- রাজধানী
- উত্তরসূরি
উত্তরসূরি

ছবি: সংগৃহিত
বিষয়-সম্পত্তি- সে তো আইনেই বলা আছে, রক্তের সম্পর্কই উত্তরাধিকার ঠিক করে দেবে। শিল্পীর কোনো সৃষ্টির কপিরাইটও থাকবে তার পরিবারের সদস্যদেরই হাতে। কিন্তু শিল্পীর উত্তরসূরি? সেটা কখনোই রক্ত দিয়ে নির্ধারিত হতে পারে না। প্রকৃতিই শূন্যতা পূরণ করে দেয়, স্রষ্টাই সৃষ্টি করে দেন কোনো শিল্পীর উত্তরসূরি। যেমনটা ম্যারাডোনার উত্তরসূরি ঠিক করে দিয়েছেন তিনি লিওনেল মেসিকে।
ম্যারাডোনার বাঁ পায়ের শৈলী তাই মেসিতেই খুঁজে পাওয়া যায়, ম্যারাডোনার নান্দনিক ড্রিবলিংয়েও মিল পাওয়া যায় মেসির মধ্যে। বারবার তার প্রমাণ মিলেছে, তবু আরও একবার তার দেখা মিলল রোববারের ন্যু ক্যাম্পে। ২৭ বছর আগে ১৯৯৩ সালের ৭ অক্টোবর যে জার্সি গায়ে গোল করে দু'হাত তুলে যেভাবে তাকিয়ে ছিলেন ম্যারাডোনা, সেই একই ভাবে একই রকম গোল করে সে জার্সিটাই গায়ে জড়িয়ে মেসিও দু'হাত তুলে আকাশপানে তাকালেন- স্মরণ করলেন তার পূর্বসূরি ম্যারাডোনাকে।
এটা কি একান্তই কাকতালীয়? স্পেন আর আর্জেন্টিনার দৈনিকগুলো বিস্ময় ভরে মিল খুঁজছে এখন পূর্বসূরি আর উত্তরসূরির মধ্যে। ছিয়াশির বিশ্বকাপে যেবার আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ ট্রফি স্পর্শ করল ম্যারাডোনার হাত ধরে, তারও এক বছর পর রোজারিওতে জন্ম মেসির। ম্যারাডোনাকে নিয়ে দেশের উন্মাদনা অনুধাবন করার মতো পরিণতও নন তখন মেসি। তার পরও রাস্তার মোড়ে মোড়ে ম্যারাডোনার দেয়ালচিত্র দেখেছেন তিনি। তবে কিংবদন্তিকে প্রথম চোখে দেখা ওই ৭ অক্টোবর ১৯৯৩।
ছয় বছরের মেসি তখন রোজারিওর নাম করা ক্লাব নিউওয়েলস বয়েজের শিশু দলের সদস্য। আর ম্যারাডোনা ওই বছরই নিউওয়েলসের সঙ্গে চুক্তি করেন এবং প্রথম ম্যাচ খেলতে নামেন ইকুডোরিয়ান ক্লাব এমিলিকের বিপক্ষে। ডি বপের দূর থেকে ড্রিবলিং করে ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে বাঁ পায়ে কোনাকুনি একটি শটে গোল পেয়েছিলেন সেদিন ম্যারাডোনা। মেসিও ওসাসুনার বিপক্ষে রোববার একই ভাবে গোলটি করেন। 'আমি তখন খুব ছোট, পরিস্কার মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে, ওই ম্যাচেই প্রথম ম্যারাডোনাকে দূর থেকে দেখেছিলাম।' কয়েক বছর আগে আর্জেন্টিনার টিওয়াইসি স্পোর্টসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ম্যারাডোনা-দর্শনের প্রথম দিনের কথা এভাবেই বলেছিলেন মেসি।
ওই ম্যাচে ম্যারাডোনা যে জার্সিটি পরেছিলেন, বছর দুই আগে সেটিই হাত ঘুরে আসে মেসির কাছে। আর্জেন্টিনার এক অবসরপ্রাপ্ত বিচারক ম্যারাডোনার ওই জার্সিটি সংগ্রহ করেছিলেন। বার্সেলোনার জনপ্রিয় ক্রীড়া দৈনিক 'মুনডো ডেপোর্টিভো'র খবর, ওই বিচারক একজন শখের সংগ্রহকারী। যার শখ হলো পুরোনো কোনো জিনিস সংগ্রহ করে রাখা। তিনি ম্যারাডোনার ওই জার্সিটি দু-দু'বার চেষ্টা করেছিলেন মেসির হাতে পৌঁছে দেওয়ার। কিন্তু সেটা ব্যর্থ হওয়ার পর রাশিয়া বিশ্বকাপের আগে সেটা তিনি স্পেনের সাবেক এক ফুটবলারের হাতে পৌঁছে দেন মেসিকে দেওয়ার জন্য। মেসি সেটা হাতে পান বছর দুয়েক আগে। রোববার ন্যু ক্যাম্পে বার্সার হয়ে খেলতে নামার আগে মেসি সেই জার্সিটি বার্সার জার্সির নিচে পরেছিলেন। গোল করার পর বার্সার জার্সি খুলে ফেলে ম্যারাডোনার জার্সিটি গায়ে জড়িয়ে দু'হাত আকাশের দিকে উঁচুতে তুলে ধরে চোখ বুজে স্মরণ করেন ম্যারাডোনাকে। মেসির এ ছবিটি মুহূর্তে বিশ্বক্রীড়াঙ্গনে ভাইরাল হয়ে যায়।
জীবদ্দশায় মেসির সঙ্গে ম্যারাডোনার সম্পর্ক কেমন ছিল? তা নিয়ে অনেক চর্চা হয়েছে। আর্জেন্টিনার ফুটবল ইতিহাসে ম্যারাডোনা না মেসি? কে সেরা- সেটা নিয়েই প্রজন্মের পর প্রজন্ম তর্ক করেছে। দু'জনের রেকর্ড, গোলের সংখ্যা, ট্রফির সংখ্যা দিয়ে অঙ্কের হিসাব-নিকাশও করা হয়েছে। ম্যারাডোনা তার ক্যারিয়ারে সব মিলিয়ে মোট ৫৯৭ ম্যাচে গোল করেছিলেন ৩৬৫, সেখানে মেসি ৬৫৯ ম্যাচে ৬০৬। কিন্তু ম্যারাডোনার হাতে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিতেছিল, মেসির হাত সেখানে এখনও পর্যন্ত শূন্যই! তা ছাড়া দু'জনের মধ্যে গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক সেভাবে কখনোই গাঢ় হয়নি। ম্যারাডোনা ২০০৮ থেকে ২০১০ বিশ্বকাপ পর্যন্ত মেসিদের কোচ ছিলেন। যার মধ্যে ২৬ ম্যাচের ১৮টি জিতেছিল আর্জেন্টিনা। ২০১০ দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল আর্জেন্টিনাকে। মেসির খেলার প্রশংসা করলেও ম্যারাডোনা তার নেতৃত্বের ব্যক্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন রাশিয়া বিশ্বকাপের আগেও।
ফুটবল পায়ে দু'জনের শৈল্পিক ছন্দের মিল থাকলেও মাঠের বাইরে এক আরেকজনের একবারেই বিপরীত। প্রজন্মের পর প্রজন্মের একটি দূরত্ব ছিল তাদের মধ্যে। এখনকার রাত জেগে টেলিভিশনে ফুটবল খেলা দেখা প্রজন্মের কাছে ম্যারাডোনা শুধুই ইউটিউবে সার্চ করা ফুটবলার। সেখানে মেসিই তাদের কাছে 'মেসিডোনা'। আর্জেন্টিনার হয়ে যে বিনোদন যে আনন্দ দিয়ে গেছেন ম্যারাডোনা, সেই মুখগুলোতে হাসি ফোটানোর দায়িত্ব এখন মেসিরই। প্রকাশ্যে পূর্বসূরির প্রতি উচ্ছ্বাস কিংবা অতি আবেগ কখনোই দেখাননি মেসি, তবে হৃদয়ের কোণে যে শ্রদ্ধার জায়গাটি তিনি বসিয়ে রেখেছিলেন ম্যারাডোনার প্রতি, সেটিই যেন ফিরে এসেছিল সেদিন ন্যু ক্যাম্পে। ম্যারাডোনার জার্সি প্রদর্শন করায় আইনভঙ্গের কারণে একটি হলুদ কার্ডও দেখতে হয়েছে তাকে। কিন্তু তাতে কি, একটি দিন না হয় ফিরে যাওয়া যেতেই পারে সাতাশ বছর আগের সেই স্মৃতিতে।
মন্তব্য করুন