আবারও বেদখল হয়ে গেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের উদ্ধার করা ৫২ একর জমি। হাজার কোটি টাকা মূল্যের এই জমির অবস্থান গাবতলী-বাবুবাজার সড়কের স্লুইসগেট থেকে গাবতলী প্রধান সড়ক পর্যন্ত বেড়িবাঁধ সড়কের দু'পাশে। এসব জমিতে এখন সহস্রাধিক অবৈধ স্থাপনা। দখলদাররা এখানে ইট, বালু, পাথর, মাছের আড়ত, দোকানপাট, বাস-ট্রাক পার্কিং ও স্ট্যান্ড গড়ে তুলেছে। সেখান থেকে বছরে তাদের আয় শতকোটি টাকা। অথচ জমির মালিক ডিএনসিসি এ থেকে কিছুই পাচ্ছে না। ওই জমিতে ডিএনসিসির আধুনিক ওয়ার্কশপ, অ্যাসফল্ট প্ল্যান্ট, আধুনিক পশু জবাইখানা, খেলার মাঠ এবং সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলার কথা। এ লক্ষ্যে প্রকল্পও প্রস্তুত করেছে ডিএনসিসি। দখলদারদের সরাতে না পারায় সে প্রকল্পও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, বেদখল ওই জমি নতুন করে দখলমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে আমি ওই স্থান পরিদর্শন করেছি। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে সিটি করপোরেশনের সম্পত্তি বিভাগকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক করে অভিযানে নেমে ডিএনসিসির দখলে আনতে অন্তত দুই মাস সময় লাগবে।
তিনি বলেন, আগে যখন ওই জমি দখলমুক্ত করা হয়েছিল, তখন স্থায়ীভাবে সীমানাপ্রাচীর দেওয়া হলে নতুন করে দখলের সুযোগ থাকত না। এবার দখলমুক্ত করে ওই জায়গার টেকসই সীমানাপ্রাচীর করা হবে।
এ বিষয়ে গাবতলী ইট, পাথর ও বালু ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মাহমুদুল হাসান মনির বলেন, অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে তারা ওই জমি ইজারা নিয়েছিলেন। ব্রিটিশ আমল থেকেই এখানে ইট, বালু, খোয়ার ব্যবসা চলে আসছে। আর এখানকার ইট, বালু, খোয়া সরবরাহে রাজধানীসহ আশপাশের এলাকার উন্নয়ন কার্যক্রম চলে। এটি নিয়ে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করা হয়েছে। আদালত তাদের উচ্ছেদ না করতে স্থগিতাদেশ দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ২০১৭ সালে অভিযানের সময় কিছু দোকানপাটও ভুলবশত ডিএনসিসি উচ্ছেদ করে। পরবর্তী সময়ে আবার সেসব দোকান তৈরি করা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা ডিএনসিসির কাছে ওই জায়গা বরাদ্দ পেতে চান। ডিএনসিসির নিয়ম অনুসারে তারা নিয়মিত রাজস্বও পরিশোধ করবেন। কিন্তু ডিএনসিসি এসব দাবি-দাওয়ায় কোনো সাড়া দিচ্ছে না। তারা চান ডিএনসিসি এ ব্যবসার স্থানটি বরাদ্দ দিয়ে আশপাশের বাকি অবৈধ স্থাপনাগুলো অপসারণ করে ফেলুক। সে ক্ষেত্রে তাদের কোনো বাধা থাকবে না।
এ বিষয়ে ডিএনসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক বলেন, 'ওই জায়গা পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে ১৯৮৯ সালে তৎকালীন অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনকে ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়েছিল। ব্যবহারকারী সংস্থা হিসেবে সেই থেকে এ জমির মালিক ঢাকা সিটি করপোরেশন। পরবর্তী সময়ে ঢাকা সিটি ভাগ হওয়ার পর সেটার মালিক ডিএনসিসি। অন্য কারও মালিকানা বা ইজারা নিয়ে আর কোনো ধরনের জটিলতা নেই। আর ওই জায়গায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করতেও আইনগত বাধা নেই। নতুন করে ওই জায়গা দখলমুক্ত করার চিন্তা-ভাবনা চলছে। এবার দখলমুক্ত করলে স্থায়ীভাবে দখলে রাখতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সরেজমিন দেখা যায়, গাবতলী থেকে রায়েরবাজার যেতেই বেড়িবাঁধের দু'পাশে ডিএনসিসির জায়গায় ব্যবসার পসরা সাজিয়ে বসেছেন দখলদাররা। কেউ নিজেদের জায়গার সঙ্গে ডিএনসিসির জায়গা দখল করে সীমানাপ্রাচীর তুলেছেন। কেউ ছোট ছোট দোকানঘর তুলে বিশাল জায়গাজুড়ে ইট, খোয়া, বালু, পাথরের ব্যবসা করছেন। আবার কেউ বাস, ট্রাক স্ট্যান্ড বানিয়ে পার্কিং ফি আদায় করছেন। কেউবা মাছের আড়ত বানিয়েও ব্যবসা করছেন।
বেড়িবাঁধসংলগ্ন ডিএনসিসির প্রায় পাঁচ কাঠা জমি দখল করে ইট ও খোয়ার ব্যবসা করছে মেসার্স আফসানা এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটির মালিক আবু তাহের বলেন, এ জায়গা তিনি দখল করেননি। তিনি জমির মালিকদের মাসিক ১৬ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে ব্যবসা করছেন।
ব্যবসায়ীরা জানান, স্লুইসগেট থেকে গাবতলী প্রধান সড়ক পর্যন্ত বেড়িবাঁধ সড়কের দু'পাশে অন্তত ৫০০টি প্লট রয়েছে। কেউ ভাড়া দিয়েছেন বা নিজে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। এসব প্লটের মাসিক ভাড়া অন্তত ৩০ হাজার টাকা। আর ইট, পাথর ও বালুর মূল ঘাট এলাকার প্রতিটি প্লটের ভাড়া ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। ঘাটের বাইরের প্লট ভাড়া ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। এসব প্লট থেকে মাসে অন্তত দেড় কোটি টাকার ভাড়াবাণিজ্য করছেন দখলদাররা।
ওই এলাকার কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, ইট, খোয়া, বালু এবং পাথর ব্যবসার বাইরে ডিএনসিসির জায়গায় হোটেল, দোকানপাট প্রভৃতি স্থাপনাসহ অন্তত ৫০০টি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব অবৈধ স্থাপনা থেকেও মাসে বিপুল পরিমাণ ভাড়াবাণিজ্য হচ্ছে।
ব্যবসায়ীদের হিসাব অনুযায়ী, ডিএনসিসির ৫২ একর জায়গা থেকে বছরে দখলদাররা ভাড়াবাণিজ্য করছে অন্তত ৩৬ কোটি টাকা। এ ছাড়া ইট, পাথর, বালু, খোয়াসহ বহুবিধ ব্যবসা থেকে আরও অন্তত ৭০ কোটি টাকার ব্যবসা করছে। ওই জায়গার ওপর বছরে শতকোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছে। বিনিময়ে ডিএনসিসি কিছুই পাচ্ছে না। দখলের নেপথ্য নায়কদের ভয়ে ডিএনসিসি উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিতেও ভয় পাচ্ছে। আর এ সুযোগে অবৈধ দখলদাররা দিন দিন পোক্তভাবে দখল গেড়ে বসছে।
ডিএনসিসির ওই ৫২ একর সম্পত্তির বাজারমূল্য সম্পর্কে জানতে চাইলে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সদস্য কামাল মাহমুদ বলেন, 'ওই এলাকায় জমির বর্তমান কাঠাপ্রতি বাজারদর ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকা।' এ হিসাবে ডিএনসিসির ৫২ একর বা তিন হাজার ১২০ কাঠা জমির বাজারমূল্য দাঁড়ায় এক হাজার ৯২ কোটি টাকা। তবে স্থানীয় অনেকের মতে, বাণিজ্যিক কেন্দ্র হওয়ায় এর বাজারমূল্য হবে আরও বেশি।
ডিএনসিসির এক প্রকৌশলী বলেন, 'মেয়র আনিসুল হক বেঁচে থাকতে দখলদাররা ভয় পেত। এখন ওইসব দখলদার উল্টো আমাদের ভয় দেখান। সে সময় অনেক কষ্টে ওই জমি উদ্ধার করেছি। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে আমার নিবেদন, হয় এসব দখলদার উচ্ছেদ করে এখানে ডিএনসিসির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হোক, নইলে দখলদারদের জমি বরাদ্দ দিয়ে রাজস্ব আদায় করা হোক। তাহলেও জমিগুলো ডিএনসিসির নিয়ন্ত্রণে থাকবে, এ থেকে বছরে বড় অঙ্কের রাজস্বও আদায় হবে।'
ডিএনসিসির আরেক প্রকৌশলী জানান, বিভক্তির পর থেকে ডিএনসিসির যান্ত্রিক বিভাগের কোনো অফিস নেই। অ্যাসফল্ট প্লান্টেরও নিজস্ব কোনো জায়গা নেই। কারওয়ান বাজার স্থানান্তরের জন্য নির্মিত পাইকারি কাঁচাবাজারকে এখন যান্ত্রিকের ওয়ার্কশপ ও অ্যাসফল্ট প্ল্যান্টের সাইট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
সংশ্নিষ্টরা জানান, ২০১৭ সালের ৫ থেকে ৯ জুলাই পর্যন্ত উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে ডিএনসিসি। তৎকালীন মেয়র প্রয়াত আনিসুল হক ওই অভিযানে নেতৃত্ব দেন। ওই সময় ডিএনসিসির কঠোর ভূমিকা ছিল ওই সম্পত্তি উদ্ধারে। উদ্ধারের পর টিন দিয়ে সীমানা চিহ্নিত করা হয়। আনিসুল হক মারা যাওয়ার পর সেখানে আর টেকসই সীমানাপ্রাচীর তৈরি করেনি ডিএনসিসি। এ সুযোগে দখলদার চক্র ডিএনসিসির সাইনবোর্ড, টিনের সীমানা খুঁটি সরিয়ে আবার দখল করে নেয়।
ডিএনসিসির সম্পত্তি বিভাগ জানায়, দখলদাররা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ওই জমি ইজারা নিয়েছে বলে যেসব কাগজপত্র দেখায়, সে সবের কোনো ভিত্তি নেই। ওই জমি উদ্ধারের বিষয়ে উচ্চ আদালতের কোনো ধরনের স্থগিতাদেশও নেই।

বিষয় : ডিএনসিসির ৫২ একর জমি আবার বেদখল

মন্তব্য করুন