রাজধানীর ২৬টি পার্ক ও খেলার মাঠকে আধুনিকায়নের জন্য ২০১৬ সালে উদ্যোগ নেয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে কাজ শুরু হয়। চলতি জুনের মধ্যে পুরো কাজ শেষ হওয়ার কথা। নির্ধারিত সময় শেষে মাত্র চারটি পার্কের কাজ শেষ হয়েছে। আর মেট্রোরেলের কারণে চারটি পার্কের কাজ বাদ দেওয়া হয়েছে। বাকি পার্কগুলোর কোনোটির কাজ শুরু হয়নি। কোনোটি শুরুর পর বন্ধ রয়েছে। ডিএনসিসির মতেই ৫, ১৫, ৩৫, ৪৫ বা সর্বোচ্চ ৫৫ শতাংশ কাজ হয়েছে। এগুলোর গড় অগ্রগতি ২৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ। ঠিকাদাররা বলছেন, ডিএনসিসির পক্ষ থেকে সাইটই বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। আবার সাইট বুঝিয়ে দিলেও মাঠের নকশা তারা চূড়ান্ত করতে পারছেন না। একবার চূড়ান্ত করার পর বলছে, এটা করা যাবে না। নতুন নকশা দেওয়া হবে। আর উন্নয়নকাজ বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্তাব্যক্তিরা অবৈধ দখল, ঠিকাদারদের গাফিলতি এবং প্রভাবশালীদের বাধার মতো নানা বিষয়কে বিলম্বের কারণ বলে নিজেদের ব্যর্থতাকে আড়াল করেছেন। এখন বলছেন 'করোনা'। এজন্য আরও দু'বছর সময় বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন। এদিকে প্রকল্পের কাজের ধীরগতির কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
এ প্রসঙ্গে ডিএনসিসির পার্ক ও মাঠের আধুনিকায়ন প্রকল্পের পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ড. তারিক বিন ইউসুফ সমকালকে বলেন, এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নানামুখী বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এগুলো স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও মেয়রের সহায়তায় সমাধান করতে হচ্ছে। এসব বাধা মোকাবিলা করতে গিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় বেশি লাগছে। এ জন্য দুই বছর সময় বাড়ানোর প্রস্তাব করেছি। আশা করি সার্বিক দিক বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষ প্রকল্পের সময় বাড়াবে। তিনি বলেন, একটা মাঠের চারপাশে দোকান আছে। সেগুলো স্থানান্তর না করে মাঠের কাজ করলে সেটা দৃশ্যমান হবে না। আবার কিছু পার্কের মধ্যে রাজনৈতিক দলের কার্যালয়, ওয়াসার পাম্প, ক্লাব আছে। সেগুলো পার্ক থেকে সরানোর জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা প্রয়োজন। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা গেলে বর্ধিত সময়ের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে নতুন করে ব্যয় বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না।
অবশ্য ঠিকাদাররা বলছেন, ডিএনসিসি সাইট বুঝিয়ে না দেওয়ার কারণে তারা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। প্রতিদিনই রড-বালু-সিমেন্টের দাম বাড়ছে। কাজেই তাদেরও ব্যয় বাড়বে। অথচ প্রকল্পের কর্মকর্তাদের অবহেলার কারণেই এই কাজ দেরি হচ্ছে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স খন্দকার শাহিন আহমেদ লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী বাবুল আখতার বাবলা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, অনেক পার্কের কোনো নকশাই তারা দিতে পারেনি। আবার নকশা দেওয়ার পর কাজ করলে পরে বলছে, ওটা পরিবর্তন করতে হবে। আর অনেক সাইট বুঝিয়েই দিতে পারেনি। এ নিয়ে তিনি মেয়রকে একটা লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পর এ প্রকল্পের কর্মকর্তারা বিষয়টি ভালোভাবে নেননি। কিন্তু এখন আর সময় নেই। কারণ এক কাজ নিয়ে তিনি কত দিন বসে থাকবেন।
জানা গেছে, বনানী ১৮ নম্বর খেলার মাঠের উন্নয়ন কাজ হয়েছে ৫৫ শতাংশ। এ ছাড়া বনানী সি ব্লক খেলার মাঠের ৩৫ শতাংশ, বনানী চেয়ারম্যানবাড়ী খেলার মাঠের ৪৫ শতাংশ, বনানী এফ ব্লকের ১৫ শতাংশ, বারিধারা পার্কের ১৫ শতাংশ, মোহাম্মদপুর হুমায়ুন রোড খেলার মাঠের ৪৫ শতাংশ, ইকবাল রোড খেলার মাঠের ৩৫ শতাংশ, শ্যামলী পার্কের ১৫ শতাংশ, রায়েরবাজার বৈশাখী মাঠের ১৫ শতাংশ, লালমাটিয়া ত্রিকোণ পার্কের ৫ শতাংশ, লালমাটিয়া ডি ব্লক খেলার মাঠের ৫ শতাংশ, কারওয়ান বাজার পার্কের ৫ শতাংশ এবং ইকবাল রোড উদয়াচল পার্কের ১৫ শতাংশ কাজ হয়েছে।
তবে গুলশানের বিচারপতি সাহাবুদ্দিন পার্ক, তাজমহল রোড পার্ক, জাকির হোসেন রোড খেলার মাঠ ও সলিমুল্লাহ রোড খেলার মাঠের কাজ শেষ হয়েছে। আর অবৈধ দখলদারদের প্রতাপে তাজমহল রোড খেলার মাঠের কাজ শেষ করতে পারছে না ডিএনসিসি। এ মাঠের অবৈধ স্থাপনা ভাঙার পর নতুন করে তারা আবার অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করেছে।
ডিএনসিসির আভ্যন্তরীণ এক মূল্যায়নে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে বলা হয়েছে, লালমাটিয়া 'ত্রিকোণ' পার্কে সরকারদলীয় অঙ্গসংগঠনের কার্যালয় রয়েছে। টাউন হল মসজিদ সংলগ্ন শহীদ পার্কের নকশা অনুযায়ী সড়ক সংলগ্ন দোকানগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে। ওই দোকানগুলোর ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে সেটা এখনও ঠিক করা হয়নি। আর করোনার সময়ে ওই পার্কের খালি জায়গায় কাঁচাবাজার বসানো হয়েছে। বনানী সি ব্লকের ৬ নম্বর রোড সংলগ্ন পার্কে বনানী সোসাইটির নিরাপত্তাকর্মীদের থাকার জন্য শেড, ওয়াসার পাম্প হাউস এবং ডেসকোর পরিত্যক্ত ভবন রয়েছে। এসব উচ্ছেদে ডিএনসিসির গড়িমসির কারণে ওই পার্কের উন্নয়ন কাজ বন্ধ। মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডের উদয়াচল খেলার মাঠে একটি ক্লাব ও সোসাইটির অফিস রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা প্রভাবশালী হওয়ায় ডিএনসিসি সেসব উচ্ছেদ করতে সাহস দেখাচ্ছে না। আর ওইসব স্থাপনা অপসারণ না করলে পরিকল্পনা অনুযায়ী মাঠের আধুনিকায়ন কাজ করা সম্ভব হবে না। কারওয়ান বাজার পার্কের জায়গায় বেশকিছু দোকান রয়েছে।
এদিকে ডিএনসিসির খামখেয়ালিপনায় প্রকল্পের কাজের ধীরগতির কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন পার্ক ও খেলার মাঠ সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারা। এ ছাড়া পার্ক বা খেলার মাঠের উন্নয়ন কাজের সময়ে যে পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়েছিল; ডিএনসিসি সেখান থেকে সরে দাঁড়িয়েছে বলেও অনেকের অভিযোগ। তাদের মতে, পার্ক ও খেলার মাঠগুলোর গাছ কেটে পরিবেশ নষ্ট করা হচ্ছে। অন্যদিকে নানাবিধ কংক্রিট স্থাপনা গড়ে তুলে কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত করা হচ্ছে পার্ক ও খেলার মাঠগুলো।
এসব প্রসঙ্গে এ প্রকল্পের কনসালট্যান্ট ও পার্কের ড্রইং-ডিজাইন প্রণয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানভিত্তিক স্থপতিদের দায়িত্বশীলদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে তাদের মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে প্রকল্প পরিচালক ড. তারিক বিন ইউসুফ বলেন, খেলার মাঠ ও পার্কে অনেক গাছ রয়েছে। কাজের প্রয়োজনে কিছু গাছ কেটে সেখানে ফলদ ও বনজ বৃক্ষ রোপণ করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বৃক্ষ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে এসব বিষয়ে নগরবাসী আমাদের ভুল বুঝছেন। সবকিছুই স্বনামধন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে করা হচ্ছে।