মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প অত্যন্ত ঘনবসতি ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। অল্প জায়গায় গাদাগাদি করে কয়েক হাজার মানুষের বাস। গণশৌচাগার ব্যবহার করেন প্রায় সব বাসিন্দা। এমন পরিবেশে সেখানেই দু'জন করোনা আক্রান্ত রোগী পড়ে আছে এক সপ্তাহ ধরে। আইইডিসিআর ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হটলাইনে ফোন করা হলেও জেনেভা ক্যাম্প থেকে দুই রোগীকে কোনো হাসপাতালে ভর্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। উপরন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুম থেকে করোনা রোগীকে যেসব হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, সেখানে ওই দু'জনকে পাঠানোর জন্য স্থানীয় থানাকে বলা হয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন। করোনা রোগীকে সঠিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করে হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম পুলিশের কাছে নেই। এতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে জেনেভা ক্যাম্পেই রয়ে গেছে দুই করোনা আক্রান্ত রোগী।

সংশ্নিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, জেনেভা ক্যাম্পে অল্প জায়গায় অন্তত ৫০ হাজার লোক বাস করেন। গত ১৫-১৯ এপ্রিল পর্যন্ত ক্যাম্পের ১১ বাসিন্দা বিভিন্ন উপসর্গে মারা গেছেন। তারা হলেন- এরশাদ (৩৩), আলাউদ্দিন (৭০), নিজাম উদ্দিন (৭৫), ওসমান (৭৫), শাহজাহান (৬৫), মমতাজ কাদেরী (৭২), মুর্তজা (৪০), মুসলিম (৭১), শফিক (৭৫), জিসান (৭) ও খায়রুন্নেছা (৫১)। তাদের কেউ করোনায় আক্রান্ত ছিলেন কিনা তা জানা যায়নি। তবে গত ১৯ এপ্রিল আইইডিসিআরের পরীক্ষায় ক্যাম্পের সাত নম্বর সেক্টরের এক বাসিন্দার শরীরে করোনা শনাক্ত হয়। তার বয়স ৫১ বছর। তিনি পুরুষ। এ ছাড়া ক্যাম্পের বি-ব্লকে ৬১ বছর বয়সী আরেকজন করোনায় আক্রান্ত হন। প্রাথমিকভাবে তাদের আলাদা করে রাখা হলেও ক্যাম্পের ভেতরে আইসোলেশনে রাখার পরিবেশ নেই। তাদের আলাদা বাথরুম নেই। আলাদাভাবে গোসল করারও সুবিধা নেই। ক্যাম্পের ঘিঞ্জি পরিবেশ থেকে দুই রোগীকে দ্রুত সরানো না হলে কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের ঝুঁকি রয়েছে।

এদিকে ঝুঁকি বিবেচনা করে দ্রুত জেনেভা ক্যাম্প থেকে করোনা সংক্রমিত রোগীকে সরাতে আইইডিসিআরের হটলাইন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ করে পুলিশ। প্রথমে আইইডিসিআর থেকে এ ব্যাপারে করণীয় জানতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেওয়া হয় পুলিশকে। পরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ করা হলে সেখানে কর্মরত ডা. ইশরাত জানান, ওই দুই রোগীকে জেনেভা ক্যাম্পে আইসোলেশনে রাখতে হবে। ক্যাম্পের প্রকৃত চিত্র জানানোর পর তিনি বলেন, ওই দুই রোগীকে হাসপাতালে পাঠাতে লোকাল থানাকেই করোনা চিকিৎসায় নির্ধারিত হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।

পুলিশের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, পুলিশ মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে করোনার সংকটকালে নানা ধরনের কাজ করছে। তবে হাসপাতালে করোনা রোগী নেওয়ার কাজ পুলিশের নয়। এর জন্য আলাদা বিভাগ রয়েছে। এ ছাড়া আইইডিসিআরের নির্দেশনা মেনে পুলিশ কোনো এলাকা ও বাসা লকডাউন করছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সঠিক সময়ে এলাকার করোনা আক্রান্ত রোগীর ব্যাপারে তথ্য আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীকে জানানো হয় না। তাই করোনা এলাকা বা গলি লকডাইন করতে দেরি হয়। বিআরবি হাসপাতালের ২০ জনের বেশি চিকিৎসক ও স্টাফ করোনায় আক্রান্ত হলেও পুলিশকে সেই তথ্য জানানো হয়নি। এমনকি জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দা ছয় বছর বয়সী এক শিশু কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেও পুলিশকে সরকারিভাবে তা এখনও অবগত করা হয়নি। শনিবার ওই শিশুকে তালতলা কবরস্থানে দাফনও করা হয়। পুলিশ বলছে- করোনার ব্যাপারে তথ্য একটি সুনির্দিষ্ট সেল থেকে পুলিশকে জানানো হলে সমন্বিতভাবে কাজ করা সহজ হয়।

অন্য একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, গত ২৩ এপ্রিল জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. অমল কুমার চৌধুরী ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারকে একটি চিঠি দেন। চিঠিতে তিনি করোনা পরিস্থিতিতে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক, নার্স ও স্টাফদের জন্য মানসম্মত আবাসনের ব্যবস্থা করার অনুরোধ করেন। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে চিকিৎসকদের আবাসনের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষের। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পুলিশের কাছে এই সেবা চাইছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেরই এসব বিষয় দেখভাল করা উচিত।

পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের ডিসি বিপল্গব বিজয় তালুকদার সমকালকে বলেন, জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত যে কোনো বিষয় সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষ দেখলে তা সুচারুভাবে সম্পন্ন হয়।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাসান নুর ইসলাম সমকালকে বলেন, জেনেভা ক্যাম্পের দুই করোনা রোগীকে হাসপাতালে ভর্তির জন্য আইইডিসিআর ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ অনেক জায়গায় যোগাযোগ করেছি। তবু তাদের ভর্তি করাতে পারিনি। এখন তাদের আলাদা কক্ষে রাখা হয়েছে। ক্যাম্পের ভেতরে একটি স্কুলকে আইসোলেশন সেন্টার করারও উদ্যোগ নিয়েছিলাম। সেখানকার কিছু লোকের বাধার কারণে তা করা যায়নি।