায় ১০ হাজার চীনা নাগরিক কর্মরত থাকার প্রাথমিক তথ্য পাওয়া গেছে। গত ২৯ ডিসেম্বর থেকে ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় চার হাজার চীনা নাগরিক বাংলাদেশে এসেছেন।