চূড়ান্ত 'অপারেশন'-এর আগে একটি দল নির্ধারিত স্থানে গিয়ে ভালোভাবে সবকিছু দেখে নেয়। চুলচেরা বিশ্নেষণের জন্য মোবাইল ফোনে কিছু ছবিও তুলে রাখে। ছবি দেখে পরে প্রবেশ বা বের হওয়ার পথসহ অন্যান্য খুঁটিনাটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়। এরপর তৈরি হয় একটি নিখুঁত পরিকল্পনা। অপারেশনের আগে-পরে দলের সদস্যরা পরস্পরের সঙ্গে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কে কথা বলা বন্ধ রাখে। সব যোগাযোগ হয় 'ইমো' অ্যাপের মাধ্যমে। কোনো কারণে একজন যদি অপরজনকে ডেকে পাঠায়, তা বিশেষ কৌশলে যাচাই করা হয়। ভিডিওকল দিয়ে আগে দেখে নেওয়া হয় যে, ওই সদস্য নিরাপদে আছে নাকি, এটা কোনো ফাঁদ। এভাবে নিজেদের সুরক্ষা বেষ্টনীতে রেখে মাত্র ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যেই অপারেশন সম্পন্ন করে তারা।

এ পর্যন্ত বর্ণনা পড়ে তাদের কোনো পেশাদার বাহিনীর সদস্য বলে মনে হতে পারে। হ্যাঁ, তারা পেশাদারই বটে, তবে চোর। চুরি করাই তাদের 'অপারেশন'। সুপরিকল্পিতভাবে প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে জুয়েলার্স, মোবাইল ফোনের দোকানসহ বিভিন্ন স্থানে নির্বিঘ্নে চুরি করে তারা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অভিযানে ধরা পড়া চক্রের দুই সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে এসব তথ্য। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- রুবেল হোসেন ও সফর আলী ওরফে সুমন। বৃহস্পতিবার তারা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।

ডিবির রমনা জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপকমিশনার মিশু বিশ্বাস সমকালকে বলেন, অভিনব কৌশলে প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ফাঁকি দেওয়ার অপচেষ্টা চালায়। তবে সেই চেষ্টা সফল হয়নি। এই চক্রে ২০ জনের মতো সদস্য আছে। গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে এ ব্যাপারে তথ্য মিলেছে। শিগগিরই তাদেরও আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে। এই চক্রের কয়েকটি সহযোগী দল আছে। একদল তালা কেটে চুরিতে সহায়তা করে, একদল তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে। আবার কেউ ধরা পড়লে জামিনের ব্যবস্থা করার জন্য আছে আরেকটি দল।

ডিবি সূত্র জানায়, রাজধানীর হাতিরপুলের মোতালিব প্লাজার পঞ্চম তলার দুটি শোরুম থেকে গত ২৩ জুলাই প্রচুর মোবাইল ফোন ও টাকা চুরি হয়। এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় মামলা করেন ভুক্তভোগীরা। পরে মামলা দুটি তদন্তের দায়িত্ব পায় ডিবি। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, ব্যবসায়ী দোকান বন্ধ করে চলে যাওয়ার পরই কয়েক যুবক তালা ভেঙে ভেতরে ঢোকে। ১০-১৫ মিনিটের মধ্যেই তারা মালপত্র নিয়ে বেরিয়ে যায়। নিজেদের আড়াল করতে তারা দোকানের বিজ্ঞাপনের ফেস্টুন ও ছাতা ব্যবহার করে।

তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা জানান, তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় প্রথমে চক্রের এক সদস্যের অবস্থান শনাক্ত করা সম্ভব হয়। এর পর বুধবার রাজধানীর সায়েদাবাদের জনপথ মোড়ের তিতাস হোটেলের তৃতীয় তলায় অভিযান চালানো হয়। সেখান থেকে দুই চোরকে গ্রেপ্তার ও চুরি হওয়া একটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তারা মোবাইল ফোনের দোকানে চুরির কথা স্বীকার করেছে। চার-পাঁচ বছর আগে তারা চট্টগ্রামের ফিশারীঘাট এলাকায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করত। সেখানে মাছ চুরি দিয়ে শুরু হয় তাদের অপরাধ জীবন।

এরপর দল গঠন করে বড় বড় জায়গায় চুরি শুরু করে। গত বছরের নভেম্বরে উত্তরায় স্বর্ণের দোকানে চুরির ঘটনায় ধরা পড়েছিল তারা। জামিনে বেরিয়ে আবারও জড়িয়েছে অপরাধে। চক্রের সদস্যদের প্রায় সবার বাড়ি কুমিল্লা। চুরির উদ্দেশ্য নিয়েই তারা ঢাকায় আসে। এখানে আবাসিক হোটেলে থেকে চুরির পর ফিরে যায়। চোরাই মালপত্র বিক্রি করে চট্টগ্রামে।