করোনা সংকটের এ পরিস্থিতিতে ভালো নেই নিম্ন আয়ের অসহায় মানুষ। কোনো কাজ না থাকায় আয় নেই তাদের, ঘরে খাবারও নেই। এ অবস্থায় ক্ষুধার যন্ত্রণায় ঘর থেকে বেরিয়ে আসছেন তারা; রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে অপেক্ষা করছেন ত্রাণের আশায়। বস্তিবাসী বৃদ্ধ, অসুস্থ মানুষ আর নারীদের সঙ্গে শিশুরাও নেমে এসেছে রাস্তায়। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত খাবারের আশায় থাকছেন তারা। কিন্তু সারাদিন অপেক্ষা করেও অনেকের ভাগ্যে খাবার জুটছে না। আবার যারা খাবার বিতরণ করছেন, তাদের সমন্বয় না থাকায় কেউ খাবার পাচ্ছেন, কেউ পাচ্ছেন না। আবার অনেকে একাধিকবারও ত্রাণ সংগ্রহ করতে পারছেন।

রাজধানীর কারওয়ান বাজার এফডিসি সড়কসংলগ্ন হাতিরঝিল মোড়। গত বুধবার দুপুরে সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন ১৫-২০ জন নারী-পুরুষ। বেশিরভাগই  মধ্যবয়সী নারী। প্রত্যেকের হাতে বাজারের ব্যাগ। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ত্রাণ সহায়তা পাওয়ার আশায় দাঁড়িয়ে আছেন রাস্তায়। খাবারের অপেক্ষায় থাকা গৃহকর্মী আয়েশা বললেন, পাশেই বাগবাড়ী বস্তিতে থাকেন। শিশুসন্তান রয়েছে তার। করোনাভাইরাসের কারণে তার কাজ থেকে ছুটি দেওয়া হয়েছে। ঘরে খাবার বলতে কিছুই নেই। এখন ভরসা মানুষের দেওয়া খাবার। কখন খাবার পাবেন, সে অপেক্ষায় আছেন।

পাশে দাঁড়ানো আরেক নারী সুফিয়া জানান, কিছুক্ষণ আগে একটি গাড়ি খাবার দিয়ে চলে যায়। যারা দৌড়ে গেছে, তারাই পেয়েছে। কিশোর ছেলেরাই বেশি পেয়েছে। এখন তারা অন্য কোনো গাড়ির অপেক্ষায় আছেন।

মগবাজারের মধুবাগ এলাকায়ও দেখা গেছে মানুষকে খাবার সংগ্রহ করতে। যে বাড়ি থেকে খাবার দেওয়া হবে বলে জানতে পারছেন, সেখানেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। পাশেই হাতিরঝিলের সড়কে শিল্পী বেগম নামের এক নারীকে দেখা যায় মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে আছেন। যদি কেউ একটু খাবার দিয়ে যায়, এমন আশায়। একই চিত্র দেখা গেছে রাজধানীর ধানমন্ডি ও কলাবাগান এলাকায়ও। ধানমন্ডির ৩ নম্বর সড়কের ছাপড়া মসজিদের সামনে খাবারের অপেক্ষায় ছিলেন ২০ থেকে ৩০ জন। কোথাও খাবার দিচ্ছে খবর পেলেই ছুটে যাচ্ছেন সেখানে।

বুধবার মধ্যরাতের পরও মগবাজার, মৌচাক, মালিবাগ, শাজাহানপুর এলাকায় এসব দরিদ্র মানুষের ভিড় দেখা গেছে। তারা সবাই খাবারের অপেক্ষায় ছিলেন। মগবাজারের ওয়্যারলেস গেটে সকাল থেকেই অপেক্ষায় ছিলেন পঞ্চাশের বেশি মানুষ। সুফিয়া নামের মধ্যবয়সী এক নারী জানালেন, তারা শুনেছেন এখানে প্রায়ই খাবার নিয়ে বিভিন্নজন আসেন। তাই তিনি এতিম নাতিকে নিয়ে এসেছেন। বাসাবাড়িতে কাজ করতেন। সেখান থেকে কাজে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। বেতনও দেয়নি। তাই খাবারের জন্য আজ হাত পাততে হচ্ছে।

তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে আগারগাঁও বস্তিতে থাকেন মর্জিনা খাতুন। তিন বাসায় ঝিয়ের কাজ করেন মর্জিনা। এতে যা সামান্য টাকা আয় হয় তা দিয়েই চলে সংসার। এরই মধ্যে গত ২০ মার্চ থেকে বাসায় কাজ বন্ধ। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বাসার গৃহকর্ত্রীরা আপাতত কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন। ঘরে খাবার না থাকায় সকালে বস্তির কয়েকজনের সঙ্গে বেরিয়েছেন অনাহারি মর্জিনা। তিনি বলেন, কাজ বন্ধ। ঘরে খাওন নাই। ট্যাহা নাই। রাস্তায় আইছি কেউ খাওন দেয় না। আরও খারাপ কথা বলে।

পশ্চিম শেওড়াপাড়ার শাপলা সরণির বস্তিতে থাকেন রুবিনা ও তার মা। রুবিনা গার্মেন্টে চাকরি করেন। মা বাসায় বাসায় কাজ করেন। করোনাভাইরাসের কারণে গত ১৮ মার্চ থেকে কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন গৃহকর্ত্রীরা। রুবিনার গার্মেন্টসও বন্ধ হয়ে গেছে। তারাও পড়েছেন খাদ্য সংকটে।

মিরপুর এক নম্বর, গাবতলী, কল্যাণপুর, কাজীপাড়া, মনিপুরীপাড়া, ফার্মগেটসহ বিভিন্ন এলাকা সরেজমিনে দেখা গেছে ক্ষুধার্ত মর্জিনাদের হাহাকার। তাদের আয় একেবারেই বন্ধ। গলিতে গলিতে, মোড়ে মোড়ে, রাস্তায় অপেক্ষা করছেন সাহায্যের জন্য। ২৬ মার্চ থেকে সবকিছু বন্ধ হওয়ার পর এখন আর সংসার চলছে না। গতকাল দুপুরে বেগম রোকেয়া সরণির মোড়ে দেখা গেছে সাহায্যের জন্য কয়েকজন অপেক্ষা করছেন। তারা বলছেন, 'কাম নাই, ট্যাহা নাই, খামু কী?'

খাবারের আশায় তাদের মতো আরও ১০-১২ জনকে বসে থাকতে দেখা যায় গাবতলী প্রধান সড়কের পাশে বাস স্ট্যান্ডে। একইভাবে গোলাপবাগ মোড় থেকে মুগদা হয়ে মালিবাগ, রামপুরা, বাড্ডা লিংক রোড পর্যন্ত ঘুরে দেখা গেছে, সড়কের দুই পাশে ত্রাণের আশায় বসে আছেন বহু মানুষ। মালিবাগ চৌধুরীপাড়া এলাকায় ত্রাণ সংগ্রহ নিয়ে বেশ কয়েকজনকে হুড়োহুড়ি করতে দেখা গেছে। মিরপুর ১০ নম্বরে ফাঁকা সড়কে দেখা যায়, অল্প বয়সী এক নারীর পেছনে তার পাঁচ বছর বয়সী সন্তান দৌড়াচ্ছে। হাতে একটি থালা। ওই নারী বলেন, 'আইজ তিন দিন অইলো দুই বেলা খাইয়া পার করতাছি। পোলাডা কানতাছে। মাইরা থামাইছি। সকালে ভাত পাইছিলাম। দুফ্যারে কী খাইবো। আমাগো মইর‌্যা যাইতে হইব!'

রাত সাড়ে ৯টায় ফার্মগেট ফুট ওভারব্রিজের ওপর দেখা যায় কয়েকজন ভবঘুরেকে। তারা আশপাশের ফুট ওভারব্রিজে থাকে। মার্কেট-দোকানপাট বন্ধ থাকায় প্রতিদিন পথচারীদের কাছ থেকে খাবার চেয়ে খায় তারা।

দরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষকে নিয়ে কাজ করা এনজিও কর্মীরা জানিয়েছেন, সাহায্য দেওয়ার আগে এসব মানুষকে চিহ্নিত করতে হবে। করোনাভাইরাসের কারণে আরও অনেকে নতুন করে দারিদ্র্যের শিকার হচ্ছেন। তাদেরও এর আওতায় আনতে হবে। খাদ্য বিতরণ করতে গেলে নিরাপদ দূরত্ব ভেঙে যাবে। এর চেয়ে নগদ সহায়তা দেওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন তারা।