করোনাভাইরাসজনিত আতঙ্কে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনে ঘরে তোলার হিড়িক পড়েছে দেশজুড়ে। তিন দিন ধরে রাজধানীর বাজারে খুচরা পণ্যের চেয়ে পাইকারি পণ্য কেনার দিকে ভিড় বেশি করছেন ক্রেতারা। এর ফলে বাজারে অনেক পণ্যের ঘাটতিও দেখা দিয়েছে। এ সুযোগে দাম বাড়াতেও শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে খুচরা দোকানে তেমন ভিড় না থাকলেও পাইকারি আড়তের সামনে ভিড় দেখা গেছে ক্রেতার। একসঙ্গে দু-চার বস্তা চাল কিনছেন তারা। মাসের প্রয়োজনীয় বাজারের চেয়েও বাড়তি ডাল, চিনি, তেল, লবণ, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ অন্যান্য পণ্য কিনছেন বেশিরভাগ ক্রেতা। শুধু রাজধানীর বাজারে নয়, দেশের বেশিরভাগ জেলায় গতকাল দিনভর অনেকেই বাড়তি কেনাকাটা করেছেন। বিভিন্ন জেলায় গতকাল প্রতি বস্তা চাল কিনতে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা বেশি দাম গুনেছেন ক্রেতারা।
রাজধানীর খিলগাঁও বাজারে গিয়ে পছন্দের চাল পাননি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা। তাকে দোকানি আগামী পাঁচ দিন পর যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়ে জানিয়েছেন, ট্রাক ড্রাইভাররা ট্রাক নিয়ে আসতে চাইছেন না- এ কারণে সরবরাহ কম। তাই চাহিদামতো সব ধরনের চাল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ওই কর্মকর্তা জানান, বাজারে এখন যেসব চাল বিক্রি হচ্ছে, তাতে মানভেদে বস্তাপ্রতি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা বেশি নেওয়া হচ্ছে।
রাজধানীর খুচরা বাজারের দোকানগুলোতেও পণ্যের সরবরাহ কমেছে। ক্রেতার ভিড়ও কমেছে। খুচরা দোকানিরা জানান, অনেকেই ঘরে পণ্য মজুদ করেছেন, আতঙ্কের কারণে তারা বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বের হচ্ছেন না। এতে গত চার দিনের তুলনায় গতকাল খুচরা বিক্রি কম হয়েছে।
তবে এখনও পাইকারি পণ্য কেনাবেচা চলছে হরদম। কারওয়ান বাজারের মতো অন্য বাজারগুলোতেও পাইকারি কেনাকাটায় ভিড় দেখা গেছে। মিরপুর-১ বাজারের পাইকারি একটি আড়তে চালের দাম জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, 'কোন দাম শুনতে চান? সরকারি দাম আছে, বাজারমূল্য আছে এবং দোকানের বিশেষ দর আছে। সরকারি দর বাড়েনি। প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) মিনিকেট আগের মতো আড়াই হাজার থেকে দুই হাজার ৬০০ টাকা। বাজারের দর তিন হাজার থেকে তিন হাজার ২০০ টাকা। তবে তার দোকান থেকে নিলে দুই হাজার ৯০০ থেকে তিন হাজার টাকার মধ্যে সব ধরনের মিনিকেট চাল পাওয়া যাবে। তবে এখন সব ধরনের চাল দেওয়া সম্ভব হবে না। অর্ডার দিলে পছন্দসই চাল দেওয়া যাবে।
রাজধানীর খিলগাঁও, শান্তিনগর, মগবাজার, নিউমার্কেট, মিরপুরসহ বিভিন্ন বাজারের বেশিরভাগ দোকানে মোটা চাল গুটি ও স্বর্ণা চাল পাওয়া যায়নি। দু-একটি দোকানে সামান্য পরিমাণে থাকলেও তা দুই হাজার টাকা বস্তা হিসাবে বিক্রি হচ্ছে। এ হিসাবে বস্তায় মোটা চালের দাম ৬০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এই দর অনুযায়ী প্রতি কেজি মোটা চালের দাম পড়ছে ৪০ টাকা। মাঝারি মানের চাল পাওয়া গেলেও বস্তাপ্রতি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে। বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার ২০০ থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকায়। সরু চালের দামও একই হারে বাড়ছে। পাশাপাশি বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে ভোজ্যতেল, আটা-ময়দা, মসলাপণ্য, আলুসহ কিছু পণ্য। এসব পণ্য বাজার ও দোকানভেদে বিভিন্ন দামে বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে, শিশুখাদ্য গুঁড়া দুধ ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের দাম বেশি নেওয়ায় গুলশানে এক প্রতিষ্ঠানকে সিলগালা ও দুই প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুলশান ডিএনসিসি মার্কেটে বিশেষ এ অভিযান চালায় এ অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার জানান, এসএ ট্রেডার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান শিশুখাদ্য গুঁড়া দুধ বিক্রয়মূল্য থেকে ৫০০ টাকা বেশি দামে বিক্রি করেছে। অভিযানে হাতেনাতে প্রমাণ পাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং আগামী শনিবারের মধ্যে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া হ্যান্ড স্যানিটাইজারের গায়ে লেখা দাম কেটে দিয়ে বেশি দামে বিক্রি করায় দুই ফার্মেসিকে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে।
এখন রাজধানীর বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা বাজারে নিয়মিত সাতটি টিমে বিভক্ত হয়ে অভিযান চালানো হচ্ছে। গতকাল রাজধানীর ১২টি বাজারে চাল, ডাল, আটা, ময়দা, ভোজ্যতেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে এ বিশেষ অভিযান চালানো হয়। পাশাপাশি ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের অতিরিক্ত পণ্যসামগ্রী ক্রয়-বিক্রয় থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দেওয়া হয়।
দেশের অন্যান্য স্থানেও একই চিত্র :এদিকে রাজধানীর মতো দেশের অন্যান্য স্থানেও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনে মজুদের হিড়িক পড়েছে। সরবরাহের তুলনায় চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বাজারে নিত্যপণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। তবে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে চালিয়ে জরিমানাও করা হচ্ছে। ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর :
গোপালগঞ্জ :জেলার পাঁচ উপজেলায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার হিড়িক পড়েছে। অধিকাংশ পরিবারই নিত্যপণ্য কিনে মজুদ করছে। এর ফলে দামও বাড়ছে। গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার পাইককান্দি গ্রামের হুসাইন সরদার বলেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব আরও বাড়লে সরকার লোকজনকে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করতে পারে- এমন ধারণা থেকে অধিকাংশ মানুষ চাল-ডাল, তেলসহ নিত্যপণ্য কিনে মজুদ করছে। আবার অনেকের ধারণা, আগামীতে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নাও পাওয়া যেতে পারে। তিনি আরও জানান, চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় অসাধু ব্যবসায়ীরা জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। টুঙ্গিপাড়ার গোপালপুর গ্রামের অজিত বিশ্বাস বলেন, গত দু'দিনের ব্যবধানে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা চালে ৪শ' থেকে ৫শ' টাকা বেড়েছে। কোটালীপাড়া উপজেলার ঘাঘর বাজারের এক ব্যবসায়ী জানান, পাইকারি মোকামে চাল-ডাল-তেলসহ প্রতিটি ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। তাই কিছুটা বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। তবে কোটালীপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম মাহফুজুর রহমান বলেন, আমরা সার্বক্ষণিক বাজার মনিটরিং করছি। অতিরিক্ত মুনাফার লোভে কেউ বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সিলেট :ওসমানীনগরে বুধবার সকাল পর্যন্ত হাটবাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৩০ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। দুপুর থেকে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় পেঁয়াজের দর বাড়তে শুরু করে। বিকেলে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। অন্যান্য পণ্যেরও একই অবস্থা।
রাজশাহী :বেশি দামে চাল বিক্রির অভিযোগে রাজশাহীর শাহমখদুম রাইস এজেন্সিকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। বাজার স্থিতিশীল রাখতে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়।
এ ছাড়া মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখান বাজারে অভিযান চালিয়ে তিন প্রতিষ্ঠানকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ শহরের তিন চাল ব্যবসায়ীকে মোট ২৬ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। লাকসামে ১২ প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়েছে ৩ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। লক্ষ্মীপুরে আট দোকানকে ১৩ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় ছয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ৩৪ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এদিকে নওগাঁয় নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ের রাখতে ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন জেলা প্রশাসক মো. হারুন অর রশীদ। গতকাল দুপুরে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।